পর্ব তিন:
ইন্টারনেটের জন্মই হয়েছিল একে অপরের সাথে তথ্য ভাগ (share) করার জন্যে। আমরা বিগত দশকে উইকিপিডিয়া, ফেসবুক, ফ্লিকার ইত্যাদি যে সব উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখেছি সেগুলো কিন্তু সফল হয়েছে আমার আপনার স্বেচ্ছাসেবার ফলে বেশী পরিমাণে বিষয়বস্তু (content) তৈরীর মাধ্যমে। ইন্টারনেট সেইসব ব্যক্তির উপর ভরসা করে যারা স্বাধীন ভাবে আবেগ দিয়ে তাদের সময় এখানে ব্যয় করে। এইসব স্বেচ্ছাসেবীরা অধিকাংশই আপাত:দৃষ্টিতে বিনামূল্যে কাজ করলেও তাদের কিন্তু কিছুটা প্রাপ্তি আছে যা মূল্যে পরিমাপযোগ্য নয়। সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আজকে।
ছবি ফ্লিকার থেকে লোটে গ্রোনকারের সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এসএ।
মানুষ কেন বিনামূল্যে কন্টেন্ট তৈরি করতে পছন্দ করে? এই পৃথিবীতে অনেকে আছে যারা নিজে থেকে অনেক কিছু করতে করতে চায় আপাতদৃষ্টিতে কোন লাভের আশা ছাড়াই। এটাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। ধরুন অনেক বাঙ্গালী পছন্দ করে অন্যকে উপদেশ দিতে। ঔষধ, পথ্য থেকে শুরু করে এহেন কোন বিষয় নেই যা আমরা উপদেশ হিসেবে পাই। এগুলো কিন্তু উন্নত বিশ্বে মানুষ পেশাজীবীদের কাছ থেকে সাধারণত যোগাড় করে অথচ আমরা বিনামূল্যেই তা পাই।
বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে পেশাজীবী উপদেশক, যেমন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক বা স্থপতি এদের সাথে পাল্লা দিয়ে অপেশাদার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষও তাদের মতামত দিতে পারছে। ফলে বিশেষজ্ঞ অভিমতের মূল্য হঠাৎ করেই কমে গেছে। আগে রাজনীতি সম্পর্কে কলাম লিখতেন নামভারী রাজনীতিক/বুদ্ধিজীবীরা। বর্তমানে ব্লগে নাম না জানা সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাও আবার বিনামূল্যে। এই সব অপেশাদারদের কি প্রণোদনা দেয় বিনে পয়সায় এই সেবা দেবার?
এই সব কাজ কিন্তু আসলে আল্ট্রু্ইজম (নি;স্বার্থ ত্যাগ) বা সাহায্য নয়। অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন ”আলোকপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগত ইচ্ছা মানব জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ”। আলোকপ্রাপ্ত বা সংস্কারমুক্ত ব্যাক্তিগত ইচ্ছা' বা
এনলাইটেন্ড সেল্ফ ইন্টারেস্ট' নৈতিকতার নীতিবিদ্যার একটি দর্শন যা বলে যে যেসব ব্যক্তি অন্যের লাভের জন্যে কাজ করে বা অন্যকে সহায়তা করে, আদতে তার নিজের ব্যাক্তিগত ইচ্ছাই পূরণ করে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে এই ব্যাক্তিগত ইচ্ছা যদি সংস্কারমুক্ত না হয় বা কুটকৌশল সমৃদ্ধ হয় তাহলে এই দর্শন কার্যকরী হবে না এবং হিতে বিপরীত হতে পারে।
মানুষ অনেক কিছুই বিনামূল্যে করে দেয় তার নিজস্ব কারণে - অনেকে মজা করার জন্যে করে, কারণ তাদের ভাল লাগে - কারণ তারা তাদের প্রতি অন্যের দৃষ্টি ফেরাতে চায় – তাদের মতামতগুলো প্রচার করতে চায় এবং চায় অন্যরা তাদের সমর্থন করুক – এছাড়াও অনেক ব্যাক্তিগত কারণ থাকে তাদের।
