Thursday, December 23, 2010

আমাকে শুদ্ধ করতে চাও কে গো তোমরা?

পৃথিবীর যাবতীয় অনাচারের অধিকাংশ হয়েছে আত্মগরিমা ও নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। অনেকে মনে করেছে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন জাতি নেই তাই তাদেরই দেশ দখল করে বিশ্ব শাসন করা উচিত। আবার অনেকে মনে করেছে তাদের মত মানবতাবাদী (?) বিশ্বে বিরল তাই তারা তাদের মানবতাবাদ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে। কেউ কেউ মনে করে তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মের ধারণকারী, কাজেই অন্যদের নীচু করে দেখে তাদের দাব ...পৃথিবীর যাবতীয় অনাচারের অধিকাংশ হয়েছে আত্মগরিমা ও নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। অনেকে মনে করেছে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন জাতি নেই তাই তাদেরই দেশ দখল করে বিশ্ব শাসন করা উচিত। আবার অনেকে মনে করেছে তাদের মত মানবতাবাদী (?) বিশ্বে বিরল তাই তারা তাদের মানবতাবাদ বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে। কেউ কেউ মনে করে তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মের ধারণকারী, কাজেই অন্যদের নীচু করে দেখে তাদের দাবিয়ে রাখাটাই জায়েজ। এদের রোষানলে পরে সব সময়ই নির্যাতিত হচ্ছে সংখ্যালঘুরা, নির্মম ভাবে।

এই ২০১০ সালে আমি বিশ্বের বুকে এমনই এক অনাচারের বিস্তার দেখে স্তম্ভিত। কারেক্টিভ রেপ বা শোধক ধর্ষণ নামে একটি প্রথা চালু হয়েছে একবিংশ শতকে যা দক্ষিণ আফ্রিকায় অনাচারের পাহাড় তৈরি করছে। সমকামী নারীদের ধর্ষণ করলেই তারা শুদ্ধ সম্ভোগের স্বাদ পাবে এবং পরিশুদ্ধ হয়ে সাধারণ যৌন জীবন যাপন করবে এমন ধারণা একদল লোকের। তাদের মতে এইসব সমকামীদের সত্যিকারের  আফ্রিকার নারী বানানোর এই সুযোগ।

এক  রিপোর্ট জানাচ্ছে যে ওয়েস্টার্ন কেপের ৮৬ ভাগ সমকামী নারী ধর্ষণের ভয়ে ভীত।  এই ধরণের আক্রমণের শিকার দক্ষিণ আফ্রিকার মহিলা ফুটবল দলের তারকা ইউডি যাকে ২০০৯ সালে গণধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়।

প্রতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫০০র ও বেশী সমকামী মহিলা শোধক ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এবং ৩০ জনকে মেরে পর্যন্ত ফেলা হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিচার ব্যবস্থা এই শোধক ধর্ষণকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে না। ফলে এইসব ধর্ষণকারী স্বল্প জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ষণের জন্যে পুরুষদের এমন অজুহাতের কমতি নেই। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশের কতিপয় লোকেরা জিম্বাবুয়ে থেকে পলায়নরত উদ্বাস্তুদের ধর্ষণ করতেও পিছপা হয় না। হায়, কে কাকে শোধরাতে আসে!

বুসিসিওয়ে সিগাসা নামে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কবি আর ব্লগার ধর্ষিত হওয়ার ছয় মাস পরে ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে জানতে পারেন যে তার দেহে এইচআইভি ভাইরাস ঢুকেছে।

এখানে রয়েছে তার দু:খের কাহিনীর কিয়দংশ, যা তিনি তার ব্লগ মাই রিয়ালিটিজ এ লিখেছেন:
 বেশী দিন হয়নি জানতে পারলাম যে আমি এইচআইভি তে আক্রান্ত। আমি অনেক বেশীবার আক্রান্ত আর ধর্ষিত হয়েছি যার ফলে এই ভাইরাসে আমি আক্রান্ত হয়েছি। কারণ হল যে আমি একজন নারী যে নিজেকে সমকামী বলি একজন মহিলার সাথে আমার সম্পর্কের কারনে। আমাকে আক্রমণকারী আর বিভিন্ন ধর্ষক পুরুষরা এমন করেছে আমাকে বোঝানোর জন্য যে নারী হওয়ার আসল মানে কি।
বুসি এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে পারেন নি যেহেতু তিনি ২০০৭ সালের মার্চ মাসে রোগে ভুগে মারা যান । কিন্তু তার ব্লগ আর কবিতা তার জীবনের প্রতি এই অবিচারের শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেছে।

জুলুমের শিকার এইসব নারীদের কথা  লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে। আপনারা চাইলে চেন্জ.অর্গের এই পিটিশনটি সাইন করতে পারেন।

 বুসির ছবি জানেলে মুহলি আর এলেন আইজেনমানের সৌজন্যে

সচলায়তনে প্রকাশিত

Thursday, November 04, 2010

বাড়ি ফেরা

ঢাকায় ফিরেছি দুই সপ্তাহ আগে। বাবা-মার অসুস্থতার জন্যে দেশে ফেরার তাগিদ ছিল। গত জুনেই এ কারনে ঘুরে গেছি। এবারে একেবারেই ফিরেছি - তাই বেশ প্রশান্তি মনে। তার জন্যে সাহায্য করেছে নিয়তি। জুলাই মাসে আবেদন করেছিলাম ঢাকায় একটি চাকুরির জন্যে। সেটিই ত্বরান্বিত করল বাকি সবকিছু। প্রকল্পটি স্বল্প মেয়াদের কাজেই কয়েক মাস পরেই আবার চাকুরি অনিশ্চিত। কিন্তু সেটি কোন ব্যাপারই নয় আমার জন্যে। আমার দরকার ছিল একটি অজুহাত, ফেরার জন্যে।

এই ফেরাটা কেমন হল? বাড়ি ফেরার মধ্যে আলাদা একধরনের ভালোলাগা কাজ করে। কারও হয়ত প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে ভাল লাগে। কারও হয়ত কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর। আমি এত হিসাব কষি না। বাইরে থাকলে কখনই সেখানকার বসত বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে হত না।

মানুষ একজীবনে সব অসম্পূর্ণতা ধুয়ে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু কালে সেই অসম্পূর্ণতাগুলো জীবনেরই অঙ্গ হয়ে যায়। বাড়ি ফেরা মানে হচ্ছে চেনা জীবনের সেই অসঙ্গতির মধ্যে ফিরে যাওয়া - সেই লোড শেডিং সেই ট্রাফিক। আর কিছু উপরি পাওনা আছে - মায়ের হাতের রান্না ঝোলের স্বাদ পুনরায় আয়েশ করে পাওয়া।

ঢাকা বদলেছে অনেক - লোক বেড়েছে - খাম্বায় তার বেড়েছে - অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। আর বেড়েছে দ্রব্য মূল্য - রিক্সায় উঠেই দশ টাকা, সিএনজি একশ টাকা, ভিক্ষা পাঁচ টাকা। মানুষের বেতন কি বেড়েছে এই জ্যামিতিক হারে? চারিদিকে টাকা আয়ের জন্যে হাহাকার।

আমার বড় চাচার বড় ছেলে বিদ্যুৎ বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী, চাকুরির বয়স শেষ হল প্রায়। গেলবার হজ্ব করেছেন তাই দাড়ি রেখেছেন। তিনি ঘুষ খান না তাই তার শত্রু অনেক। এবার তার চাকুরি খাবার জোড় তদবির করছে সহকর্মীরা তিনি জামাতের লোক এই অপবাদ দিয়ে। প্রকারান্তরে জামাতের অবস্থানই মজবুত করছে এইসব স্বার্থান্বেষী অর্বাচীনরা।

প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় ঘন্টাখানেক সিএনজিতে জ্যামে বসে থাকি। মোবাইল ইন্টারনেটের কল্যানে ফেসবুক দেখি, এটা ওটা করি। আর ভাবি জাকার্তা/বার্লিনের মত যদি ওভারপাস আন্ডারপাস হত তাহলে ২০ মিনিটে অফিস পৌছানো যেত। বাস্তবতা এই যে এই অসঙ্গতি গুলো নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তার পরেও বাড়ি ফেরার মধ্যে আনন্দ আছে।

সেই আনন্দ নিয়েই এখন ঘুমাতে যাচ্ছি। শুভরাত্রি।

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা: ময়ান ব্রেন

সচলায়তনে প্রকাশিত

Thursday, September 16, 2010

যেই লোকটি মাইকেল রকেফেলারকে খেয়ে ফেলেছিল

হ্যা, আঁতকে ওঠার মতই এই শিরোনামটি। 'দ্যা ম্যান হু এইট মাইকেল রকেফেলার' হচ্ছে জেফ কোহেন পরিচালিত নিউ ইয়র্কের অফ ব্রডওয়ের সাম্প্রতিক মঞ্চায়িত একটি (সেপ্টেম্বর ১০ -অক্টোবর ৩, ২০১০) নাটকের নাম যা ক্রিস্টোফার স্টোকসের একই শিরোনামে একটি ছোট গল্প অবলম্বনে রচিত।

এখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগবে এই মাইকেল রকেফেলার কে। কোন সাধারণ মানুষ হলে এত মনোযোগ পেতেন না যতটুকু মাইকেল রকফেলার পেয়েছেন ১৯৬১ সালে তৎকালীন নিউ গিনিতে তার অন্তর্ধানের পরে। ১৯৩৮ সালে নিউ ইয়র্কে জন্ম নেয়া মাইকেল তৎকালীন নিউইয়র্কের মেয়র এবং পরবর্তী আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট নেলসন অলড্রিচ রকেফেলারের  ছেলে।

আজকের দিনে যেমন  বিল গেটস বা আম্বানি পরিবারের সম্পদ ও সাম্রাজ্যের কথা আমাদের মুখে মুখে সেরকমই আমেরিকার রকেফেলার পরিবারের  নামের পরিচিতি উনবিংশ শতাব্দি শেষ ভাগ থেকে বিশ্বব্যাপী রয়েছে। জন ডি রকেফেলার অবশ্য দানেও সুপরিচিত ছিলেন –- শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় তারই অর্থে তৈরি এবং তিনি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করছেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং শিশুদের কল্যাণে (১৯২৫ সালের ৫০০ মিলিয়ন মানে বর্তমানে ৫ বিলিয়ন ডলার)। তাদের পরিবারেরই সন্তান নেলসন ডি রকেফেলার ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের গভর্নর হন। তিনি তিন বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্যে দাড়িয়ে ১৯৭৪ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন।

ছবি: কলেজে মাইকেল

মাইকেলের বেড়ে ওঠা ছিল শান শওকতের মধ্যে - খেদমতে ছিল প্রচুর কাজের লোক। সেরা স্কুল, ইউরোপে ছুটি কাটাতে যাওয়া এবং আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় রকফেলার ম্যানসনগুলিতে ভ্রমণ - এগুলো তার জন্যে ছিল নস্যি। মাইকেলের গ্রাজুয়েশন হয় ১৯৬০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে এবং তার পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ দেয়াই তার অবধারিত নিয়তি ছিল।

কিন্তু একটু পড়ুয়া টাইপের (তার চোখের চশমার জন্যে) মাইকেল বখে যান নি এবং তার ধনের গর্ব ছিল না। তিনি তার প্রচলিত জীবনধারার বাইরে অভিজ্ঞতা লাভের জন্যে পুয়ের্টোরিকোতে এক গ্রীষ্মের ছুটি কাটান মুদি দোকানে কাজ করেন এবং ভেনেজুয়েলাতে তাদের পরিবারের র‍্যান্চে রাখালের কাজ করেছেন। নতুন যায়গা, মানুষ ও বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। এবং সেই আগ্রহ মেটাতে নিয়তির খেলায় মাত্র তেইশ বছর বয়সে নিউ গিনির জঙ্গলে তিনি অন্তর্ধান হন।


View Larger Map

আজও পর্যন্ত নিউ গিনিকে বেশ রহস্যভরা এলাকা হিসেবে সুবিদিত। গত শতাব্দী জুড়ে ইংরেজ এবং ওলন্দাজ মিশনারীরা সেখানকার জংলী আদিবাসীদের ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সভ্য জগৎে ফিরে এসে তাদের ছিন্নমস্তক এবং মানুষের মাংস খাবার গল্প ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মনযোগ আকর্ষণ করেছেন। এই সব জংলীরা বাস করতেন ঘন জঙ্গলে - মাইলের পর মাইল ভেতরে। ওখানে কম সভ্য লোকই যেতে পারত বলে তাদের এইসব মানুষখেকো আদিম আচার তখনও চলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেখানে নৃতত্ত্ববিদদের বেশ কটি অভিযান চালিত হয় এবং ঘটনাক্রমে মাইকেল ১৯৬১ সালে সেরকম একটি অভিযানে অংশ নিয়ে পাপুয়া নিউ গিনি আসে।

হার্ভার্ডের গ্রাজুয়েশন শেষে ৬ মাস বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেইনিং এর পরে বাবার ব্যাক্তিগত আর্টের সংগ্রহশালার জন্যে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করার জন্যে তার দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেজ অঞ্চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তার রুমমেটের কাছে শুনতে পান যে রবার্ট গার্ডনার নামে হার্ভার্ডের একজন তরুণ প্রফেসর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের হয়ে নিউ গিনিতে একটি নৃতাত্বিক অভিযানে যাবেন। ঠিক হল যে রকফেলার নিজ খরচে অভিযানে যোগ দেবেন এবং রবার্টের ডকুমেন্টারি দলে সাউন্ড রেকর্ডার এবং ফটোগ্রাফারের কাজ করবেন।

তারা তৎকালীন ডাচ নিয়ন্ত্রিত নিউ গিনিতে (বর্তমানে দ্বীপটির এক অংশ ইন্দোনেশিয়ার এবং আরেক অংশ স্বাধীন পাপুয়া নিউ গিনি) এসে বালিয়েম উপত্যকার এনদানি আদিবাসীদের উপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা শুরু করেন। এই অভিযানের ছবিতে দেখা যায় মুখভর্তি দাড়ি ও খাকি প্যান্ট পড়া মাইকেল আদিবাসীদের সাথে কথা বলছেন ও তাদের ছবি তুলছেন। এই অভিযানে মাইকেল আসমাত আদিবাসীদের (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার অধীনে পাপুয়ার একদল জংলী)সম্পর্কে শোনেন এবং তাদের কাঠের কাজ, মস্তকের খুলিতে কাজ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন।

১৯৬১ সালের জুন মাসে তিনি মূল অভিযান থেকে আলাদা হয়ে আসমাতদের সন্ধানে যান। তিনি স্টিলের কুঠার আর সিগারেট এর বদলে এগুলোর কয়েকটি নমুনা যোগাড় করেন এবং বিস পোল (৩০ ফুট লম্বা কাঠের কারুকার্যখচিত পোল) এবং কাঠের ক্যানো (নৌকা) সংগ্রহ করতে মনস্থ করেন। রকফেলার তার ডায়রিতে লেখেন আসমাত আদিবাসী সম্পর্কে: “এইসব শিল্পের মতই আশ্চর্যজনক হচ্ছে তাদের আচার ও রীতি যা এখনও আদিম রয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগেও এরা সবাই হেডহান্টিং(ছিন্নমস্তক সংগ্রহ) করত। কিছু গহীন এলাকায় এখনও তারা তা করে।” তবে উদ্ধত ও বিপদজনক আসমাতদের সাথে সমস্যা হওয়ায় তিনি আবার মূল অভিযানে ফিরে যান জুলাই মাসে। সেপ্টেম্বর মাসে তারা সবাই আমেরিকা ফিরে যান।