লেখক ক্রিস অ্যান্ডারসন তার ফ্রি বইতে এই ব্যাপারটিকে সরলীকরণ করেছেন: "মানুষের শারীরিক চাহিদা গুলো যখন মিটে যায় মানুষের জন্যে কাঙ্খিত পণ্য হয় সামাজিক মূলধন" (
Social Capital) - অর্থাৎ, আমাদের পারিপার্শিক সমাজে আমাদের সুনাম, প্রভাব, প্রতিপত্তি ইত্যাদি।
২০০৭ সালে ওরাইলি মিডিয়ার লেখক
অ্যান্ডি ওরাম একটি গবেষণা করেন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা অপেশাদার কন্টেন্টগুলো নিয়ে যেগুলো বিশ্বব্যাপী ব্যাবহারকারীরা তৈরি করেছে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা ছাড়াই। তিনি এর পরিমাণ ও উন্নত মান দেখে অবাক হন - গেমস, হার্ডওয়ার ও সফ্টওয়ারের ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়াল, পণ্যের রিভিউ যা বাণিজ্যিক বিক্রেতাদের সেবার সংস্করণ থেকে অনেকগুণ সমৃদ্ধ। তিনি এরপর দীর্ঘমেয়াদী একটি
জরিপ করেন জানার জন্যে যে কি মানুষকে প্রণোদনা দেয় এইসব বিনামূল্যে করে দেবার।
ছবি ফ্লিকার থেকে পিট ফ্লেচ এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এনডি।
জরিপের ফলাফলের তালিকায় প্রথম ছিল কমিউনিটি - মানুষ এগুলো করে কমিউনিটি(তার পারিপার্শিক সমাজ) দ্বারা প্রণোদিত হয়ে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যাক্তিগত উন্নয়ন, অর্থাৎ অনুশীলন মানুষকে উন্নত কিছু তৈরি করতে সহায়তা করে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে জ্ঞান ভাগ করে নেয়া - অনেকেরই কিছু অর্জিত জ্ঞান থাকে যা প্রয়োগের সুযোগ হয় না - তাই ইন্টারনেটের কল্যাণে তারা উপযুক্ত কমিউনিটি খুঁজে সেগুলো দ্বারা অপরকে সহায়তা করতে সচেষ্ট হয় কোনরূপ প্রতিদানের আশা না করেই। মজার বিষয় হচ্ছে - সুনাম বা খ্যাতির আকাঙ্খা এই তালিকার নীচের দিকে ছিল। আর মানুষ কিভাবে সময় পায় এগুলো করার অন্য কোন কিছু করা বাদ দিয়ে যা তাকে সেরকম সামাজিক বা মানসিক প্রশান্তি এনে দেবে না? আমার নিজের কথাই ধরুন - এক জীবনে রকের আড্ডায় অনেক সময় অহেতুক ব্যয় করেছি - এখন হয়ত ফুরসত পেলে করণীয় বেছে নিতে হলে ব্লগিংকেই বেছে নেব দুটোর মধ্যে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মস্থল ও অন্যান্য স্থানে আমরা যেসব কাজ করে থাকি তাতে কিন্তু আমাদের জ্ঞান ও শক্তি বা ইচ্ছার কিছু অংশ অলস ভাবে থেকে যায় – সেগুলো সম্পূর্ণ ব্যবহার করার সুযোগ হয় না। সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলেন
কগনিটিভ সারপ্লাস। আমরা সেসব ক্ষেত্র আমাদের শ্রম বিনামূল্যে দিতে পছন্দ করি যা আমাদের বলার সুযোগ, সম্মান লাভ, অন্যের মনযোগ ও পাঠকশ্রেণী এনে দিতে সাহায্য করে। সংক্ষেপে বলতে হয় এসব কাজ বিনামূল্যে করলেও আমরা এর থেকে অর্থের বিনিময়ে চাকুরির থেকে বেশী পরিমান সন্তুষ্টি লাভ করি।
আমরা ইন্টারনেটের বৃদ্ধির সাথে এই ব্যাপারটি মিলিয়ে দেখতে পারি। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ নতুন কিছু তৈরি করে চলেছে ইন্টারনেটে যার বদলে বেশী বা কম পরিচিতি পাচ্ছে যা হয়ত তার পূর্বের জীবন যাত্রার মাধ্যমে সম্ভব হত না। এভাবেই ফ্রি কন্টেন্টের জোয়ার বইছে।
ইন্টারনেটে স্বেচ্ছাসেবা এবং দানের অর্থনীতি (gift economy):
অনেক সময় আপনি অনেক বিনামূল্যের জিনিষ ব্যবহার করেন এবং হয়ত জানতেও পারেন না যে কিভাবে এর জন্যে আপনাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। যেমন ধরুন বিনে পয়সার একটি ম্যাগাজিন পেলেন সেটা আসলে বিজ্ঞাপনদাতাদের কর্তৃক ভর্তুকি দেয়ার ফলে আপনি বিনামূল্যে পেয়েছেন। এই খরচটি ঐ নির্দিষ্ট পণ্যের বাজেটে ধরা আছে এবং আপনি বা অন্য কেউ যখন সেই পণ্যটি বেশী মূল্যে কিনছেন তখন ম্যাগাজিনটির দাম পরিশোধিত হয়ে যাচ্ছে। এটি একটি ত্রিমুখী মডেল যেখানে ম্যাগাজিন কোম্পানি বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে পাঠকদের বিক্রি করছে তাদের পণ্যের সম্ভাব্য ক্রেতা হিসেবে।
গিফ্ট ইকোনমি বা দানের অর্থনীতিতে এই ভর্তুকির পরিমাণ আরও সুক্ষ্ণ। আপনারা যে সচলায়তনে ব্লগ করেন -– যদিও ধরুন এখানে বিজ্ঞাপনের কারবার নেই, এর মানে এই নয় যে পাঠক আপনার ব্লগ পড়লে কোন মূল্যের স্থানান্তর হয় না। প্রতিটি পাঠক তার সময় ব্যয় করে আপনার ব্লগ পড়লে আপনার জনপ্রিয়তা বাড়ে - এবং এর পরিমাপযোগ্য অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও অবশ্যই ধনাত্মক (বা ঋণাত্মক) মূল্য আছে। সচল লিলেনদার ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রচুর বন্ধু লাইক মারলেন এবং পরবর্তী বইমেলায় তিনি এই জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে একটি বই বের করার সাহস পেলেন। তিনি অবশ্যই ব্যতিক্রম - কারণ অনেকেরই জনপ্রিয়তা ও অর্থ উপার্জন করা হয় না - এটি অবশ্য সিস্টেমের ব্যর্থতা নয়, তারা হয়ত চান না বা পারেন না।
পাওলো কোয়েলহো, ছবি উইকিমিডিয়া কমন্সের সৌজন্যে
ব্রাজিলের লেখক
পাওলো কোয়েলহো তার উপন্যাস ও অন্যান্য লেখা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিনামূল্যে পাঠকদের দেবার পক্ষপাতি। তার অনেক উপন্যাসের পুরোটা বা কিছু অধ্যায় তিনি
তার ব্লগে নিয়মিত তুলে দেন এবং পাঠকদের সাথে সে নিয়ে আলোচনায় মত্ত হন। কপিরাইটের সাধারণ ধারণা যে পাইরেসী লেখকের আয় কমায় - তার ক্ষেত্রে খাটে নি। তার একটি উপন্যাসের রাশিয়ান সংস্করণ একজন পাঠক ইন্টারনেটে তুলে দেয়। সেই উপন্যাস জনপ্রিয় হওয়ায় পরবর্তী ৩ বছরে তার সেই উপন্যাসের বিভিন্ন ভাষার সংস্করণ ১০ লাখের বেশি বিক্রি হয়। অর্থাৎ এইখানে বিনামূল্যের অর্থনীতির নতুন এক মাত্রা তৈরি হচ্ছে।
দানের অর্থনীতির আরেকটি উদাহরণ - আপনি গুগলে যখনই কোন কিছু সার্চ করেন আপনি তাদের বিজ্ঞাপন নিশানা করার মডেলকে উন্নত করার কাজে লাগেন, অর্থাৎ আপনার নিজের দরকারের একটি সার্চকে গুগুল তার লাভের জন্যে কাজে লাগায়। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা আরও আকর্ষিত হয় গুগলে বিজ্ঞাপন দিতে। আপনি হয়ত জানেনও না যে আপনি একটি বিনে পয়সার সেবা ব্যবহার করলেন আসলে আপনারই শ্রমের বিনিময়ে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ফ্রেড উইলসনের নামকরণকৃত