বাড়িতে ফিরে মাইকেল শোনেন যে তার বাবা-মার বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে এবং তার মন ভারাক্রান্ত হয়। তিনি আবার নিউ গিনি ফিরে যেতে মনস্থ করেন এবং সেই অভিযানের জন্যে যোগাড়-যন্তর শুরু করেন। এর জন্যে সরকারী অনুমোদনের দরকার ছিল – তবে তার পিতা ক্ষমতার জোরে সহজেই মার্কিন ও ডাচ সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহ করে দেন। দু সপ্তাহ বাড়ি থেকেই তিনি সেপ্টেম্বরেই আবার পাপুয়া নিউ গিনি ফিরে যান।

তিনি প্রথমে থামেন উত্তরের উপকুলের হলান্ডিয়াতে (তখনকার ডাচ কলোনির রাজধানী) এবং ডাচ সরকারকে বলেন একজন গাইড জোগাড় করতে। ঠিক হয় ডাচ ব্যুরো অফ নেটিভ অ্যাফেয়ার্সের রেনে ওয়াসিন্ক যাবে তার সাথে। এটি একটি অবিবেচক সিদ্ধান্ত ছিল কারন রেনে একজন নৃতত্ববিদ ছিলেন – অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বুশম্যান নয়। তারা ৩০ ফুট লম্বা একটি মোটর চালিত ক্যানু (নৌকা) কেনেন এবং অক্টোবরের মাঝামাঝি আসমাতদের লোকালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। তারা ডজনের ও বেশী আসমাত গ্রামে যান এবং ডাচ মিশনারীদের সহায়তায় তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি আরও আদিবাসী শিল্পকর্ম যোগাড় করেন এবং এবং ছিন্ন মস্তকের জন্যে ১০টি কুঠার দেবেন বলে ঘোষণা দেন যা পরে ডাচ সরকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সমালোচিত হয় (কারণ এটি আদিবাসীদের মানুষ হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করবে)।

ছবিতে: রেনে ওয়াসিন্ক
এই অভিযানে তার খুব কষ্ট হলেও বিরল শিল্প কর্ম সংগ্রহের লক্ষ্যে তিনি তা চালিয়ে নিতে থাকেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরের ১৮ তারিখে তারা আইলান্ডেন নদী দিয়ে যাচ্ছিলেন যা আরাফুরা সাগরে এসে মিশেছে। সাগরের বিস্তীর্ণ মোহনায় এসে জোড়াল স্রোতের তোড়ে তাদের নৌকায় পানি ঢোকে ও তা উল্টিয়ে যায়। তাদের সাথের আদিবাসী দুই বালক পেট্রোলের জেরিকেনের তেল ফেলে সেটাকে লাইফবয় করে সাহায্যের জন্যে কুলের সন্ধানে ছুটে যায়। মাইকেল ও রেনে উল্টানো নৌকা ধরে ভাসতে থাকেন খরস্রোতা নদীর মোহনায়। স্রোত নৌকাটাকে এবং সাথে সাথে মাইকেল ও রেনেকেও সাগরের দিকে টেনে নিতে থাকে। তাদের আশা ছিল সাহায্য আসবে সহসাই – এবং এই আশায় একটি রাত ভেসে কাটায় তারা। ভোর পাঁচটার দিকে তারা তীরের দেখা পায় এবং আন্দাজ করে ৪ থেকে ৭ মাইল দুরে তা হবে। তারা নৌকার কাঠ ভেঙ্গে দাড় বাইতে চেষ্টা করে উল্টানো নৌকার দিক পরিবর্তনের জন্যে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। তারা ক্রমশই সমুদ্রের দিকে ভেসে যাচ্ছে দেখে মাইকেল সাঁতরে কুলের দিকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। রেনে তাকে বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে এবং শেষে বলে “মাইকেল তুমি পাগল হয়ে গেছ”। রেনে সাঁতার ভাল মত পারেন না তাই বোটের কাছে থেকে গেলেন।

সেই আদিবাসী ছেলে দুটি পাঁচ ঘন্টা সাঁতরে তীরে পৌঁছে খবরটি দেয় যে মাইকেল ও রেনে বিপদে পড়েছে। পরদিন সকালে ডাচ সরকার ১২টি নৌকা ও সার্চ প্লেন সহকারে উদ্ধার টিম পাঠায়। নভেম্বরের ১৯ তারিখ বিকেলে রয়্যাল ডাচ নেভি রেনেকে সাগর থেকে উদ্ধার করে।

মাইকেলের বাবা তৎকালীন নিউ ইয়র্কের গভর্নর ও পরবর্তীকালে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নেলসন রকেফেলার
খবর পেয়ে গভর্নর নেলসন রকেফেলার পাপুয়া ছুটে আসেন। তার উদ্যোগে আরও দশদিন সার্চ অব্যাহত থাকে, কিন্তু মাইকেলের দেখা মেলে না।

রেনে মনে করেন যে মাইকেল ভাটার সময় সাঁতরে কুলে যেতে পারেন নি। তবে মাইকলের বাবার গুরুত্ব বিবেচনা করে এরপর সংবাদপত্র বিভিন্ন ধরনের চটকদার সংবাদ তৈরি করতে থাকে (হলুদ সাংবাদিকতা তখনও ছিল)। প্রথম দিকে চাউর হয় কোন কুমীর বা হাঙ্গর মাইকেলকে খেয়েছে তাই সে কুলে পৌঁছাতে পারে নি। এর পর বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে খবর এসেছে মাইকেলকে জঙ্গলিরা ধরে রেখেছে বা সে স্বেচ্ছায় তাদের সাথে আছে। এ জন্যে মাইকেলের পরিবার কখনই তার ফিরে আসার আশা ছাড়ে নি।

মাইকেলের এই ঘটনা নিয়ে বেশ কটি বই লেখা হয়েছে, টিভিতে ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে যাতে তার রহস্যময় অন্তর্ধানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ছবি: সাংবাদিক মিল্ট মাখলিন
আট বছর পরে সাংবাদিক মিল্ট মাখলিন নিউ গিনিতে পৌছান মাইকেল রকেফেলারের অন্তর্ধান রহস্য তদন্ত করতে। তিনি আসমাতদের গ্রামে কাজ করা এক ডাচ মিশনারী উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে জঙ্গলিরা তাকে ধরে খেয়ে ফেলেছে। এই মিশনারী জানান যে মাইকেল যেখানে অদৃশ্য হয়েছে তার অনতিদুরেই পাঁচজন আসমাত লোককে ডাচ পুলিশ বছর দুই আগে হত্যা করে। তারা প্রতিশোধ নেবার জন্যে মুখিয়ে ছিল। পানিতে থাকা অবস্থায়ই জঙ্গলিরা তীর মেরে মাইকেলকে আহত করে। এর পর তাকে ডাঙ্গায় তোলা হয় এবং মাথা কেটে নেয়া হয়। তার শরীরের কিছু অংশ রেঁধে তারা খায় এবং বাকি অংশ মাটিতে পুঁতে ফেলে। দুজন আদিবাসী যোদ্ধা জানায় যে তারা একজন সাদা চামড়ার উইচ ডক্টরকে ধরে মাথা কেটে ফেলে এবং তার যাদু এখন তাদের কাছে। এদের একজন যাদু হিসেবে মাইকেলের চশমা দেখায়।

কেউ কেউ এমনও বলেছে যে ডাচ সরকার জঙ্গলি দ্বারা মাইকেলের মৃত্যুর ঘটনা লুকিয়েছে তখন কারণ এতে পর্যটক/অভিযান আসা বন্ধ হয়ে যেত।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত মিল্ট মাখলিন এর 'দ্যা সার্চ ফর মাইকেল রকফেলার' বইটি অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে যা এ বছরই বের হবার কথা। ১৯৯৫ সালে ডিসকভারী চ্যানেলে মাইকেলের উপর একটি ডকুমেন্টারীতে তার পরিবারের লোকজনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে - নিউ গিনির এক অংশ এখন ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশ এবং অপর অংশ স্বাধীন পাপুয়া নিউ গিনি। কিন্তু কিছু জিনিষ এখনও বদলায়নি। ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কার পত্রিকা ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়ার ইরিন জায়াতে একটি অভিযাত্রার খবর ছাপায় যেখানে এক জঙ্গলী গোত্রের সাথে সভ্য জগৎের মানুষের প্রথম দেখা হয়। যা বোঝায় যে এই অঞ্চলের বহু এলাকা এখনও সভ্য মানুষের যোগাযোগের বাইরে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সাইটটি এ কে রকফেলারের নামে যাকে বলা হয় মাইকেল রকফেলারের মিশ্র সন্তান যে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন কর্মকান্ড করে যাচ্ছে।

মাইকেল রকেফেলারের সংগৃহীত অনেক শিল্পকর্ম এখন মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টস (মোমা) এর মাইকেল সি রকেফেলার কালেকশনে আছে (মাইকলের বাবা এই জাদুঘরের একজন ট্রাস্টি ছিলেন)।

ছবি এবং অন্যান্য গল্পের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি নিম্নলিখিত সাইটগুলির কাছে:

১) মাইকেল রকেফেলারের অন্তর্ধান - পাপুয়া হেরিটেজ সোসাইটি

২) মাইকেল রকেফেলার - ডেভিড ক্রাইচেক, ট্রুটিভি ক্রাইম লাইব্রেরী

আরও কিছু সহায়ক লিঙ্ক:

১) দ্যা সার্চ ফর মাইকেল রকেফেলার - আগামেমনন ফিল্মস

২) ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া রেইন ফরেস্টের আদিবাসীদের ছবি - যারা সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন

৩) লিওনার্দ নিময়ের উপস্থাপনায় টিভি ডকুমেন্টারি ইউটিউবে দেখুন:

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩

সচলায়তনে প্রকাশিত

Sunday, September 12, 2010

ফ্রি মানে মাগনা নয় - পর্ব তিন

পর্ব তিন:

ইন্টারনেটের জন্মই হয়েছিল একে অপরের সাথে তথ্য ভাগ (share) করার জন্যে। আমরা বিগত দশকে উইকিপিডিয়া, ফেসবুক, ফ্লিকার ইত্যাদি যে সব উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখেছি সেগুলো কিন্তু সফল হয়েছে আমার আপনার স্বেচ্ছাসেবার ফলে বেশী পরিমাণে বিষয়বস্তু (content) তৈরীর মাধ্যমে। ইন্টারনেট সেইসব ব্যক্তির উপর ভরসা করে যারা স্বাধীন ভাবে আবেগ দিয়ে তাদের সময় এখানে ব্যয় করে। এইসব স্বেচ্ছাসেবীরা অধিকাংশই আপাত:দৃষ্টিতে বিনামূল্যে কাজ করলেও তাদের কিন্তু কিছুটা প্রাপ্তি আছে যা মূল্যে পরিমাপযোগ্য নয়। সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আজকে।

ছবি ফ্লিকার থেকে লোটে গ্রোনকারের সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এসএ

মানুষ কেন বিনামূল্যে কন্টেন্ট তৈরি করতে পছন্দ করে? এই পৃথিবীতে অনেকে আছে যারা নিজে থেকে অনেক কিছু করতে করতে চায় আপাতদৃষ্টিতে কোন লাভের আশা ছাড়াই। এটাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। ধরুন অনেক বাঙ্গালী পছন্দ করে অন্যকে উপদেশ দিতে। ঔষধ, পথ্য থেকে শুরু করে এহেন কোন বিষয় নেই যা আমরা উপদেশ হিসেবে পাই। এগুলো কিন্তু উন্নত বিশ্বে মানুষ পেশাজীবীদের কাছ থেকে সাধারণত যোগাড় করে অথচ আমরা বিনামূল্যেই তা পাই।

বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে পেশাজীবী উপদেশক, যেমন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক বা স্থপতি এদের সাথে পাল্লা দিয়ে অপেশাদার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষও তাদের মতামত দিতে পারছে। ফলে বিশেষজ্ঞ অভিমতের মূল্য হঠাৎ করেই কমে গেছে। আগে রাজনীতি সম্পর্কে কলাম লিখতেন নামভারী রাজনীতিক/বুদ্ধিজীবীরা। বর্তমানে ব্লগে নাম না জানা সাধারণ নাগরিকের কাছ থেকে গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাও আবার বিনামূল্যে। এই সব অপেশাদারদের কি প্রণোদনা দেয় বিনে পয়সায় এই সেবা দেবার?

এই সব কাজ কিন্তু আসলে আল্ট্রু্ইজম (নি;স্বার্থ ত্যাগ) বা সাহায্য নয়। অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন ”আলোকপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগত ইচ্ছা মানব জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ”। আলোকপ্রাপ্ত বা সংস্কারমুক্ত ব্যাক্তিগত ইচ্ছা' বা এনলাইটেন্ড সেল্ফ ইন্টারেস্ট' নৈতিকতার নীতিবিদ্যার একটি দর্শন যা বলে যে যেসব ব্যক্তি অন্যের লাভের জন্যে কাজ করে বা অন্যকে সহায়তা করে, আদতে তার নিজের ব্যাক্তিগত ইচ্ছাই পূরণ করে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে এই ব্যাক্তিগত ইচ্ছা যদি সংস্কারমুক্ত না হয় বা কুটকৌশল সমৃদ্ধ হয় তাহলে এই দর্শন কার্যকরী হবে না এবং হিতে বিপরীত হতে পারে।
মানুষ অনেক কিছুই বিনামূল্যে করে দেয় তার নিজস্ব কারণে - অনেকে মজা করার জন্যে করে, কারণ তাদের ভাল লাগে - কারণ তারা তাদের প্রতি অন্যের দৃষ্টি ফেরাতে চায় – তাদের মতামতগুলো প্রচার করতে চায় এবং চায় অন্যরা তাদের সমর্থন করুক – এছাড়াও অনেক ব্যাক্তিগত কারণ থাকে তাদের।

লেখক ক্রিস অ্যান্ডারসন তার ফ্রি বইতে এই ব্যাপারটিকে সরলীকরণ করেছেন: "মানুষের শারীরিক চাহিদা গুলো যখন মিটে যায় মানুষের জন্যে কাঙ্খিত পণ্য হয় সামাজিক মূলধন" (Social Capital) - অর্থাৎ, আমাদের পারিপার্শিক সমাজে আমাদের সুনাম, প্রভাব, প্রতিপত্তি ইত্যাদি।

২০০৭ সালে ওরাইলি মিডিয়ার লেখক অ্যান্ডি ওরাম একটি গবেষণা করেন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা অপেশাদার কন্টেন্টগুলো নিয়ে যেগুলো বিশ্বব্যাপী ব্যাবহারকারীরা তৈরি করেছে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা ছাড়াই। তিনি এর পরিমাণ ও উন্নত মান দেখে অবাক হন - গেমস, হার্ডওয়ার ও সফ্টওয়ারের ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়াল, পণ্যের রিভিউ যা বাণিজ্যিক বিক্রেতাদের সেবার সংস্করণ থেকে অনেকগুণ সমৃদ্ধ। তিনি এরপর দীর্ঘমেয়াদী একটি জরিপ করেন জানার জন্যে যে কি মানুষকে প্রণোদনা দেয় এইসব বিনামূল্যে করে দেবার।

ছবি ফ্লিকার থেকে পিট ফ্লেচ এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এনডি

জরিপের ফলাফলের তালিকায় প্রথম ছিল কমিউনিটি - মানুষ এগুলো করে কমিউনিটি(তার পারিপার্শিক সমাজ) দ্বারা প্রণোদিত হয়ে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যাক্তিগত উন্নয়ন, অর্থাৎ অনুশীলন মানুষকে উন্নত কিছু তৈরি করতে সহায়তা করে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে জ্ঞান ভাগ করে নেয়া - অনেকেরই কিছু অর্জিত জ্ঞান থাকে যা প্রয়োগের সুযোগ হয় না - তাই ইন্টারনেটের কল্যাণে তারা উপযুক্ত কমিউনিটি খুঁজে সেগুলো দ্বারা অপরকে সহায়তা করতে সচেষ্ট হয় কোনরূপ প্রতিদানের আশা না করেই। মজার বিষয় হচ্ছে - সুনাম বা খ্যাতির আকাঙ্খা এই তালিকার নীচের দিকে ছিল। আর মানুষ কিভাবে সময় পায় এগুলো করার অন্য কোন কিছু করা বাদ দিয়ে যা তাকে সেরকম সামাজিক বা মানসিক প্রশান্তি এনে দেবে না? আমার নিজের কথাই ধরুন - এক জীবনে রকের আড্ডায় অনেক সময় অহেতুক ব্যয় করেছি - এখন হয়ত ফুরসত পেলে করণীয় বেছে নিতে হলে ব্লগিংকেই বেছে নেব দুটোর মধ্যে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মস্থল ও অন্যান্য স্থানে আমরা যেসব কাজ করে থাকি তাতে কিন্তু আমাদের জ্ঞান ও শক্তি বা ইচ্ছার কিছু অংশ অলস ভাবে থেকে যায় – সেগুলো সম্পূর্ণ ব্যবহার করার সুযোগ হয় না। সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলেন কগনিটিভ সারপ্লাস। আমরা সেসব ক্ষেত্র আমাদের শ্রম বিনামূল্যে দিতে পছন্দ করি যা আমাদের বলার সুযোগ, সম্মান লাভ, অন্যের মনযোগ ও পাঠকশ্রেণী এনে দিতে সাহায্য করে। সংক্ষেপে বলতে হয় এসব কাজ বিনামূল্যে করলেও আমরা এর থেকে অর্থের বিনিময়ে চাকুরির থেকে বেশী পরিমান সন্তুষ্টি লাভ করি।

আমরা ইন্টারনেটের বৃদ্ধির সাথে এই ব্যাপারটি মিলিয়ে দেখতে পারি। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ নতুন কিছু তৈরি করে চলেছে ইন্টারনেটে যার বদলে বেশী বা কম পরিচিতি পাচ্ছে যা হয়ত তার পূর্বের জীবন যাত্রার মাধ্যমে সম্ভব হত না। এভাবেই ফ্রি কন্টেন্টের জোয়ার বইছে।

ইন্টারনেটে স্বেচ্ছাসেবা এবং দানের অর্থনীতি (gift economy):

অনেক সময় আপনি অনেক বিনামূল্যের জিনিষ ব্যবহার করেন এবং হয়ত জানতেও পারেন না যে কিভাবে এর জন্যে আপনাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। যেমন ধরুন বিনে পয়সার একটি ম্যাগাজিন পেলেন সেটা আসলে বিজ্ঞাপনদাতাদের কর্তৃক ভর্তুকি দেয়ার ফলে আপনি বিনামূল্যে পেয়েছেন। এই খরচটি ঐ নির্দিষ্ট পণ্যের বাজেটে ধরা আছে এবং আপনি বা অন্য কেউ যখন সেই পণ্যটি বেশী মূল্যে কিনছেন তখন ম্যাগাজিনটির দাম পরিশোধিত হয়ে যাচ্ছে। এটি একটি ত্রিমুখী মডেল যেখানে ম্যাগাজিন কোম্পানি বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে পাঠকদের বিক্রি করছে তাদের পণ্যের সম্ভাব্য ক্রেতা হিসেবে।

গিফ্ট ইকোনমি বা দানের অর্থনীতিতে এই ভর্তুকির পরিমাণ আরও সুক্ষ্ণ। আপনারা যে সচলায়তনে ব্লগ করেন -– যদিও ধরুন এখানে বিজ্ঞাপনের কারবার নেই, এর মানে এই নয় যে পাঠক আপনার ব্লগ পড়লে কোন মূল্যের স্থানান্তর হয় না। প্রতিটি পাঠক তার সময় ব্যয় করে আপনার ব্লগ পড়লে আপনার জনপ্রিয়তা বাড়ে - এবং এর পরিমাপযোগ্য অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও অবশ্যই ধনাত্মক (বা ঋণাত্মক) মূল্য আছে। সচল লিলেনদার ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রচুর বন্ধু লাইক মারলেন এবং পরবর্তী বইমেলায় তিনি এই জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে একটি বই বের করার সাহস পেলেন। তিনি অবশ্যই ব্যতিক্রম - কারণ অনেকেরই জনপ্রিয়তা ও অর্থ উপার্জন করা হয় না - এটি অবশ্য সিস্টেমের ব্যর্থতা নয়, তারা হয়ত চান না বা পারেন না।

পাওলো কোয়েলহো, ছবি উইকিমিডিয়া কমন্সের সৌজন্যে

ব্রাজিলের লেখক পাওলো কোয়েলহো তার উপন্যাস ও অন্যান্য লেখা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিনামূল্যে পাঠকদের দেবার পক্ষপাতি। তার অনেক উপন্যাসের পুরোটা বা কিছু অধ্যায় তিনি তার ব্লগে নিয়মিত তুলে দেন এবং পাঠকদের সাথে সে নিয়ে আলোচনায় মত্ত হন। কপিরাইটের সাধারণ ধারণা যে পাইরেসী লেখকের আয় কমায় - তার ক্ষেত্রে খাটে নি। তার একটি উপন্যাসের রাশিয়ান সংস্করণ একজন পাঠক ইন্টারনেটে তুলে দেয়। সেই উপন্যাস জনপ্রিয় হওয়ায় পরবর্তী ৩ বছরে তার সেই উপন্যাসের বিভিন্ন ভাষার সংস্করণ ১০ লাখের বেশি বিক্রি হয়। অর্থাৎ এইখানে বিনামূল্যের অর্থনীতির নতুন এক মাত্রা তৈরি হচ্ছে।

দানের অর্থনীতির আরেকটি উদাহরণ - আপনি গুগলে যখনই কোন কিছু সার্চ করেন আপনি তাদের বিজ্ঞাপন নিশানা করার মডেলকে উন্নত করার কাজে লাগেন, অর্থাৎ আপনার নিজের দরকারের একটি সার্চকে গুগুল তার লাভের জন্যে কাজে লাগায়। ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা আরও আকর্ষিত হয় গুগলে বিজ্ঞাপন দিতে। আপনি হয়ত জানেনও না যে আপনি একটি বিনে পয়সার সেবা ব্যবহার করলেন আসলে আপনারই শ্রমের বিনিময়ে।

ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ফ্রেড উইলসনের নামকরণকৃত ফ্রিমিয়াম মডেলটি ব্যবহার করা হয় সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে। ফ্লিকারের প্রিমিয়াম ভার্সনের মূল্য বছরে ২৫ ডলার। দেখা গেছে একটি গতানুগতিক অনলাইন সাইটের ক্ষেত্রে শতকরা ৫% প্রিমিয়াম ভোক্তা বাকী ৯৫% বিনামূল্যের ভোক্তার খরচকে বহন করে। এখানে তারা সেটা পারে কারণ এই ৯৫% ভোক্তাকে সেবা দেওয়ার প্রান্তিক খরচ খুবই কম – প্রায় শুণ্যের কাছাকাছি - কারন তাদের পরিকাঠামো মূলত প্রিমিয়াম ভোক্তাদের সেবার জন্যে নিবেদিত ,– অন্যান্যরা বাই প্রডাক্ট। ফ্লিকার সব ভোক্তাদের উপর ফি ধার্য করে না - কারণ তাহলে নতুন কেউ আসবে না এই সেবা নিতে। ফলে তাদের মধ্য থেকে প্রিমিয়াম গ্রাহক হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। এ ছাড়াও তাদের নানা রকম আয়ের উৎস আছে যার মাধ্যমে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে পারে ও লাভের মুখ দেখে।


ছবি ফ্লিকার থেকে ডেভিড এরিকসন এর সৌজন্যে, সিসি বাই-এনসি লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত 

আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত দুটি মডেলের কথা আলোচনা করলাম –বিনে পয়সার পণ্যের – কিছু অর্থমূল্য বা শূণ্য অর্থমূল্য। কিন্তু তৃতীয় আরেকটি মডেল আছে - তা হচ্ছে ঋণাত্মক মূল্য – বা পণ্য ব্যবহারের জন্যে টাকা পাওয়া। ক্যাশব্যাক বা গিফট ভাউচার এরকম মডেলের উদাহরণ। যদিও এগুলো আসলে এক ধরণের মূল্য ছাড়, ভোক্তাদের বোঝানো হয় যে তারা টাকা সত্যিই ফেরত পাচ্ছে।

এখন আসা যাক ফ্রি পণ্যের অসুবিধার কথা। মাগনা পাইলে মানুষ আলকাতরাও খায় এই প্রবাদবাক্য সবক্ষেত্রেই খাটে। তবে আসল কথা হচ্ছে বিনামূল্যের পণ্যের প্রতি মানুষের সাধারণত: অবজ্ঞা থাকে। আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করার পর আমাকে একটি সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল। কষ্টের প্রতিদান হিসেবে প্রাপ্ত বলে সেই সাইকেল আমি খুব যত্নের সাথে চালাতাম। অথচ আমার ছোট ভাই নটরডেমে ভর্তি হবার পর কলেজে সেটি বেখেয়ালে হারিয়ে ফেলে - কারণ তার সেই টান ছিল না সাইকেলটির প্রতি। কাজেই কোন পণ্যের যদি খুব সামান্য মূল্যও থাকে বা ব্যবহারের কঠিন শর্ত থাকে তাহলে তা ব্যবহারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

গুগলের ফ্রি পণ্যের সাম্রাজ্য

গুগলের সাম্রাজ্য অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ফ্রি পণ্যের ক্ষেত্রে। বর্তমানে গুগলের রয়েছে ১০০টিরও বেশী পণ্য এবং তাদের বেশীরভাগই ফ্রি - সত্যিই কোন লুকানো খরচ নেই। এবং এই দিয়েই তাদের সাম্রাজ্য গড়া হয়েছে। তারা তাদের সার্চ ইঞ্জিন আর কিছু সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এত পয়সা আয় করে যে তারা সত্যিই অন্য সব সেবা বিনামূল্যে দিতে পারে যেগুলো বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের আকর্ষণ করে রাখে। এবং ভোক্তা বাড়ার সাথে সাথে তাদের আয় এবং সেবার মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে নতুন নতুন ধারণা বাজারে ছাড়া এটা না ভেবেই যে সেটা কি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে কি না। গুগলের সাফল্যের ধারাবাহিকতা এখানে দেখা যাক:

১৯৯৯-২০০১ - সার্চ ইঞ্জিনকে আরও কার্যকরী করায় সক্ষম
২০০১-২০০৩ - এডসেন্সের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দাতাদের পছন্দ মত বিজ্ঞাপন তৈরি ও স্থাপনার সুযোগ করে দেয়া এবং সবচেয়ে ভাল যায়গার জন্যে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা।
২০০৩ - বর্তমান পর্যন্ত - অনেক ধরণের সেবা তৈরি করা

ছবি ফ্লিকার থেকে অ্যালাঁ বাখেলিয়ের এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি-এনডি

১০ বছরের মাথায় আজকে গুগল ২০ বিলিয়ন ডলার কোম্পানি এবং এর সবকিছু ফ্রি পণ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। গুগল কিন্তু থেমে নেই - তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে ডাটা সেন্টার তৈরি করছে তাদের সেবার গতি বাড়ানোর জন্যে ও মান উন্নয়নের জন্যে। তাদের পঞ্চাশটির কাছাকাছি ডাটা সেন্টারে এখন আছে ৫ লাখেরও বেশী সার্ভার - যা একসময় তাদের অন্য প্রতিযোগীর কাছ থেকে অনেক তফাৎ তৈরি করবে। এতে যা হচ্ছে তা হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবহারকারী বাড়ছে এবং মাথাপ্রতি সেবার খরচ কমে যাচ্ছে। ফলে তারা আরও বেশী বিনামূল্যের সেবা দিতে পারছে।

গুগলের ডাইরেক্টরি সার্ভিস গুগ ৪১১ এর কথাই ধরুন। যেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এওএল এই সেবার জন্যে টাকা নেয় গুগল তা দেয় বিনে পয়সায়। কিভাবে? প্রতিবার যখন ভোক্তারা তথ্য চেয়ে গুগ ৪১১কে ফোন করে তারা রেখে যায় গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট - তাদের কণ্ঠ - যা বিভিন্ন অ্যাক্সেন্টের ও গতির। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে গুগল তাদের ভয়েস রেকগনিশন সার্চ ইঞ্জিন সফটওয়্যার উন্নত করার চেষ্টায় রত আছে। বিনামূল্যে এই সেবা না দিলে এইসব রিসার্চ কন্টেন্ট তাদের পয়সা দিয়ে কিনতে হত।

গুগলের সুবিধা হচ্ছে এর বিভিন্ন নতুন ধারণা যদি সফল নাও হয় এর ক্ষতি নেই। ব্যর্থ উদ্যোগ যেমন গুগল ওয়েভ, অর্কুট ইত্যাদির ও লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী আছে। তাই নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে এরা প্রচুর ব্যবহারকারীকে বেটা টেস্টিংয়ের জন্যে নিয়োগ করতে পারে (বিনে পয়সায়) এবং ফল আশানুরুপ না হলে সেটি বাদ দিয়ে নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করতে পারে।

দ্যা বিগ সুইচের লেখক নিকোলাস কার বলেছেন “গুগল চায় তথ্য প্রবাহ হোক বিনামূল্যে। কারণ যখন তথ্য পাবার মূল্য কমে যাবে এটি আরও বেশী পরিমানে আয়ের উৎস হবে তাদের জন্যে”।

ওয়ালমার্ট এবং এইচএনএমের মত ডিসকাউন্ট স্টোরের চাপে পিষ্ট ছোট ছোট স্টাইল বুটিকগুলো বর্তমানে নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহার করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যৎে গুগল সাম্রাজ্যের ফ্রির এই যথেচ্ছাচার মনোপলি ঠেকাতে সেরকম শৈল্পিক বুটিক বা ছোট নতুন ধারণার ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যায়গা করে নিতে পারবে কি না সেটি দেখার বিষয়।

পরবর্তী পর্বে থাকবে ফ্রি সংস্কৃতি এবং উদ্ভাবকদের কাজের মূল্য নিশ্চিত করা (ওপেন সোর্স, কপিরাইট/কপিলেফ্ট) ইত্যাদি

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Friday, September 10, 2010

ফ্রি মানে মাগনা নয় - পর্ব দুই

ফ্রি মানে মাগনা নয় - পর্ব এক

পর্ব: দুই

আগের পর্বে আলাপ করেছিলাম একবিংশ শতাব্দীর ফ্রি বা বিনে পয়সার ডিজিটাল পণ্যের ধারণা সম্পর্কে যা আমাদের ভবিষ্যতকে বদলে দেবে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত বলবে যাহ্ এটি কোন ব্যাপার হলো? আমরা তো দেখে আসছি ইয়াহু, জিমেইল ইত্যাদি বিনে পয়সায়ই পাওয়া যায়। আমরা ৫০ টাকায়ই সফ্টওয়ারের সিডি কিনতে পাচ্ছি - এ আবার নতুন কি? মাইক্রসফ্ট অফিস, ফটোশপ, বিজয় ইত্যাদি প্রপাইটরি সফ্টওয়্যার হলে কি হবে - এলিফ্যান্ট রোড থেকে কম্পিউটার কেনার সময়তো এগুলো সাথেই এসেছে। ইন্টারনেট থেকে র‌্যাপিড শেয়ার বা বিট টরেন্ট ব্যবহার করে গান বা মুভি ডাউনলোড করা যায় বিনামূল্যেই। আমার এগুলো সম্পর্কে জেনে কি হবে? - বিনে পয়সায় আর এগুলো পাব না?

ছবি: ফ্রি পিক্সেলসের সৌজন্যে

ফ্রি গেলানোর সংস্কৃতি:

গবেষণায় দেখা গেছে যখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে তখন তারা পণ্যের সুবিধাগুলোর দিকে বেশী মনোযোগী হয়। ইন্টারনেট থেকে আপনার পছন্দের গান বিনামূল্যে ডাউনলোড করা সম্ভব, যদিও আপনাকে এর জন্যে প্রচুর খুঁজতে হবে, র‌্যাপিড শেয়ার থেকে আধঘন্টায় একটি করে ডাউনলোড করতে পারবেন – ইত্যাদি নানা বাধা পেরিয়ে যেই এমপিথ্রি ফরম্যাটের গানটি পেলেন দেখলেন যে সেটার রেকর্ডিং ভাল না (সাউন্ড কম) এবং অ্যালবাম ইনফর্মেশনে ভুল আছে। আপনি যদি চাকুরিবিহীন শিক্ষার্থী হন তাহলে হয়ত আপনার এই এক-দুই ঘন্টার কষ্ট বেশ অ্যডভেঞ্চারের মতই মনে হবে। আপনার কাছে মাগনা পণ্য বেশী আকর্ষণীয় – কারণ আপনার সময় আছে অনেক এবং ক্রয়ক্ষমতা কম। কিন্তু এখন আই টিউন্স থেকে ৯৯ সেন্টে (ধরুন ৭০ টাকা) একটি গান ডাউনলোড করা যায় - কোয়ালিটি ভাল। আপনার যখন ক্রয়ক্ষমতা হবে এবং সময় থাকবে কম, তখন আপনি চিন্তা করবেন এই এক দুই ঘন্টা ব্যয় করলে ন্যূনতম মজুরী কত আপনাকে ছাড় দিতে হতে পারে এবং তার থেকে ৯৯ সেন্ট কম কি না। এবং তখন নিশ্চয়ই আপনি কোয়ালিটির উপর গুরুত্ব দেবেন।

এই ব্যাপারে একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেই। ১৯৯২ সালে মাইক্রোসফট চীনের বাজারে প্রবেশ করে এবং পাইরেসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। কিন্তু চাইনিজ সফ্টওয়্যার নকলবাজদের কাছে তাদের সিরিয়াল নম্বর, হলোগ্রাম, ওইএম কপি ইত্যাদি নানা বাধাদানকারী প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। ১৯৯৮ সালে বিল গেটস ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন: "যদিও চীনে প্রতিবছরে ৩০ লাখ পিসি বিক্রি হয়, তারা আমাদের আসল সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে না। অবশ্য তারা একদিন ব্যবহার করবে। তাই তারা এখন চুরি করতে চাইলে আমরা চুরি করতে দেব। তাহলে তারা আমাদের সফ্টওয়্যারেই মজে থাকবে। আমরা আগামী দশকের কোন এক সময়ে হয়ত কোন এক উপায়ে তাদের কাছ থেকে মূল্য আদায় করতে পারব।” এমনটি হয়ত মোস্তফা জব্বার তার বিজয় নিয়েও ভাবেন, তাই পাইরেটেড বিজয় সম্পর্কে কিছু না বলে অভ্রের পেছনে লাগেন।

এই তো সেদিন মাইক্রোসফ্ট প্রথমবারের মত এক চাইনিজ কোম্পানির বিরুদ্ধে পাইরেসীর মামলা করে জিতল। তাদের প্রচেষ্টা থাকবে চায়ের নেশা করিয়ে চা বিক্রি করে টাকা কামানো। চীন এখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। কম্পিউটারের দাম কমেছে - অনেকেই নেটবুক কিনছে ২৫০ ডলারের মধ্যে - আর মাইক্রোসফ্ট? তাদের অপারেটিং সিস্টেমের দাম পাঁচগুণ কমিয়ে ২০ ডলারে বিক্রি করছে। চীনারা তো পাইরেটেড উইন্ডোজেই এতদিন মজে ছিল –কাজেই এই বিশ ডলার খরচ তাদের কাছে কোন ব্যাপার না। পাইরেসী নির্ভরতা তৈরি করেছে এতদিন - ফলে এখন মাইক্রোসফটের অনেক বাজার বেড়েছে - কারন চীনের লোক কম নয় - ইকনমি অফ স্কেলের সুবিধা নেয়া যায় এখানে। আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে মাইক্রোসফ্ট ১০০০০ কম্পিউটার দেবে বলেছিল – এও সেই ডিজিটাল ঔপনিবেশিকতারই পরিকল্পনা।

শুধু ডিজিটাল পণ্যে নয়, চীন নকল করে না এমন কোন জিনিষ নেই। যেহেতু সস্তায় পাওয়া যায় তাই তারা ব্র্যাণ্ডের পণ্যই ব্যবহার করে (যেমন আমরা লিভাইসের জিন্স পাই এলিফ্যান্ট রোড থেকে)। কিন্তু বর্তমানে চীনাদের আয় বাড়ার ফলে অনেক নির্বাহী এখন সত্যিকারের ব্র্যান্ডের পণ্য কিনছেন। কেউ কেউ কয়েক মাসের বেতন একটি হাতব্যাগ বা স্যুটের পেছনে খরচ করে। ফলে নামী-দামী ব্র্যান্ডের বাজার কিন্তু কমছে না। ফ্যাশন জগতে সব সময় নতুন সীজনের পণ্যকে তুলে ধরা হয়। পুরোনো বছরের পণ্যের প্রতি লোকজনের আগ্রহ কমে যখন এটি পাইরেটেড হয়ে যায় বা কম মূল্যে ব্যাপক উৎপাদন করে বাজারে ছাড়া হয়- অর্থাৎ আর এক্সক্লুসিভ থাকে না। ফলে যাদের টাকা আছে তারা নতুন মডেলের কাপড়ের দিকে ছোটে - এটাও বাণিজ্যেরই একটি মডেল।

চীনের মত যখন আমাদের দেশেও যখন লোকের আয় বাড়বে তখন আমরাও পয়সা দিয়েই এক্সক্লুসিভ সফ্টওয়্যার বা পণ্য কিনব।

ফ্রি অর্থনৈতিক মডেল:

ডিজিটাল জগৎের নতুন এক ধারা তৈরি হচ্ছে যা বলছে যে কোন সফ্টওয়্যার তৈরি হলে এটি কোন এক পর্যায়ে এসে বিনে পয়সায় হয়ে যাবে, এর প্রান্তিক খরচ এবং বিক্রয়মূল্য উভয় ক্ষেত্রেই। এটি কোটি কোটি টাকার একটি অর্থনীতি তৈরি করছে - এবং এই প্রথম যার প্রাথমিক মূল্য হচ্ছে শূণ্য।



লেখক ক্রিস অ্যান্ডারসন। ছবি ছবি উইকিমিডিয়া কমন্সের সৌজন্যে

ক্রিস এন্ডারসনের মতে অ্যাটম অর্থনীতি - অর্থাৎ আমাদের চারপাশের ভোগ্যপণ্যের মূল্য প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। অথচ অনলাইন জগৎ নিয়ে গঠিত বিটস অর্থনীতিতে জিনিষের মূল্য প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। বিংশ শতাব্দী ছিল মূলত: একটি অ্যাটম অর্থনীতি এবং একবিংশ শতাব্দিতে বিটস অর্থনীতি গেড়ে বসছে।
অ্যাটম অর্থনীতিতে সব বিনামূল্যের পণ্যই পাওয়া যায় অন্য পণ্যের জন্যে ক্রয়মূল্য প্রদান করে সরাসরি বা অন্য কোন ভাবে। অথচ বিটস অর্থনীতিতে পণ্য সত্যিকারের ফ্রি হতে পারে, যেখানে ভোক্তা ও ক্রেতার মধ্যে টাকার ব্যাপারটি উল্লেখিত হয় না। অ্যাটম অর্থনীতিতে মানুষরা সন্দেহপ্রবণ থাকে যে কোথায় লুকানো খরচ আছে। ঐদিকে বিটস অর্থনীতিতে থাকে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক যে কখনও লুকানো খরচ থাকবে না। অনেক শোনা গিয়েছিল যে হটমেইল ব্যবহার আর বিনামূল্যে থাকবে না - তবে সেরকম কিছু হয় নি এখনও – তাই ধরে নেয়া যায় যে এটি বিনামূল্য থাকবে।

অনেক নতুন ব্যান্ড এখন তাদের গান বিনামূল্যে ইন্টারনেটে প্রকাশ করে। তাদের উদ্দেশ্য গানকে অনেক শ্রোতার কাছে
পৌঁছে দেয়া এবং অনেক ভক্ত তৈরি করা। জনপ্রিয়তা পেলে তারা পরে ঠিকই আয় করতে পারে রেকর্ড লেবেল বা কনসার্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অল্টারনেটিভ রক ব্যান্ড রেডিওহেড তাদের ৭ম অ্যালবাম 'ইন রেইনবোজ' এর ডিজিটাল ডাউনলোড বের করে এক অভিনব শর্তে যে এর মূল্য তাদের ভক্ত শ্রোতারাই ঠিক করবেন। অর্থাৎ আপনার পয়সা না থাকলে বিনামূল্যেই পেতে পারেন। মূল ব্যাপারটি হচ্ছে ডিজিটাল পণ্যের বিপণন ও সরবরাহ (প্যাকেজিং) খরচ শূন্যের কোঠায় কাজেই বিনামূল্যে পণ্য সরবরাহে খরচ ন্যূনতম। তাদের ব্যান্ড ম্যানেজার জানায় যে যদিও কেউ কেউ বিনামূল্য বা এক পেনিতে এটি কিনেছে - বেশীর ভাগই ক্রয় ক্ষমতাসহ ক্রেতা এবং তারা বাজার মূল্যে পরিশোধ করেছে।

ছবি: ফ্রি পিক্সেলসের সৌজন্যে

এই ফ্রিকোনমিক্স বা বিনামূল্যের সংস্কৃতি বেড়ে উঠেছে ডিজিটাল যুগের প্রযুক্তির কল্যাণে। মুর'স ল অনুযায়ী প্রতি দুই বছরে কম্পিউটারের প্রসেসিং পাওয়ারের উৎপাদনমূল্য কমে আসে অর্ধেক দামে এবং ব্যান্ডউইদথ আর হার্ডডিস্কের ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদনমূল্য কমছে আরও দ্রুত হারে। ইন্টারনেটের পণ্যগুলোর খরচের ব্যাপারে এই সবগুলোর সমষ্টি কাজ করছে অর্থাৎ এর মূল্যহ্রাস হচ্ছে বছরে ৫০% হারে - সহজ করে বললে - ইউটিউবের একটি ভিডিও প্রচার করতে আজকে তাদের যা খরচ হচ্ছে আগামী বছর এর অর্ধেক খরচ হবে। এই দাম কমার ধারায় সবারই একই লক্ষ্য প্রান্তিক উৎপাদন ও ক্রয়মূল্য শুণ্যতে নিয়ে যাওয়া। ফলে ইউটিউব বিনা পয়সায় সেবা রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে এবং বেশী ব্যবহারকারী যোগ দিয়ে কোম্পানির নতুন আয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।

আজকালকার অভিনব সব অনলাইনের ব্যবসায়িক ধারণার মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে বিনামূল্যের পণ্যের মাধ্যমে আয়ের চেষ্টা করা। আপনি সত্যি বিনামূল্যে পণ্য বিক্রি করে আয় করতে পারেন। অনেক সময় আপনি যা বিলিয়ে দিচ্ছেন তার বিনিময়ে আরও অনেক বেশী পাচ্ছেন। কেন এমন হয়?

মুফতে জিনিষের ধারণাটি পুরোনো, কিন্তু এটি এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে আমাদেরকে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও আচার ব্যবহার ও অর্থনৈতিক প্রণোদনার উপর কিছু মৌলিক ধারণা সম্পর্কে পুনরায় ভাবাচ্ছে। মুস্তফা জব্বারের বিজয় সফটওয়্যারের মত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারন তাদের ইতিমধ্যে এই সব বিনামূল্যের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে।

ফ্রির যে বিভিন্ন রকম নমুনা আমরা চারিদিকে দেখতে পাই তা থেকে এর মানে অনেক রকম হতে পারে:

  •  ফ্রি মডেল ১ - একটি কিনলে একটি ফ্রি মানে হচ্ছে ৫০% মূল্যহ্রাস, একটি পণ্যের সাথে আরেকটি পণ্য ফ্রি হচ্ছে একদিক দিয়ে মূল্যহ্রাস এবং অন্যদিক দিয়ে বিপণন – অর্থাৎ আদতে এগুলো বিনামূল্যের নয়।
  • ফ্রি মডেল ২ - ফ্রিমিয়াম মডেল - কিছু সফটওয়্যার আছে - মৌলিক বা ট্রায়াল সংস্করণগুলো ফ্রি থাকে - কিন্তু কিছুদিন পরে কিনতে হয় বা সব ফিচার ব্যবহার করতে গেলে টাকা দিতে হয় – এগুলোকে ঠিক ফ্রি বলা যায় না।
  • ফ্রি মডেল ৩ - আপনি বিনামূল্যে সেবা ব্যবহার করলেন - এবং সাইটে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটির খরচ বহন করলেন - যত বেশী ব্যবহারকারী - তত বেশী বিজ্ঞাপন থেকে আয় এবং আরও ব্যাপক সেবা দান। তারপরে রয়েছে বিজ্ঞাপনের প্রচার মাধ্যম। অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞাপনের ভর্তুকি টিভি অনুষ্ঠান বা সংবাদপত্রকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে সাহায্য করছে। এই মডেলের প্রথম প্রয়োগ হয়েছে শত বছর আগে - কাজেই এটাকেও নতুন ধারণা বলা যাবে না।
  • ফ্রি মডেল ৪ - গিফট ইকোনমি (দানের অর্থনীতি) - একটি সেবা প্রদান করে মনযোগ আকর্ষণ এবং অন্যভাবে খরচের টাকা যোগানো - এ বিষয়ে পরের পর্বে বিস্তারিত বলব।
ছবি: ফ্লিকার থেকে এনিক্সির সৌজন্যে। সিসি - বাই লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত

তাহলে নতুন ধারণাগুলো কি যেগুলো সত্যিই বিনা মূল্যে পাওয়া যায়? ফ্লিকারের কথাই ধরুন –- বেশীর ভাগ ব্যবহারকারীদের জন্যেই এ ছবির সাইটটি ফ্রি (পেশাজীবি সংস্করণ ছাড়া) এবং এরা বিজ্ঞাপনও নেয় না। গুগলের সেবাগুলোরও বেশীরভাগই বিনামূল্যে - এবং বিজ্ঞাপন বিহীন বা তারা তাদের বিজ্ঞাপন মডেল একটি নতুন ধারণার উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এর পরে রয়েছে ব্যবহারকারী দের সাহায্যে (ক্রাউডসোর্সিং) প্রতিষ্ঠিত উইকিপিডিয়া এবং ব্লগ প্লাটফর্মগুলো। এদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে মূল্যের বিনিময়ে পরিমাপযোগ্য নয় এমন সব প্রণোদনা: জনপ্রিয়তা, বিশ্বস্ততা, বাক স্বাধীনতার প্রকাশ ইত্যাদি।

এই যেসব ফ্রিকোনমিক্স মডেলের কথা বললাম সবগুলোরই মধ্যে মিলে যায় একটি বিষয় –যে তারা অর্থকে স্থানান্তরিত করে পণ্য থেকে পণ্যে, ব্যবহারকারী থেকে ব্যবহারকারীর কাছে, বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎে - অথবা ভোক্তা বাজার থেকে অর্থবিহীন প্রণোদনার বাজারে । অর্থনীতিবিদরা একে বলে ক্রস সাবসিডিজ।

ক্রস সাবসিডিজের মূল বিষয় হচ্ছে যে আসলেই কোন ফ্রি লাঞ্চ নেই। আপনাকে যেই সাবসিডিজ দেয়া হচ্ছে সেটা অবশ্যই অন্য কারও কাছ থেকে আদায় করা হবে যারা বেশী মূল্য দিতে প্রস্তুত। আমি রায়ান এয়ারে বার্লিন থেকে রোমে গিয়েছি ৪০ ইউরো রিটার্ন টিকিটে (মূল টিকেট ছিল ১ ইউরো যাওয়া, ১০ ইউরো আসা এবং বাকিটা ট্যাক্স এবং অন্যান্য - চোখ ঘুরে যাবার মত ভাড়া, কারণ বাড়ী থেকে বার্লিন শোনেফেল্ড বিমান বন্দরে ট্যাক্সি করে যেতে লাগে ৩৫ ইউরো)। কেবিন লাগেজ ছাড়া আলাদা চেক ইন লাগেজ নিলে ২০ ইউরো বেশি। প্লেনে খাওয়া দাওয়া করলে ১৫ – ২০ ইউরো। বার্লিন থেকে রোমের প্রতিটি সিটের খরচ নাকি ৭০ ইউরো রিটার্ন অর্থাৎ রায়ান এয়ারের আদতে লস নেই। মাস দুয়েক আগে টিকেট কিনেছে এমন বিশ থেকে পঞ্চাশজন হয়ত এমন কম ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পেরেছে। যারা ১ দিন আগে টিকেট কিনেছে তাদের জন্যে এক মুখী ভাড়া ১২০ ইউরো। অর্থাৎ যার প্রয়োজন আছে সে ছয়গুণ বেশী দিচ্ছে - এই হচ্ছে ক্রস সাবসিডিজের মডেল।

পরবর্তী পর্বে থাকছে:

গিফট ইকোনমি ও গুগলের ডিজিটাল পণ্য বাণিজ্য

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Wednesday, September 08, 2010

ফ্রি মানে মাগনা নয় - পর্ব এক

নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশে ইন্টারনেট যখন এল তখন এটি ছিল খুবই একটি খরুচে প্রযুক্তি। মাইক্রোসফ্ট অফিস/উইন্ডোজ সহ দামী কম্পিউটারের সাথে আট হাজার টাকা দিয়ে মডেম কেন, ইমেইলের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আইএসপির ডায়ালআপ অ্যাকাউন্ট খোল - ইত্যাদি - এর সাথে সাথে ফোন বিল ও আইএসপির মিনিট প্রতি চার্জের ব্যাপারটি তো ছিলই। কিন্তু আজকের কথা চিন্তা করুন, ফোনেই থাকে মডেম আর বাংলাদেশে ৩০০ টাকা দিলে মোবাইল ইন্টারনেটের বেসিক প্যাকেজ পাওয়া যায়। ইমেইলের জন্যে তো কোন টাকা দিতে হয় না, জিমেইল হটমেইল ইত্যাদি প্রচুর স্টোরেজসহ ব্যবহার করা যায় মাগনা। লিনাক্স তো আছেই, সফ্টওয়্যারের মধ্যে ওপেন সোর্সের কল্যাণে অভ্র, ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশীট ইত্যাদি মায় অ্যান্টিভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যে - এবং পাইরেটেড সফ্টওয়্যার ব্যবহার করার গ্লানিটুকু নেই মনে।

শুধু তাই নয় আজকাল ফেসবুক, অর্কুট ইত্যাদি সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট, মাইক্রোব্লগিং এবং ব্লগিং সাইট সবই বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। অনেক বাংলা প্লাটফর্ম বের হয়েছে যার তৈরির জন্যে বেশ অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয় বা হচ্ছে কিন্তু তাদের অনেকেই কোন বিজ্ঞাপন বা অন্য কোন ভাবে আয়ের উপায় রাখেনি।


আমাদের মনে তাই মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয় যে এই নতুন মাগনা সংস্কৃতি, মাগনা অর্থনীতির স্বরূপটি কি? কিভাবে সম্ভব হচ্ছে বিনেপয়সায় এত সব সেবা পাওয়া যেখানে পূর্বে এত খরচ করতে হত?

এই বিষয়টি নিয়ে প্রথম পড়ি ওয়াইয়ার্ড ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ক্রিস অ্যান্ডারসনের একটি সম্পাদকীয়তে। তিনি এ নিয়ে 'ফ্রি' নামে একটি বইও প্রকাশ করেন গত বছর। সেটির অডিওবুকটি ডাউনলোড করে এবং এ বিষয়ে আরও কিছু পড়াশোনা করার পর মনে হল এ নিয়ে কিছু লিখলে মন্দ হয় না। পড়ার সুবিধার্থে এ সিরিজটি বেশ কয়েক পর্ব নেবে।

ফ্রির একাল এবং সেকাল

ফ্রি বা বিনেপয়সায় কথাটির মানে আমরা সবাই জানি কিন্তু এই শব্দটির যথেচ্ছা ব্যবহার মাঝে মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা রহস্যেরও সৃষ্টি করে। আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে কোন কিছু বিনেপয়সায় পাওয়ার মানে একরকম ছিল আর বর্তমান কালে ফ্রির মানে আরেক রকম। এই ব্যাপারটি অনেকেই খেয়াল করে না। আজকালকার দিনে কেউ কোন কিছু বিনেপয়সায় দিয়ে দিলে দেখতে হবে এর সাথে কি কি শর্ত জড়িয়ে থাকতে পারে, আবার হয়ত নাও পারে। ফ্রি লাঞ্চ বলে এমন কিছু নেই এই কথাটির মর্ম পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন ফ্রি লাঞ্চ খাওয়ালে হয়ত আপনি দ্বিগুণ ভাবে আপনার টাকা ফেরত পেতে পারেন, এবং অবশ্যই যাকে খাওয়াচ্ছেন তার থেকে না, অন্য কারও কাছ থেকে, অন্য কোনো ভাবে।

এই ফ্রি পণ্য বিপণন জগতের অংশ হবার পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দিতে শুরুর দিকে কিং জিলেট ডিসপোজেবল দাড়ি কামানোর ব্লেড উদ্ভাবন করলেন এবং তা বাজারজাত করা শুরু করলেন। ১৯০৩ সালে প্রথম বছর তার বিক্রি হল ৫১টি রেজর এবং ১৬৮টি ব্লেড। এতে দমে না গিয়ে কিন্তু পরের দুই দশকে তিনি লক্ষ লক্ষ রেজর এবং ব্লেড বিক্রি করলেন তার নতুন ধারণা কাজে পরিণত করে। কি সেই যুগান্তকারী ধারণা? তিনি নামমাত্র মূল্যে লক্ষ লক্ষ রেজর বিক্রি করলেন –- রেজর বিনামূল্যে দেয়া হতে লাগল অন্যান্য পণ্যের সাথে - যেমন কফি, মশলা ইত্যাদি। ফলে তিনি কয়েকগুণ পরিমাণ ব্লেডের চাহিদা উৎপন্ন করতে পারলেন যা তার কোম্পানিকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেল।
এই মডেলটি এখনও সারা বিশ্বে প্রযোজ্য - ফোন ১ ইউরোতে দেয়া হয় দুই বছরের নির্দিষ্ট পরিমাণ ন্যূনতম ব্যবহারের শর্তে যার মাধ্যমে ফোনের দাম উঠে যায়। ভিডিওগেমের কন্সোলের মূল্য কম রাখা হয় এবং পরে ভিডিও গেমের উচ্চ মূল্য তা পুষিয়ে নেয়।

জিলেটের কল্যাণে এই ধরণের ফ্রি পণ্যের ধারণা মানুষের কাছে আর নতুন নয়। আপনি একটি কিনলে একটি ফ্রি পাবেন - অর্থাৎ শর্ত একটি থাকছেই। কারণ ওই বিনামূল্যের জিনিষটি আরেকটি নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে। ফ্রি শব্দটির অনেক প্রভাব আছে ভোক্তার মনস্তত্বের উপরে, এটি নতুন বাজার সৃষ্টি করতে, পুরোনো বাজার সম্প্রসারণে এবং পণ্যের প্রচারে সাহায্য করে। অর্থাৎ আদতে ফ্রি মানে লাভহীন নয়।

তবে গত দশকে আর এক ধরণের ফ্রি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতির মূল ধারনা বেড়ে উঠেছে একাধিক মূল্যসহ ও মূল্যহীন পণ্যের মধ্যে সম্পৃক্তির ধারনা ছাপিয়ে - অর্থাৎ পণ্যের মূল্য এত কমে গেছে যে সেগুলো সত্যিই বিনেপয়সায় দিয়ে দেওয়া যায় এবং হয়তোবা একটি নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা যায়। কী, গোলমেলে লাগছে?


চার্ট: স্টিভেন লেকার্ট আর নিকোলাস ফেলটন

এই গুগল সংস্কৃতির কথাই চিন্তা করুন, ডিজিটাল জগৎে আমরা এখন অনেক কিছুই ফ্রি পেতে অভ্যস্ত। মনে আছে বছর তের আগে আইএসএনের ডায়ালআপ কানেকশন নেবার সময় প্রথম ইমেইল অ্যাকাউন্ট হয়েছিল আমার। উচ্চ সংযোগ মূল্য তো ছিলই তখন ফোনের বিল ইন্টারনেট মিলিয়ে প্রচুর খরচ হত সেটি ব্যবহার করতে। এখন বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে হয়ত ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায় যেটা ব্যবহার করে আমার জিমেইল আর হটমেইলের মেইল চেক করে নেই। দুটোর কোনটির জন্যেই টাকা দিতে হয়নি এখন পর্যন্ত, আবার জিমেইলের জিটক আমেরিকা আর কানাডার ফোন নম্বরে বিনে পয়সায় কথা বলার সুযোগও করে দিল বিনেপয়সায় -– কোথায় রাখি এ আনন্দ! সবই ফ্রি।

তবে আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে যে গুগল কীভাবে চলে? তার আয়ের উৎস অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং আরও নানা কিছু - সে বিষয়ে পরে আসছি - কিন্তু জেনে রাখুন গুগল কিন্তু সরাসরি আপনার কাছে এই বিনেপয়সার সেবার জন্যে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করছে না (তাদের পণ্য আছে ঠিকই – - গুগল প্রিমিয়াম ভার্সন ইত্যাদি)।

এ অবস্থায় আসতে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্যে যেতে হয়েছে এই অনলাইন ইন্ডাস্ট্রিকে। অনেকদিন মূল্য প্রদান সাপেক্ষে সাবস্ক্রিপশনের ব্যবস্থা রাখলেও ২০০৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তার অনলাইন ভার্সন উন্মুক্ত করে দেয় এবং পাঠকরা এখন বিনে পয়সায় পড়তে পারে। এটাই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।

ক্রিস এন্ডারসন তার ফ্রি নামক বইতে বলেছেন যে একবিংশ শতাব্দীর ফ্রি হচ্ছে নতুন ধরনের ফ্রি, এবং এই ধারণাটি আমাদের ভবিষ্যৎকে বদলে দেবে। বর্তমানের বিনে পয়সার ধারণাটি কোন লুকানো পণ্য বিক্রি করার ধারণা নয় বরং এক পকেট থেকে আরেক পকেটে টাকা স্থানান্তরের একটি উপায় আপনার কাছ থেকে সরাসরি কোন সুবিধা না নিয়ে। এটি একটি পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক মডেল।

পরবর্তী পর্বে থাকছে ফ্রির অর্থনৈতিক মডেল।

ছবি: মার্কো মলিনারির সৌজন্যে, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত।

Wednesday, July 07, 2010

বন্ধু বিনে

টিএসসি

আমার পাঁচ বছরের প্রবাস জীবনে যে ব্যপারটি বুঝেছি তা হচ্ছে বন্ধুর উপস্থিতির চাইতে তার অনুপস্থিতি বেশি উপলব্ধি করা যায়। আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বন্ধু, সহপাঠী বা সহকর্মীর যেরকম একটি স্থান আছে আমাদের জীবনে, জার্মানীতে গিয়ে বুঝলাম যে সেখানকার সমাজ ভিন্ন। দুই মাস একসাথে যাদের সাথে ইন্টার্নশিপ করেছি, কফি ও লান্চের সময় কাটিয়েছি অনেক গল্প করে, ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছি তাদের সাথে কোনও যোগাযোগ থাকবে না পরবর্তীতে? বিদায় নেবার সময় সবাই ফোন নম্বর, ইমেইল বিনিময় করলাম। সেটাই ছিল শেষ যোগাযোগ। পিটার আসত দেড়শত কিলোমিটার দুরে পোলিশ বর্ডারে অবস্থিত ফ্রান্কফুর্ট (ওডার) থেকে। পরে একবার সে শহরে যখন গেলাম, তাকে ফোন দিলাম। ভেবেছিলাম, তার সাথে সম্ভব হলে দেখা করব। কিন্তু ফোনে কথা বলার পর তার আগ্রহ দেখিনি। হয়ত আমার আগেই জানানো উচিৎ ছিল - কারণ কাজের সময় ছুটি নেয়ার ব্যাপার আছে - অথবা হয়ত আমিই কারণ। এরপর নিজেকেই গুটিয়ে নিয়েছি।

কিন্তু বন্ধু বিনে জীবন কি পরিপূর্ণ হয়? তাই প্রবাসে ভরসা ছিল ফোন। ঢাকার যে বন্ধুর সাথে একদিন দেখা বা কথা না হলে মনে হত কি যেন অপূর্ণ রয়ে গেছে সে বন্ধুর সাথে কথা বলা হতো প্রথমদিকে মাসে- দুইমাসে একবার করে। তারপর একসময় দুরত্ব বাড়তে লাগল সমস্ত বন্ধুদের সাথে। ততদিনে ব্লগের মাধ্যমে অনেক পরিচিতি বাড়ল। অনেকের সাথে অনলাইনে ভাল সখ্যতাও হল। এখনতো এমন হয় কোন নতুন শহরে গেলে আগে পরিচিত ব্লগার খুঁজি। দুরের আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হবার বদলে তাদের সাথে দেখা করাটাকেই গুরুত্ব দেই। কারণ মনে হয় যে বন্ধুত্বের জন্যে মনটি হাহাকার করে।

এখন ফেসবুকের কল্যাণে বন্ধু কথাটার মানে পাল্টে যাচ্ছে। ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা এখন স্ট্যাটাস সিম্বলে পরিণত হয়েছে। আমরা সগর্বে ঘোষণা দেই আমাদের বন্ধু সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে এবং মুখিয়ে থাকি ওবামা, তসলিমার মত নামি দামীদের (আসল বা নকলের ধার ধারি না) বন্ধুর তালিকায় যোগ করতে। কারো সাথে এভাবে পরিচিত হতে যাই: জানেন আমি না আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড, আপনার ওই স্ট্যাটাসটা না চমৎকার! -ওহ! তাই নাকি (চূড়ান্ত বিস্ময়)!

বন্ধুত্ব একটি খুব সহজ কথা, সহজেই ব্যবহার করা যায়। প্রতিদিন আমরা হরে দরে এই শব্দটি ব্যবহার করি। তবে বন্ধুত্বের আসল মানে, আসল গভীরতা এই শব্দটিতে ধরা দেয় না। আমাদের জীবনে অনেকের সাথেই মেলামেশা হয়। কিন্তু আসল বন্ধু হয় কজন?

আরেকটি ব্যপার হল বন্ধুত্ব আসলে শিল্প বা দার্শনিকতার মত নির্দিষ্ট কোন বিষয় নয়। আপনি একে কোন সংজ্ঞায় ফেলতে পারবে না বা এর নেই কোন নির্দিষ্ট পরিমাপযোগ্য সার্থকতা। অথচ জীবনকে সার্থক করতে একটি ভাল বন্ধুত্বই যথেষ্ট। বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা হল যে বন্ধুত্বের কোন বাহ্যিক প্রদর্শন ছাড়া একসাথে থাকতে পারা - কারণ জীবনের ছোটখাট বিষয়ও তাদের সাথে উপভোগ করা যায়। আসল বন্ধুত্ব তড়িৎ যোগাযোগ বা স্বল্প পরিচয়ের কোন ব্যাপার নয়, একে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে পোক্ত হতে হয়। আমাদের পরিচিতদের মধ্যে থেকে অনেকের নামই আমরা স্মরণ করতে পারি না। আবার অনেকে আমাদের জীবনে গভীরভাবে দাগ কাটে - তাদের সাথে কথা বলতে - একসাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি - সেটাই বন্ধুত্ব।

ফেসবুক সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান হলেও আমি কিন্তু একে খুবই উপযোগী একটি টুল হিসেবে দেখি। ফেসবুকের কল্যাণে আমি আমার দুরে সরে যাওয়া অনেক বন্ধুদের সাথে পুন:যোগাযোগ করতে পেরেছি। আমার নিত্য যোগাযোগের যেই বন্ধুটির কথা আগে বললাম সে কম্পুকানা হওয়ায় অনেকদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর এখন সে আইফোনে ফেসবুকে ঢুকে - তাই প্রায়ই টুকটাক কথা হয়। ছবি দেখে মাপা হয় কার কত ভূরি বেড়েছে। ফেসবুক তোমাকে সালাম।

আমাদের সাংস্কৃতিক দলটির কাজের খবর পাই ইয়াহু মেইলিং লিস্ট থেকে। আমি দুরে থেকেও সব সংবাদ পাই বন্ধুদের - বিয়ে-সন্তান-মৃত্যু। প্রযুক্তি আমাদের সাহায্য করে সেই পুরোনো বন্ধুত্বের ছোঁয়া দিতে।

টিএসসি

সম্প্রতি দেশে গিয়েছিলাম এবং কিছু পুরোনো বন্ধুদের সাথে আবার অনেক অনেক দিন পরে দেখা হল টিএসসিতে। নব্বুই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমরা যখন টিএসসি দাপিয়ে বেড়াতাম সে সময়ের সাথে এখন কতটুকু পরিবর্তন এসেছে সেটি দেখার আগ্রহ ছিল সবার। এখন টিএসসির প্রবেশ পথে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে তরুণেরা (কারণ বিনামূল্যে ওয়াইফাই ইন্টারনেট) - তবে ভেতরে সেই চিরচেনা জড় হয়ে বসা আড্ডা - কারও সাংস্কৃতিক চর্চা। আমাদের জীবনে এতদিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দুই বন্ধুর বিয়ে হয়ে বাচ্চা হবার পর তাদের ছাড়াছাড়িও হয়ে গেল। অনেকদিন পরে আবার তারা একসাথে একই আড্ডায়। ফিরে গিয়েছিলাম সেইসব দিনগুলোতে। চাকুরী- বিয়ে- বাচ্চা সহ নানা বিষয় নিয়ে আলাপের মধ্যে সেইসব দিনের স্মৃতি রোমন্থন - কিভাবে আমরা রোজার সময় রাত করে রিহার্সেল শেষ করে শাঁখারীবাজারে সোমদার বাসায় সারারাত কির্তন শুনে ভোরবেলায় হোটেলে সেহেরি খেয়েছিলাম। মাস্টারকার্ডের বিজ্ঞাপনের মত করে বলি - প্রাইসলেস।

প্রবাস জীবনে এই সুখ নেই। দেশে অনেকদিন থেকে যাদের জীবনের পরবর্তী সময় প্রবাসে কাটে, তাদের সেখানে অনেক চেনামুখ জোটে, বন্ধু জোটে না। বন্ধুদের জন্যেই ফিরে আসতে হয় স্বদেশ।

প্রথম প্রকাশ: আমরা বন্ধু

Wednesday, June 16, 2010

কেনিয়ার কবি

আজকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব কেনিয়ার নতুন প্রজন্মের এক কবি ও জনপ্রিয় ব্লগারকে। সাথে বোনাস হিসেবে থাকছে তার একটি কবিতার অনুবাদ।

এবার চিলিতে গ্লোবাল ভয়েসেস নাগরিক মিডিয়া সম্মিলনে জড়ো হয়েছিল বিশ্বের ৬০টিরও অধিক দেশের দেড় শতাধিক ব্লগার। এবার কলেবর বিস্তৃত হওয়ায় সম্মিলনের সময় অনেক নতুন মুখের সাথেই সৌজন্য বিনিময়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আলাপ করার তেমন সুযোগ হয়নি। এদের অনেকেরই সাথে পূর্বে ইমেইলে যোগাযোগ রয়েছে - অনেকের লেখাই পড়েছি বা অনুবাদ করেছি আগে - তাই কারও কারও সাথে পরিচিত হবার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এদেরই একজনের কথা বলছি আজ আলাদা করে।

কেনিয়ার কবি এনজেরি ওয়াঙ্গারিকেনিয়ার কবি এনজেরি ওয়াঙ্গারি
একদল লোকের ভীড়ে ২৮ বছর বয়সী কেনিয়ার তরুণী এনজেরি ওয়াঙ্গারিকে আলাদা করে চেনা যায়। পরনে তার আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং মাথায় কাপড় বাঁধা। এনজেরি একজন আইটি গ্রাজুয়েট এবং একটি পাবলিশিং হাউজের সিস্টেম এডমিনিষ্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছে। পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ হলেও তার মূল পরিচয় সে কবি, আবৃত্তিকার এবং ব্লগার। আফ্রিকার ব্লগ এগ্রেগেটর - আফ্রিগেটর অনুযায়ী তার ব্লগ কেনিয়ান পোয়েট কেনিয়া ও সারা আফ্রিকার জনপ্রিয় ব্লগগুলোর একটি। গ্লোবাল ভয়েসেসে সে কেনিয়া এবং আফ্রিকার কাব্যসাহিত্য এবং শিল্প বিষয়ে ব্লগগুলো নিয়ে লিখে থাকে

এনজেরির কবিতার সাথে ভালবাসা ২০০৪ সাল থেকে। তার প্রেমিকের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল - এমন টালমাটাল সময়ে ভাবল সে তার অনুভূতিগুলো লিখে রাখলে কেমন হয়। এভাবেই কবিতা লেখার শুরু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল যে কবিতার খাতাগুলো নিজের কাছেই রয়ে যাচ্ছিল - সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছিল না তাই অন্য কবি বা পাঠকের কাছে পৌঁছুচ্ছিল না। ২০০৬ সালে শুরু করা তার ব্লগ কেনিয়ান পোয়েট পাঠকদের সাথে সেই দুরত্ব ঘুঁচিয়ে দেয় কিছু পরিমাণে। প্রথমে সে তার কবিতা প্রকাশ করে জানার চেষ্টা করত কিভাবে পাঠকরা সেগুলোকে দেখছেন, সমালোচনা করছেন বা অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। শুধু কবিতাই নয় তার ব্লগে পরবর্তীতে সে শিল্পকলা, সঙ্গীত, সমালোচনা ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করে।

এছাড়াও তার রয়েছে একটি শক্তিশালী কণ্ঠ। পারফর্মেন্স পোয়েট্রির চল রয়েছে কেনিয়াতে - এমনকি এখন কর্পোরেট অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে কবিদের। চারজন কেনিয়ান কবির সঙ্গে এনজেরি গঠন করেন আবৃত্তি দল মেসতারিওয়ান্নে এবং তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত তাদের কবিতা পরিবেশন করছেন বছর দুয়েক ধরে। তার সহকবি মাইক কোয়াম্বোর বিপ্লব নামক কবিতা পড়লে বোঝা যায় তাদের প্রতিভার ছটা। এনজেরিকে এখন কেনিয়ার অন্যতম নতুন প্রজন্মের কবি বলে ধরা হয়।

মূল সম্মিলনের শেষের দিনে সে একটি কবিতা পড়ে শোনায়। এখানে ভিডিওটি আছে (অ্যামেচার ভিডিও - তাই সাউন্ড একটু জোরে দিতে হবে):



ইংরেজী ভাষায় লেখা 'ডিজিটাল হৃদয়' নামে সেই কবিতাটি এখানে পাওয়া যাবে
আমি এর অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি:

****************************************

'ডিজিটাল হৃদয়' 

- এনজেরি ওয়াঙ্গারি

এক সময় ছিল যখন মুখ, চোখ, কান, একটুকু ছোঁয়া
গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি কথোপকথন চালানোর জন্যে,
মানুষেরা একে অপরের বা প্রকৃতির অনেক কাছে ছিল
দেখা, শোনা, ছোঁয়ার মাধ্যমে।


এক ঝাক অতিথি পাখির দেখা পাওয়া মানে ছিল ঝড়ের পূর্বাভাষ,
হয়ত ঋতু পরিবর্তনের চিহ্ন বা কোন বিপদ সংকেত।
বাতাসে উদ্বেলিত বৃক্ষরাজির মৃদু স্বরে ফিসফাস
আমাদের মনে শান্তি এনে দিত।


গাছের ডালের সশব্দে ঝরে পড়া, পাখির কলতান
আমাদের আত্মার সাথে বাস্তবের প্রেমবন্ধন তৈরি করত।

এখন সামনা সামনি দেখা হওয়ার বদলে আমাদের দেখা হয় ফেসবুকে
আমাদের স্বর এখন বোতাম যা থেকে আমরা শব্দ বের করি কীবোর্ডে চেপে
আমাদের হাসি আর আবেগ প্রকাশিত হয় স্মাইলি আর ইমোটিকনের মাধ্যমে
হৃদয় আর আমাদের ঠোঁটকে অস্থির করে তোলে না "ভালবাসি" বলার জন্যে
কারণ হৃদয় ও মনের ভাব প্রকাশ করি আমরা ক্ষুদ্র টেক্সট বার্তার মাধ্যমে
বলে বোঝাতে পারি আমাদের মনের কথা ১৬০ বর্ণের ভেতরে।


দরকার নেই আর হৃদয় দিয়ে আবেগময় কণ্ঠে অগণিত বাক্যে অনুনয়
আমাদের আঙ্গুলগুলো এখন সেইসব আবেগ ধারণে সক্ষম যেগুলো
আমাদের ঠোঁট, আঁখি এবং বদনের মাধ্যমে একটি বইয়ে ধারণ করা যেত না।
এইসব শীতল মেশিন আমাদের আচরণকে যান্ত্রিক করে দেয় রোবটের মত
শুধু এটুকুই প্রভেদ যে রোবটের সামনে থিতু হয়ে বসে থাকি আমরা।


আমরা ডিজিটাল বিশ্বের কাছে আমাদের জীবন, মুহূর্ত এবং আত্মাকে বিকিয়ে দিচ্ছি।
সেইসব অচেনা মানুষ যাদের হয়ত কোনদিনই বাড়িতে আমন্ত্রণ করতাম না,
তারা এখন আমাদের খাটের নীচে উঁকি দেয়, আমাদের বাথরুমের ভেতরে তাকায়
আর আমাদের পোশাক উন্মোচন করে দেখে।
আমাদের নিয়ে কল্পনার ফানুশ ওড়ায়, স্বমৈথুন করে
এবং আমাদের ডিজিটাল পরিচয়কে ক্রমাগত অনুসরণ করে।


মাছিকে মরণ আলিঙ্গনে জড়ায় যেই মাকড়সার জাল তারই মত
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জালে আমরা নিজেদের জড়িয়েছি।
বিট এবং বাইট দ্বারা সংযুক্ত এই পৃথিবীতে আমরা হারিয়েছি আমাদের হৃৎস্পন্দন
আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট দ্বারা।


জিজ্ঞাসি তোমারে,
আমরা কি কাছে আসছি একে অপরের? না প্রযুক্তির?
কারণ এই ডিজিটাল সময়ে শূণ্য এবং একের মাঝখানে
আমাদের হৃদয় হারিয়েছি কোথাও।


****************************************************

মৃদুভাষী এই কবির সাথে এক ডিনারে আলাপ হলো বেশ অনেকক্ষণ। তার সাথে সামনাসামনি এই মুহূর্তগুলোকে ডিজিটাল যোগাযোগের চেয়ে অনেক মূল্য দেই আমি।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা আলেক্সেই সিডোরেন্কো

এনজেরি ওয়াঙ্গারির সাক্ষাৎকার:
* আফ্রিনোভেটর
* কেনিয়া আইসিটি বোর্ড
* গ্লোবাল ভয়েসেস

এনজেরির একমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই পাওয়া যাবে এখানে

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Friday, May 21, 2010

মদিরার দেশ চিলি


দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে আমার ধারণা কম থাকায় চিলিতে এসে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। প্রথমত: ভেবেছিলাম যে এখানে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের পাশাপাশি নেটিভ বা আদিবাসীদের দেখা পাব (যেমন বলিভিয়ায় আদিবাসী ৬০%)। কিন্তু দেখলাম যে বেশীর ভাগ মানুষই আর্য এবং কিছু আদিবাসীদের শংকর দেখা যায়। আর্জেন্টিনার পাশাপাশি চিলি এমন এক দক্ষিণ আমেরিকার দেশ যেখানে ১৬শ শতাব্দী থেকে আসতে শুরু করা ইউরোপীয় অভিবাসীরা (আইরিশ, স্কটিশ, জার্মান, স্প্যানিশ ইত্যাদি) ইনকা আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে দিয়েছে। মূল আদিবাসীদের দেখতে গেলে নাকি উত্তর বা দক্ষিণ কোনে রিজার্ভে যেতে হবে। চিলির কেউ কেউ তার পূর্বপুরুষ স্প্যানিয়ার্ড বা জার্মান বলে বড়াই করে আলাপের মধ্যে। অবকাঠামোর দিক দিয়ে চিলি যে কোন ইউরোপীয় শহরের মতই এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। ওদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ বলিভিয়া বা পেরু এখনও পিছিয়ে আছে। বলিভিয়ার বন্ধু এডিকে তাদের দেশের সাথে পার্থক্য কি জিজ্ঞেস করতে সে বলল চিলি তো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড।

পাবলো নেরুদা, সালভাদর আলেন্দে, পিনোশের দেশ চিলি। সেখানে যেতে ২০০০০ কি.মি. এর বেশী ভ্রমণ করতে হল প্রায় দুদিন ধরে। ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমে দুবাই। তারপর লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার উপর দিয়ে উড়ে পার হতে হল অতলান্তিক মহাসাগর। বিমান নামল ব্রাজিলের রিও দি জেনেইরোর উপর দিয়ে গিয়ে সাও পাওলো শহরে। সেখান থেকে ল্যাটিন আমেরিকার বিমান ল্যান বয়ে নিয়ে গেল চিলির সান্টিয়াগো।
ফ্রান্সেস্কাফ্রান্সেস্কা
আমরা রওনা হয়েছি একটি মদিরা বাগান পর্যটনে। চিলির মদ বিশ্বখ্যাত এবং তাদের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস (বিশ্বের পঞ্চম মদ রপ্তানিকারী দেশ)। রাজধানী সান্তিয়াগো শহর থেকে ৩৪ কি.মি. দুরে মাইপো উপত্যকা চিলির অন্যতম আঙ্গুর বাগান ও মদিরা প্রস্তুতকারী অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। আমাদের গাইড ফ্রান্সেসকা - ছোটখাট গড়নের স্বর্ণকেশী - প্রথমেই জেনে নিল আমাদের নামধাম – আমরা কোন ধরনের পানীয় পছন্দ করি ইত্যাদি। সান্তিয়াগোতে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ মলের ট্যুর অফিস প্রাঙ্গণ থেকে বাস চলা শুরু করলে নিরলসভাবে সে ইংরেজী ও স্প্যানিশ উভয় ভাষায় বলে গেল চিলির মদের ইন্ডাষ্ট্রির ইতিহাস।

১৬শ শতাব্দীর আগে দেশটিতে মদ উৎপাদিত হত না। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকরা প্রথম আঙ্গুরের বীজ নিয়ে আসে। তখন ধনীরা বাসার বাগানে আঙ্গুরের গাছ লাগাত। ১৮ শতাব্দীর দিকে ফরাসী মদের প্রকারভেদ – যেমন কাবার্নে সভিনিওঁ এবং মার্লট এদেশে প্রস্তুত হওয়া শুরু করে। এই শতাব্দীতেই সারা বিশ্বজুড়ে আঙ্গুরের ফলনে একটি মড়ক লাগে এবং মদের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। সেটি কিন্তু চিলিকে স্পর্শ করে না। ফলে চিলির মদের চাহিদা সারা বিশ্বে বেড়ে যায়। চিলি সেই মড়ক থেকে কিভাবে বাঁচল সে নিয়ে ফ্রান্সেসকা একটি লম্বা গল্প বলল।
চিলির আঙ্গুর বাগানের অঞ্চলসমূহচিলির আঙ্গুর বাগানের অঞ্চলসমূহ

দেশটির দৈর্ঘ ৪২০০ কি.মি. কিন্তু প্রস্থ খুবই কম – - গড়ে মাত্র ১৫০ কি.মি.। এত বিশাল দেশে বৈচিত্রও কম না। উত্তরে আতাকামা মরুভূমি, পূর্বে বলিভিয়ার সীমানা ঘেষে আন্দেজ পর্বতমালা, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, ও দক্ষিণে হিমবাহ দেশটিকে ঘিরে রেখেছে। ফ্রান্সেসকার ভাষায় চারিদিকে এই সুরক্ষা বলয়ই চিলিকে বাঁচিয়েছে। এছাড়াও ভাল মদ উৎপাদনের জন্যে তিনটি বিষয় দরকার হয়। মাটি, আবহাওয়া ও ভাল জাতের আঙ্গুরের ফলন। প্রকৃতি এদেশকে এই উপাদানগুলো উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে।

তারপর সে গল্প করল কার্মিনেরে মদের কথা যা একটি বিশেষ আঙ্গুর দিয়ে তৈরি হয়। একমাত্র চিলিতেই এই মদের সেরা সংস্করণ (১০০% খাঁটি) উৎপন্ন হয়। তার কাছ থেকে জানলাম মদের প্রকারভেদ সম্পর্কে এবং ফার্মেন্টেশন ও ডিস্টিলেশন পদ্ধতি সম্পর্কে। লাল আর সাদা মদের পার্থক্য, কোন ধরণের আঙ্গুর দিয়ে সেগুলো তৈরি হয়, বিভিন্ন স্বাদ – ড্রাই, সেমি ড্রাই, মিষ্টি, টক ইত্যাদি কিভাবে বানানো হয়...

চিলির উত্তরের দিকে একটি বিশেষ মদ তৈরি হয় যার নাম পিসকো। পিসকো সাওয়ার বা টক পিসকো ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে তৈরি হয় (যেমন হুইস্কি) এবং এতে লেবুর রস মেশানো হয়। এই পানীয়টি অনেকটা ককটেলের মত সুস্বাদু কিন্তু খুব কড়া। এই মদের উৎপত্তি নিয়ে পেরুর সাথে তাদের মতভেদ আছে।

আরেকটি ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি যে দক্ষিণ আমেরিকার লোকজন কোকা কোলা জাতীয় কোমল পানীয় খুব পান করে। এবং মদের সাথে কোক মিশিয়ে সেই পানীয়র নতুন নামকরণ করা হয়। যেমন পিসকো আর কোলা - পিসকোলা অথবা রণ (এক ধরণের মদ) এবং কোলা - রনকোলা।

সান্টিয়াগো শহরটির অদুরেই আন্দেজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা মাপুই নদী দেখলাম। নদী কি বলব, পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়ার মত। নদী থেকে জেগে ওঠা চরের মত যায়গায় দেখলাম গাড়ি পার্ক করা আছে। এবারের শীতে (এখন ওখানে শীত) অন্য সময়কার মত বৃষ্টি হচ্ছে না। বৃষ্টি আসলেই নাকি এইসব নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে।

কন্চা ই টোরোকন্চা ই টোরো

আমাদের গন্তব্য কন্চা ই টোরো নামে একটি ভাইনইয়ার্ড যা একটি পরিবারের নাম এবং তারা এই মদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করে ১৮৮৩ সালে। এককালে এইসব পরিবারই মদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। এখন এই প্রতিষ্ঠানটি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেন্জ এ নিবন্ধিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (বিশ্বের সেরা দশটি মদ উৎপাদনকারীর মধ্যে পরে)।

সারা চিলি জুড়ে এর মোট আঙ্গুর বাগানের পরিমাণ ৮০০০ হেক্টরের ও বেশী। মাপুই উপত্যকায় কন্চা ই টোরোর ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখলাম সেখানে আরও পর্যটক রয়েছে। আমাদের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি ভিডিও দেখান হল কন্চা ই টোরোর ইতিহাস সম্পর্কে - এটিকে বেশী পরিমাণে বিজ্ঞাপনই মনে হল। তার পর বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম পরবর্তী গাইডের জন্যে। ততক্ষণে ফ্রান্সেসকার সাথে অন্যান্য বিষয়ে আলাপ হল। সে নাট্যকলার পড়াশোনা করেছে – কিন্তু আক্ষেপের সাথে জানালো এই বিষয় শিখে চাকুরী পাওয়া বেশ কঠিন। যদিও সে নাটক ভালবাসে তবুও সে আবার পর্যটন কলা শেখা শুরু করেছে - কারণ এর চাহিদা বেশ।

মাক্সিমিলিয়ানোমাক্সিমিলিয়ানো

প্রচুর স্প্যানিশ ভাষার পর্যটকের ভিড়ে আমি এবং মরোক্কোর হিশাম এর জন্যে এরপর আসল পরবর্তী ইংরেজী ভাষার গাইড মাক্সিমিলিয়ানো। তরুণ এই গাইড ইতিহাসের গ্রাজুয়েট এবং পেশায় সাংবাদিক - একটি জনপ্রিয় দৈনিকে সে স্পোর্টস রিপোর্টার। আমরা এগোলাম সেই মালিক পরিবারটির বাগান বাড়ির দিকে। গত ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে পুরোনো এই বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে - তাই বন্ধ ছিল। মাক্সিমিলিয়ানো বলছিল - ৫ জন লোকের জন্যে ২৮টি রুম - ভেবে দেখতে পারো? সামনের উঠোনটি অনেকটা ইংরেজ স্থাপত্যের ধাঁচে করা। এর পাশেই ভাইনইয়ার্ড বা মদের ক্ষেত - ফলন তোলা হয়ে গেছে - তাই আঙ্গুর বিহীন গাছগুলো দাড়িয়ে আছে। মাক্সিমিলিয়ানো মজার মানুষ - আমাদের সম্পর্কে তার উৎসাহের কমতি নেই। আমরা জানালাম নিজের দেশ সম্পর্কে আর সে আলাপ করল চিলির ইতিহাস নিয়ে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলে (কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদি) এবং কিউবার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে যুক্তরাষ্ট্রীয় জোট তাদের বয়কট করা শুরু করে। ফলস্বরূপ বিদেশী বিনিয়োগ কমে যায় ও দেশে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ১৯৭৩ সালে পিনোশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং পরবর্তীতে স্বৈরাচার হিসেবে দেশকে শাসন করেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। তার শাসনামলে প্রচুর বিরোধী দলীয় কর্মীদের মেরে ফেলা হয়েছে - অনেকের কোন হদিস পাওয়া যায় নি।

তবে মাক্সিমিলিয়ানো বলল মজার কথা - পিনোশের আমলে অর্থনীতি মুক্ত হয়, মুদ্রাস্ফীতি কমে, যার ফল এখন চিলি ভোগ করছে। মাক্সিমিলিয়ানোর ও দেখলাম খুব গর্ব তাদের ইউরোপীয় বংশ নিয়ে - বলল যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে চিলির সুসম্পর্ক নেই। হয়ত তাদের ইউরোপীয় ঐতিহ্যই তাদের অন্যরকম করে ভাবতে সাহায্য করে।

মদের ব্যারেলমদের ব্যারেল

আমাদের খেয়াল হল তখন যে আমরা মদিরা নিয়ে আলোচনা ভুলে গিয়ে এইসব আলোচনা করছি। সে এরপর আমাদের ওয়াইন সেলারে নিয়ে গেল। বিভিন্ন রুমে সারি সারি মদের ব্যারেল রাখা তাপমাত্রা, আলো ও আদ্রতা নিয়ন্ত্রিত মাটির নীচের কক্ষে। একটু পরপর পানির ছিটা দেয়া হচ্ছে ছাদে লাগানো পাইপ থেকে। জানলাম একেকটি ওক কাঠের ওয়াইন ব্যারেলের দাম ১০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয় কারণ - সেগুলোর কাঠ বিশেষ ঘ্রাণযুক্ত হয় যার প্রভাব কিছু পরিমাণে হলেও মদের উপরে পরে। প্রতিটি ব্যারেল মাত্র ৪-৫ মৌসুম ব্যবহার করা যায় - এরপর বিক্রি করা হয় স্কটল্যান্ডে - যেখানে সেগুলোতে হুইস্কি বানানো হয়। ব্যারেল কমদামি এমনকি লৌহজাতীয় পদার্থেরও হয় এবং বলাই বাহুল্য - মদ এর দামও নির্ভর করে কোন ব্যারেলে এটি রাখা হয়েছে তার উপরে।

মদিরামদিরা

তারপর ছিল ওয়াইন টেস্টিং পর্ব - এবং স্মৃতি হিসেবে কাচের গ্লাসটি রইল সাথে। ফেরার পথে ভাবছিলাম কিভাবে তারা তাদের মদের ইণ্ডাস্ট্রিকেও পর্যটনের অংশ করে নিয়েছে। মাক্সিমিলিয়ানো ও ফ্রান্সেসকা আমার দেখা সবচেয়ে শিক্ষিত গাইড। তাদের প্রজন্মের কঠোর পরিশ্রমই হয়ত জাতিটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

১) প্রথম ছবিটি ফ্লিকার থেকে

২) বাকি ছবিগুলো আমার এবং হিশামের তোলা।

Sunday, May 02, 2010

যোগজাকার্তার পথে পথে (২)

পূর্বের পর্ব - বড়বুদুর বৌদ্ধমন্দির

সমগ্র ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় ১৫০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার মধ্যে ১৩০টি সুপ্ত এবং প্যাসিফিক রিংস অফ ফায়ারের উপরে অবস্থিত। কাজেই যে কোন পর্যটন স্থানে অবধারিতভাবে একটি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া যায়। বড়বুদুর দেখা হয়ে গেল সকাল এগারটার মধ্যে এবং আমাদের পরবর্তী গন্তব্য প্রামবানান মন্দির। ড্রাইভার বেশ ভাল ইংরেজী বলে - সেটি এক বিস্ময় ছিল, কারন জাকার্তাতেও অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভারই ইংরেজী বলতে পারে না। তো তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে প্রামবানান যাবার পথে কি কি দেখা যায়। সেই মেরাপি পাহাড়ের আগ্নেয়গিরির কথা বলল। অত:পর আমাদের পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু হল।

২০০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট খাল২০০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট খাল

গুনুঙ মেরাপি মানে হচ্ছে আগুনের পাহাড় - নামকরণ এমন কেন হয়েছে বুঝতেই পারছেন। ১৫৪৮ সাল থেকে এটি নিয়মিত লাভা উদগিরণ করে আসছে। স্থানীয় জাভানীজরা পাহাড়কে শান্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের পুজো/ভেট দিয়ে থাকে সুলতানের রাজত্ব গ্রহণের বার্ষিকীতে। বছরে প্রায় ৩০০ দিনই এর চূড়ায় ধোঁয়া দেখা যায়। তাদের সর্বশেষ এখানে উদগিরণ হয়েছে ২০০৬ সালে যোগজাকার্তার ভূমিকম্পের পূর্বে। সে সময় ২ জন মারা গিয়েছিল। আমাদের ড্রাইভারই গাইডের কাজ করল - সে গিয়ে দেখাল পাহাড়ের কাছে একটি শেল্টার আছে - সেখানে অনেক লোক আশ্রয় নিলেও দুজন পর্যটক ছাত্র পৌঁছুতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। তবে আমাদের কপাল খারাপ। মেঘে ঢাকা চূড়ার কারনে উপরে কিছুই দেখা গেল না। মূল পাহাড়টিতে ওঠা নিষিদ্ধ - পথও নেই। আমাদের সামনে ছিল শুধু লাভা উদগিরণে তৈরি হওয়া একটি খালের মত যায়গা। এটি দেখেই দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হল। অথচ কয়েক মাস আগে বান্দুং এর কাছে তাংকুবান পেরাহু আগ্নেয়গিরিতে গিয়েছিলাম যেখানে বিশাল এক জ্বালামুখ ছিল - দেখার মত জিনিষ।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্সপ্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্স

এরপর আমরা দুপুরের খাবার সেরে প্রামবানান মন্দিরে পৌঁছালাম। এটি ত্রিমূর্তিকে (শিব, ব্রহ্মা, আর বিষ্ণু) উৎসর্গকৃত নবম শতাব্দীতে নির্মিত একটি মন্দির কমপ্লেক্স যেখানে আদিকালে ২৩৭টি মন্দিরের স্থাপনা ছিল। ইন্দোনেশিয়ার এই সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দিরকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়েছে।

২৩৭টি মন্দির স্থাপনার একটি২৩৭টি মন্দির স্থাপনার একটি

শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের প্রভাবে পদানত হিন্দু সন্জয় সাম্রাজ্য আবার ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং বড়বুদুরের জবাবে তারা প্রামবানান মন্দির তৈরি করে। এটি মাতারাম রাজ্যের রাজকীয় মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মন্দিরের অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য সেই সাম্রাজ্যের অর্থবল ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।

চান্দি মানে বাহাসায় মন্দিরচান্দি মানে বাহাসায় মন্দির

তবে ৯২৯ সালে মাতারাম সাম্রাজ্যের শেষ রাজা মপু সিন্দক সাম্রাজ্যটিকে পূর্ব জাভার দিকে সরিয়ে নেন (মেরাপি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে)। তবে সেটাই মন্দিরটির পতনের কারণ হয়ে দাড়ায় - এটি পরিত্যক্ত হয়। ১৬ শতাব্দীতে মেরাপি পাহাড়ের অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্পে মন্দিরটির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্সপ্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্স

১৮ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসনের সময় কলিন ম্যাকেন্জি নামক একজন সার্ভেয়ার মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। ১৮৮০ সালে ডাচ নৃতত্ত্ববিদদের দ্বারা খননের সময় বেশ অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি যায় মন্দির থেকে। এরপর ১৯৩০ সাল থেকে আবার এটি পুনর্নিমাণ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে প্রধান মন্দিরটি পূর্বাবস্থায় আসে।

চমৎকার সব টাওয়ারগুলো - প্রতিটি আলাদা মন্দিরচমৎকার সব টাওয়ারগুলো - প্রতিটি আলাদা মন্দির

এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে এটির উপর আরও কাজ হলেও চুরি যাওয়া পাথরের অংশগুলির অভাবে অনেক অংশেরই পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় নি।

নান্দি মোষ - শিব ঠাকুরের বাহননান্দি মোষ - শিব ঠাকুরের বাহন

মন্দিরের ভেতরে দেবতা মূর্তিমন্দিরের ভেতরে দেবতা মূর্তি

মন্দিরের চারিদিকে কারুকার্যখচিত পথমন্দিরের চারিদিকে কারুকার্যখচিত পথ

তবুও যা দেখলাম তাতে আমরা অভিভূত। ২০০৬ সালের ভূমিকম্পে এর বেশ ক্ষতি সাধন হলেও পাথরের গাঁথুনি কত মজবুত চিন্তা করেন - যে বড় কোন কাঠামোগত ক্ষতি হয় নি ২৩৭টির মধ্যে যে কয়টি চুড়া দাড়িয়ে আছে সেগুলোর।

মন্দিরের দেয়ালের কারুকার্যমন্দিরের দেয়ালের কারুকার্য

পাথরের কারুকার্যপাথরের কারুকার্য

চুড়া পর্যন্ত কারুকার্যখচিতচুড়া পর্যন্ত কারুকার্যখচিত

মাঝখানের বড় শিব মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্যে বন্ধ ছিল সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগল যে আমরা দেখতে চাই কি না। অর্থাৎ ঘুষ দিলে সেখানে যাওয়া যাবে। অন্ধকার নির্জন যায়গায় গেলে নিরাপত্তাজনিত কি সমস্যা হতে পারে চিন্তা করে আর গেলাম না।

মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ - এককালে এগুলো দাড়িয়ে ছিল।মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ - এককালে এগুলো দাড়িয়ে ছিল।

তবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেবার ব্যাপারটি ভাল লাগল না। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য।

আমরা আছি গুটি কয় দাড়িয়ে - বাকি সব ঝরে গেছে।আমরা আছি গুটি কয় দাড়িয়ে - বাকি সব ঝরে গেছে।

কমপ্লেক্সের অনেক যায়গা জুড়ে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ, সেগুলো হয়ত কোনদিন পশ্চিমা অর্থসাহায্যে মাথা তুলে দাড়াবে দুর্নীতিগ্রস্তদের উদর পুরে বা হয়ত এভাবেই থাকবে। তবে বিদেশীদের কাছ থেকে টিকেট নেয়া হয় জনপ্রতি ১৩ ডলার করে - যে পরিমাণ অর্থ আসে সেটা দিয়ে নিশ্চয়ই রক্ষণাবেক্ষণ ভালভাবেই করার কথা।

যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সাযোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সা

এর পরদিন আমরা যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সায় চড়ে তামান সারি ওয়াটার ক্যাসল দেখতে গেলাম। এটি রাজপ্রাসাদ বা ক্রাতোন এর দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। ১৮ শতাব্দীতে সুলতানের জন্যে তৈরি এই স্থাপনাটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি বিশ্রামাগার, একটি অস্ত্রাগার, লুকানোর জায়গা ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে এর মধ্যে একটি ঝর্ণার জলে পূর্ণ পুকুর আছে যাকে সুলতান তার স্নানঘর বা হারেম হিসেবে ব্যবহার করত। মূল কম্পাউন্ডে অনেক সঙ্গীতশিল্পী সুর তুলত এবং নর্তকীরা নাচত। এরপর তারা বড় পুকুরে স্নান করে তাদের বিশ্রামাগারে চলে যেত এবং রাজা সেখান থেকে তার রাতের সঙ্গিনীদেরকে পছন্দ করতেন। এরপর তারা একটি ছোট পুকুরে সুলতানকে গোসল করাত এবং সেখানে বিশ্রামাগারে রাজার শয্যসঙ্গিনী হত।

মূল কম্পাউন্ডের বাইরে এই এলাকাটিতে এখন সুলতানদের চাকরবাকরদের পরিবারদের বিশাল একটি সমাজ থাকে। তারা বিভিন্ন বাটিকের কাপড় তৈরি করে ও পর্যটকদের কাছে বেচে।

যোগজাকার্তা হস্তশিল্প ও বাটিকের জিনিষপত্রের জন্যে খুব প্রসিদ্ধ। সেটি নিয়ে লিখতে গেলে আরেকটি পোস্ট হবে। তাই এখানেই শেষ করছি।

* প্রথম ছবিটি মেরাপি পাহাড়ের - উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে। বাকিগুলো আমার তোলা।

Thursday, April 29, 2010

যোগজাকার্তার পথে পথে

উপর থেকে বড়বুদুরের ছবিউপর থেকে বড়বুদুরের ছবি
ইন্দোনেশিয়া আসার পর বিভিন্ন পোস্টার ও লিফলেটে একটি অপূর্ব ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবি দেখে আমি খুব অভিভূত ছিলাম - সেটি হচ্ছে জাভা দ্বীপের বড়বুদুর বৌদ্ধ মন্দির। ১৭০০০ এরও বেশী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ার সৌন্দর্য্য জাকার্তার বাইরে না গেলে বোঝা যায় না - কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী বান্দুং, বোগর এবং একটু দুরে পেলা বুহান রাতু ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। দেশ থেকে আব্বা এসেছিলেন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল এবার দুরে কোথাও যাব। ঠিক হল যোগজাকার্তা যাব এবং বড়বুদুর দেখার আকাঙ্খাটি পূরণ হল অবশেষে।

যোগজাকার্তা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী থেকে মাত্র ৪৪৩ কিলোমিটার দুরে (ইউরোপ হলে ৪-৫ ঘন্টার গাড়িভ্রমণ)। কিন্তু যাতায়াতের উপায়গুলো শুনে চোখ কপালে উঠে যাবার যোগাড়। গাড়িতে লাগবে ১২ ঘন্টা - যদি যানজট অনুকূলে থাকে। ট্রেনে যাওয়া সহজ উপায় - সেটাতে ৮ ঘন্টা লাগবে। আর নাহলে তো বিমান আছেই। ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে ভ্রমণের অন্যতম কার্যকরী উপায় স্থানীয় কিছু এয়ারলাইন্স। তবে তাদের ভাল সেফটি রেকর্ড আছে এমন শুনিনি, বিশেষ করে আদম পরিবহনের গোত্তা মারার পর থেকে। আমাদের ত্রাতা হয়ে আসলো কম খরুচে আন্তর্জাতিক পরিবহন এয়ার এশিয়া - তাদের অন্তত বিমানগুলো নতুন। দেখা গেল তাদের এক প্রমোশন রেটে বিমান ভাড়া ট্রেন ভাড়ার প্রায় সমান (জনপ্রতি ৫০ ডলার)। তাই সময় বাঁচাতে (৫০ মিনিটের ফ্লাইট) এয়ার এশিয়ার কাঁধে ভর করলাম সবাই।

যোগজাকার্তা ট্যুরিস্ট ম্যাপযোগজাকার্তা ট্যুরিস্ট ম্যাপ

জাভা দ্বীপের মধ্যভাগের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রদেশ যোগজাকার্তার (সংক্ষেপে যোগজা) পত্তন হয় ১৭৫৫ সালে। বর্তমানে এটি ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে ছোট প্রদেশ যার রাজধানী একই নামে। ১৭৫৫ সালে মাতারাম সাম্রাজ্যের রাজকুমার মান্কুবুমি তার সুলতানাতের রাজধানী হিসেবে একে ঘোষণা করেন। বর্তমানেও এটি সুলতান কর্তৃক শাসিত - ইন্দোনেশিয়ার একমাত্র প্রদেশ এটি যা এরকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। জাভা দ্বীপের শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে একে ধরা হয়। ১৯৪৬ সালে নব ঘোষিত ইন্দোনেশিয়া রিপাবলিকের রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত হয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত - যে পর্যন্ত ডাচরা ইন্দোনেশিয়া পুনর্দখল করে রেখেছিল।

যোগজাকার্তা - আদিসুতজিপতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরযোগজাকার্তা - আদিসুতজিপতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

যোগজাকার্তা যেই দিক দিয়ে জাকার্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা - সেটি হচ্ছে ৩৩ বর্গ কি.মি.র শহরে মাত্র ৫ লাখ লোকের বসবাস। বেশ ছিমছাম, গুছানো একটি শহর যা পর্যটকে পূর্ণ থাকে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরও বটে - এখানে বেশ কটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে সমগ্র ইন্দোনেশিয়া থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে।
হোটেলে ওঠার কিছু পরেই বের হয়ে গেলাম বিচের দিকে - ৭ সিটের গাড়ি ভাড়া করা ছিল (২৪ ঘন্টায় ৫০ ডলার)। কিন্তু পথে সুলতানের প্রাসাদ (ক্রাতোন) দেখে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শুনেছিলাম যে বীচে তাজা সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় কিনতে যা আপনার সামনেই গ্রীল করে দেবে। ওখানে গিয়ে দেখি একটি যায়গায় কিছু মাছ বিক্রি হচ্ছে - কিন্তু চারিদিকে খুব অন্ধকার। আর দুরে রেস্টুরেন্ট আছে কিন্তু সেখানের পরিবেশ ভাল লাগল না। অত:পর শহরের দিকে ফেরত আসলাম এবং পথে একটি সিফুড রেস্টুরেন্টে রাতের ভোজ সারলাম।

বড়বুদুরবড়বুদুর

পরদিন ভোরে আমাদের বড়বুদুর মিশন শুরু হলো। নবম শতাব্দিতে নির্মিত এই বৌদ্ধমন্দিরটি (বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। চৌদ্দ শতাব্দীতে মুসলমানদের কাছে পতনের পূর্বে জাভা দ্বীপ হিন্দু এবং বৌদ্ধ শাসিত ছিল।
বড়বুদুরের একাংশবড়বুদুরের একাংশ

বড়বুদুর স্থাপনাটি একাধারে গৌতম বুদ্ধের সম্মানে একটি মন্দির এবং বৌদ্ধদের একটি তীর্থস্থান। এই তীর্থযাত্রার শুরু হত মন্দিরের নীচ থেকে বৃত্তাকার পথে ঘুরে ঘুরে কামধাতু, রুপধাতু এবং অরুপধাতু - বৌদ্ধধর্মের এই তিনটি আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করত। এই যাত্রা পথে তাদের সহায় হত ২৬৭২টি গল্প চিত্রায়িত রিলিফ প্যানেল -যা এখনও বিদ্যমান।

২৬৭২টি রিলিফ প্যানেলের একটি২৬৭২টি রিলিফ প্যানেলের একটি

এটি মালয় শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের অধীনে শৈলেন্দ্ররাজবংশের দ্বারা নির্মিত। এটি তৈরি করতে ৭৫ বছর লেগেছে এবং ৮২৫ সালে শেষ হয়।

চৌদ্দশত সালের পর অনেক জাভাবাসী মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে এই মন্দিরটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় এবং পরবর্তী শতকগুলোতে আগ্নেয়গিরির ছাইভস্ম এবং জঙ্গল দ্বারা ঢেকে যায়। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকরা এটি খুঁজে বের করে এবং পরে ডাচ শাসকরা এর সংস্কার শুরু করে এবং বিশ্বে পরিচিতি পায় এটি। এখনও বছরে একবার এখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হয়।

মন্দিরে পর্যটকদের ভীড়মন্দিরে পর্যটকদের ভীড়

মন্দিরটিকে ভালভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে দেখা গেল। আর বিদেশী ট্যুরিস্টদের জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামাগার, চলন প্রতিবন্ধীদের জন্যে হুইল চেয়ার ইত্যাদি। অবশ্য থাকবে না কেন - স্থানীয় পর্যটকদের চেয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে দশগুণ টিকেটের দাম নেয়া হয়।

সামনে থেকে এটি দেখা অবশ্যই একটি বিস্ময় ছিল। আর সেই তীর্থযাত্রার স্থান দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে যাওয়া। সেই রিলিফগুলো সম্পর্কে জার্মান, জাপানী, ইংরেজী ইত্যাদি ভাষায় চারদিকে গাইডদের অবিশ্রান্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অন্যরকম আবহ এনে দেয়।

এই ছিদ্রযুক্ত স্তূপের ভেতরে বৌদ্ধমুর্তি আছে।এই ছিদ্রযুক্ত স্তূপের ভেতরে বৌদ্ধমুর্তি আছে।

অবশেষে উপরে উঠলাম - সেখানে মূল বেদী বা স্তূপে একটি উন্মুক্ত বৌদ্ধ মূর্তি আছে। পুরো মন্দিরে পাঁচশরও বেশী এরকম স্তূপ ছিল যার ভেতরে একটি করে বৌদ্ধমূর্তি ছিল। তবে এখন ৩০০টিরও অধিক ভাঙ্গা এবং অনেকগুলো চুরি গেছে যখন এটি পরিত্যক্ত ছিল তখন।

দুরে মেরাপি পাহাড়দুরে মেরাপি পাহাড়

আমরা দুরে দেখতে পেলাম পুলিশ পাহারায় অনেকগুলো ট্যুরিস্ট বাস আসছে। তখন দেখলাম বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হলো। তারা একে অপরকে বলতে লাগল যে ওই আসছে। তখন মনে পড়ে গেল যে আমি একটি আর্টিকেলে পড়েছিলাম - ইন্দোনেশিয়াবাসীরা দল বেধে এটি দেখতে আসে - তখন অন্য পর্যটকদের জন্যে কঠিন হয়ে যায় ঠিকমত দেখা। তাই তারা সকাল সকাল আসার চেষ্টা করে ভীড় এড়ানোর জন্যে। রোদের তাপ চড়া হতে শুরু করলে আমরা নীচের দিকে নামা শুরু করলাম।

(চলবে .. পরবর্তী আকর্ষণ যোগজাকার্তার প্রামবানান হিন্দু মন্দির - এটিও নবম শতাব্দীর)

ছবির সূত্র:
১) প্রথমটি এখান থেকে
২) ট্যুরিস্ট ম্যাপ উইকিপিডিয়া থেকে
বাকিগুলো আমার তোলা