ফ্রিমিয়াম মডেলটি ব্যবহার করা হয় সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে। ফ্লিকারের প্রিমিয়াম ভার্সনের মূল্য বছরে ২৫ ডলার। দেখা গেছে একটি গতানুগতিক অনলাইন সাইটের ক্ষেত্রে শতকরা ৫% প্রিমিয়াম ভোক্তা বাকী ৯৫% বিনামূল্যের ভোক্তার খরচকে বহন করে। এখানে তারা সেটা পারে কারণ এই ৯৫% ভোক্তাকে সেবা দেওয়ার প্রান্তিক খরচ খুবই কম – প্রায় শুণ্যের কাছাকাছি - কারন তাদের পরিকাঠামো মূলত প্রিমিয়াম ভোক্তাদের সেবার জন্যে নিবেদিত ,– অন্যান্যরা বাই প্রডাক্ট। ফ্লিকার সব ভোক্তাদের উপর ফি ধার্য করে না - কারণ তাহলে নতুন কেউ আসবে না এই সেবা নিতে। ফলে তাদের মধ্য থেকে প্রিমিয়াম গ্রাহক হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। এ ছাড়াও তাদের নানা রকম আয়ের উৎস আছে যার মাধ্যমে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে পারে ও লাভের মুখ দেখে।
ছবি ফ্লিকার থেকে ডেভিড এরিকসন এর সৌজন্যে, সিসি বাই-এনসি লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত
আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত দুটি মডেলের কথা আলোচনা করলাম –বিনে পয়সার পণ্যের – কিছু অর্থমূল্য বা শূণ্য অর্থমূল্য। কিন্তু তৃতীয় আরেকটি মডেল আছে - তা হচ্ছে ঋণাত্মক মূল্য – বা পণ্য ব্যবহারের জন্যে টাকা পাওয়া। ক্যাশব্যাক বা গিফট ভাউচার এরকম মডেলের উদাহরণ। যদিও এগুলো আসলে এক ধরণের মূল্য ছাড়, ভোক্তাদের বোঝানো হয় যে তারা টাকা সত্যিই ফেরত পাচ্ছে।
এখন আসা যাক ফ্রি পণ্যের অসুবিধার কথা। মাগনা পাইলে মানুষ আলকাতরাও খায় এই প্রবাদবাক্য সবক্ষেত্রেই খাটে। তবে আসল কথা হচ্ছে বিনামূল্যের পণ্যের প্রতি মানুষের সাধারণত: অবজ্ঞা থাকে। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করার পর আমাকে একটি সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল। কষ্টের প্রতিদান হিসেবে প্রাপ্ত বলে সেই সাইকেল আমি খুব যত্নের সাথে চালাতাম। অথচ আমার ছোট ভাই নটরডেমে ভর্তি হবার পর কলেজে সেটি বেখেয়ালে হারিয়ে ফেলে - কারণ তার সেই টান ছিল না সাইকেলটির প্রতি। কাজেই কোন পণ্যের যদি খুব সামান্য মূল্যও থাকে বা ব্যবহারের কঠিন শর্ত থাকে তাহলে তা ব্যবহারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
গুগলের ফ্রি পণ্যের সাম্রাজ্য
গুগলের সাম্রাজ্য অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ফ্রি পণ্যের ক্ষেত্রে। বর্তমানে গুগলের রয়েছে ১০০টিরও বেশী পণ্য এবং তাদের বেশীরভাগই ফ্রি - সত্যিই কোন লুকানো খরচ নেই। এবং এই দিয়েই তাদের সাম্রাজ্য গড়া হয়েছে। তারা তাদের সার্চ ইঞ্জিন আর কিছু সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এত পয়সা আয় করে যে তারা সত্যিই অন্য সব সেবা বিনামূল্যে দিতে পারে যেগুলো বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের আকর্ষণ করে রাখে। এবং ভোক্তা বাড়ার সাথে সাথে তাদের আয় এবং সেবার মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে নতুন নতুন ধারণা বাজারে ছাড়া এটা না ভেবেই যে সেটা কি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে কি না। গুগলের সাফল্যের ধারাবাহিকতা এখানে দেখা যাক:
১৯৯৯-২০০১ - সার্চ ইঞ্জিনকে আরও কার্যকরী করায় সক্ষম
২০০১-২০০৩ - এডসেন্সের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দাতাদের পছন্দ মত বিজ্ঞাপন তৈরি ও স্থাপনার সুযোগ করে দেয়া এবং সবচেয়ে ভাল যায়গার জন্যে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা।
২০০৩ - বর্তমান পর্যন্ত - অনেক ধরণের সেবা তৈরি করা
ছবি ফ্লিকার থেকে অ্যালাঁ বাখেলিয়ের এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এনডি।
১০ বছরের মাথায় আজকে গুগল ২০ বিলিয়ন ডলার কোম্পানি এবং এর সবকিছু ফ্রি পণ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। গুগল কিন্তু থেমে নেই - তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে ডাটা সেন্টার তৈরি করছে তাদের সেবার গতি বাড়ানোর জন্যে ও মান উন্নয়নের জন্যে। তাদের পঞ্চাশটির কাছাকাছি ডাটা সেন্টারে এখন আছে ৫ লাখেরও বেশী সার্ভার - যা একসময় তাদের অন্য প্রতিযোগীর কাছ থেকে অনেক তফাৎ তৈরি করবে। এতে যা হচ্ছে তা হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবহারকারী বাড়ছে এবং মাথাপ্রতি সেবার খরচ কমে যাচ্ছে। ফলে তারা আরও বেশী বিনামূল্যের সেবা দিতে পারছে।
গুগলের ডাইরেক্টরি সার্ভিস
গুগ ৪১১ এর কথাই ধরুন। যেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এওএল এই সেবার জন্যে টাকা নেয় গুগল তা দেয় বিনে পয়সায়। কিভাবে? প্রতিবার যখন ভোক্তারা তথ্য চেয়ে গুগ ৪১১কে ফোন করে তারা রেখে যায় গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট - তাদের কণ্ঠ - যা বিভিন্ন অ্যাক্সেন্টের ও গতির। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে গুগল তাদের ভয়েস রেকগনিশন সার্চ ইঞ্জিন সফটওয়্যার উন্নত করার চেষ্টায় রত আছে। বিনামূল্যে এই সেবা না দিলে এইসব রিসার্চ কন্টেন্ট তাদের পয়সা দিয়ে কিনতে হত।
গুগলের সুবিধা হচ্ছে এর বিভিন্ন নতুন ধারণা যদি সফল নাও হয় এর ক্ষতি নেই। ব্যর্থ উদ্যোগ যেমন গুগল ওয়েভ, অর্কুট ইত্যাদির ও লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী আছে। তাই নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে এরা প্রচুর ব্যবহারকারীকে বেটা টেস্টিংয়ের জন্যে নিয়োগ করতে পারে (বিনে পয়সায়) এবং ফল আশানুরুপ না হলে সেটি বাদ দিয়ে নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করতে পারে।
দ্যা বিগ সুইচের লেখক নিকোলাস কার বলেছেন “গুগল চায় তথ্য প্রবাহ হোক বিনামূল্যে। কারণ যখন তথ্য পাবার মূল্য কমে যাবে এটি আরও বেশী পরিমানে আয়ের উৎস হবে তাদের জন্যে”।
ওয়ালমার্ট এবং এইচএনএমের মত ডিসকাউন্ট স্টোরের চাপে পিষ্ট ছোট ছোট স্টাইল বুটিকগুলো বর্তমানে নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহার করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যৎে গুগল সাম্রাজ্যের ফ্রির এই যথেচ্ছাচার মনোপলি ঠেকাতে সেরকম শৈল্পিক বুটিক বা ছোট নতুন ধারণার ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যায়গা করে নিতে পারবে কি না সেটি দেখার বিষয়।
পরবর্তী পর্বে থাকবে ফ্রি সংস্কৃতি এবং উদ্ভাবকদের কাজের মূল্য নিশ্চিত করা (ওপেন সোর্স, কপিরাইট/কপিলেফ্ট) ইত্যাদি
প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন