Wednesday, July 29, 2009

জাকার্তা বার্তা

সাড়ে তিন বছর ইউরোপে বসবাসের পর আমার নতুন বসতি এখন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। দোহাতে উড়োজাহাজ পরিবর্তন করে সিঙাপুরের ফ্লাইটে উঠতে যাব তখন দেখি মাথায় কাপড় দেয়া বিশাল একদল ইন্দোনেশীয় নারী লাইন ভেঙ্গে বোর্ডিং এর জন্যে দাড়াতে তৎপর। এরা মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের বাড়ীর গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে বাড়ী ফিরছে। এছাড়া লাইনের বেশ কিছু লোকজনের পোষাকে বোঝা গেল তারা ওমরাহ করে দেশে ফিরছে। সিঙাপুরে যাত্রাবিরতিটা হলো খুব মজার। একই বিমান জাকার্তা যাবে, ফুয়েলিং এর জন্যে থেমেছে। কিন্তু আমাদের সবাইকে নামানো হল এবং আবার নতুন করে চেকইন ও বোর্ডিং করানো হল। জিজ্ঞেস করায় বলা হলো যে সিঙাপুরের আইন নাকি কড়া। দোহা থেকে বিমানে সাথে তরল পদার্থ নেয়ার অনুমতি ছিল কিন্তু সিঙাপুরে বিমানে নেয়া যাবে না।

সেখান থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের ফ্লাইট জাকার্তা পর্যন্ত। প্লেন নামার সময় নীচে বেশ সবুজ দেখলাম। এয়ারপোর্টটি বেশ বড় মনে হলো না। আমাদের 'জিয়া' এর থেকে বেশ বড়। তবে বেশ একটি গোছানো ভাব আছে। নীচে গ্রাউন্ড স্টাফের ছড়াছড়ি, একটু পরপর মোছা হচ্ছে মেঝে। শোয়াইন ফ্লুর জন্যে আমাদের একটি ডিক্লারেশন দিতে হলো (জ্বর আছে কিনা, কোথা থেকে এসেছি) ইত্যাদি। একজায়গায় দেখলাম জটলা। স্ক্রীনিং করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সবার কাছ থেকে ডিক্লারেশনটি নিয়ে পড়ে না দেখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বুঝলাম সেই ব্যুরোক্রেসী - আমরা নিজেও জানিনা এসব কেন করছি - ফলাফল শুন্য।

ইমিগ্রেশনে অনেক সময় লাগল। উল্টে পাল্টে পাসপোর্ট ভিসা দেখল অফিসার, কিছু টাইপ করল, একবার কাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল। তারপর মুক্তি। নিতে লোক এসেছিল, তাই মালপত্র গাড়ীতে উঠিয়ে চললাম জাকার্তা শহরের উদ্দেশ্যে (এয়ারপোর্টটি মূল শহরের একটু বাইরে)। আমরা যাচ্ছি একটি টোল রোডে এবং আমাদের যাত্রাপথের উল্টোদিকে প্রচুর জ্যাম।

কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য 
কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য

সত্যিই শহরে ঢুকে প্রথমেই মনে হল ঢাকার কথা। মেগাসিটির অন্যতম চিহ্ন হচ্ছে স্মগ (কুয়াশা), হাইরাইজ এবং অগুণতি শপিং মল। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জাকার্তাকে একটু একটু করে আরও চিনলাম। উচু বিল্ডিঙ এর ধারেই ভাঙ্গা বাড়ী - যদিও আমাদের বস্তির মত জীর্ণ নয়। অনেক এলাকায়ই চিপা গলি, রাস্তা ভাঙ্গা।

বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র 
বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র

ওদের রিক্সা নেই কিন্তু রাস্তায় গিজগিজ করে মোটরসাইকেল, ওরা বলে ওজেক। ছোট রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওজেকের স্টল, ভাড়ায় খাটে। জ্যামের কারনে দ্রুত চলাচলের জন্যে বেশ জনপ্রিয়।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্যে আছে তাদের মিনিবাস। যেখান সেখান থেকে লোক উঠাচ্ছে। আর ট্রান্স জাকার্তা এসি বাস যার জন্যে রয়েছে আলাদা লাইন। রাস্তায় গাড়ী চলাচলে কেউ নিয়ম মানে না। তবে বিশৃংখলাও নেই।

জাকার্তার লোকেরা এমনিতে খুব ভদ্র। তবে নৈতিকতার অভাব রয়েছে বড্ড, আমাদের মতই। ট্যাক্সি ড্রাইভার এমন ভাব করবে যে তার কাছে কোন ভাংতি নেই, অর্থাৎ চেন্জটুকু রেখে দিতে চাচ্ছে। তাই ভাষা না জানলে রাস্তায় চলা খুব অসুবিধা। এখানে টুরিস্ট বা বানিজ্যিক এলাকা ছাড়া দোকানে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ইংরেজী জানা লোক খুব কম।
আমার প্রথমে অসুবিধা হলো ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে। এক ইন্টারনেট কাফেতে গেলাম সেখানে স্পীড অনেক স্লো। বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করলেও অনেক চেষ্টা করেও ইন্সটল করতে পারলাম না। ভাষার সমস্যা সত্বেও ক্যাফের লোকটিকে বোঝালাম যে আমার ফন্টটি ইন্সটল করা জরুরী। সে এসে কিছুক্ষণ গুঁতাগুতি করে বলল আমি পারব না। আমাদের ইন্জিনিয়ারকে লাগবে। আমি বললাম তাহলে অনুগ্রহ করে কালকে করিয়ে নিও। বলল সে তো সব সময় আসে না।

এরপর অনেক খুঁজে পেতে গেলাম মোবাইল ইন্টারনেটের জন্যে সিম কিনতে। আমাকে একগাদা লিস্ট ধরিয়ে দিল - যে এই কাগজপত্র লাগবে। দেখলাম আমার এসব বের করতে মাস তিনেকের ধাক্কা। এই কদিন আমি ইন্টারনেট ছাড়া থাকব! পরবর্তীতে এক স্থানীয় আমাকে সাহায্য করে তার নামে পোস্ট পেইড সিমটি কিনতে। আমি কানেকটেড হতে পারলেও সার্ভিসের অবস্থা চরম খারাপ, কখনই তাদের উদ্ধৃত স্পীড পাওয়া যায়না। আর সন্ধ্যার পরে তো একেবারে স্লো হয়ে যায়। এর চেয়ে আমাদের দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের সার্ভিস অনেক ভাল।

চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম 
চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম

শ্রমের মূল্য কম বলেই বোধহয় এখানে কর্মদক্ষতাও কম। আর রয়েছে দুর্নীতি। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। কর্মচারী সংসদ থেকে রিসিট পর্যন্ত দেবে আপনাকে ঘুষের জন্যে। তাই সেবার মানও সেইরকম - কড়ি ঢালবেন তো সবকিছু এসে হাজির, না হলে কিছুই নড়বে না।

তবে দুর্নীতির মূলে মনে হয় ধনী গরীবের চরম বৈষম্য। এখানে আছে কারওয়ান বাজারের মত কাঁচা বাজার আবার নন্দন আগোরার মত শপিং মল (কারফুর, জায়ান্ট)। কারফুরে মাছের দাম কাঁচা বাজারের তুলনায় ২-৪গুণ। এমনিতে জাকার্তা খুব এক্সপেনসিভ জায়গা, একবার কারফুরে বাজার কররেই ৪০-৫০ ডলার নেমে যায়। এখানে সবই পাওয়া যায় কিন্তু তার মূল্য আছে - অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপের চেয়ে বেশী লাগল। রাস্তায় দেখা যায় মার্সিডিজ, বিএমডাব্লু। আবার এই দেশেই ১০০ ডলারে কাজের লোক পাওয়া যায়। ঠিক আমাদের দেশের মত। তারা কিভাবে এই শহরে বেঁচে থাকে জানার ইচ্ছে খুব।

সেদিন বৃষ্টি হলো। ঘন্টাখানেকের বৃষ্টিতেই শহরের কিছু অংশের রাস্তায় দেখা গেল একফুট পানি। জানা গেল নালা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে এই অবস্থা। সরকার ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে - কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

এদেশের তরুণদের মধ্যে ব্যান্ডপ্রীতি প্রচুর। সেদিন গেলাম আনচোল বীচে। সেখানে দেখি ব্যান্ড সংগীত হবে তাই নিয়ে লোকজনের উৎসাহের কমতি নেই। টিভিতে একেকজন শিল্পীর পোষাক দেখি আর মেলাই আমাদের পরিচিত শিল্পীর সাথে -এই যে জেমসের মতো চুল, আবার ওড়না পরেছে; এর গলার স্বরে হাসানের মত টান , আবার চুলও লম্বা।
আনচোল বীচ 
আনচোল বীচ

এই কদিনে আমাদের বিনোদন ছিল ইন্দোনেশিয়ার ভাষার চ্যানেলের টিভি দেখা। এদের কিছু জটিল সোপ আছে - যাতে ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর মত প্যাচ। কিছু সিরিয়ালের মূল লেখকও নাকি ভারতীয়। এখানে বেশীরভাগ সিরিয়ালেই মেয়েরা হয় ভিলেইন আর পুরুষরা হয় গোবেচারা টাইপের। পরে জানলাম আসলেই অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েশাষিত সমাজ এখানে।

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম এশিয়ার সর্ববৃহত মসজিদ - বিশাল পাঁচ তলা কম্পলেক্স এবং সামনে ঈদগাহের বিশাল খোলা মাঠ। তার অতি নিকটেই একটি ক্যাথেড্রাল। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ মুসলিম দেশে ধর্মীয় পোষাক কিন্তু দেখেছি কম। গরম বলে রাস্তা ঘাটে মেয়েরা পরে টি শার্ট এবং স্কার্ট বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, বিশেষ করে গৃহপরিচারিকারা। ছেলেরা সাধারণ শার্ট, প্যান্ট। কিছু ধনী মহিলাদের মাথায় হিজাব পড়তে দেখেছি, তবে তাদের অনেকেই ড্রাইভ করে। এটি মুসলিম দেশ বোঝানোর জন্যে আজান শোনা যায় পাড়ায় পাড়ায়। আমাদের দেশের মতই নামাজীর সংখ্যাও বেশী আর ঘুষখোরের সংখ্যাও।

এতসব মিলেই জাকার্তাকে আমার ঢাকার খুব কাছাকাছি লেগেছে। হয়ত ঢাকা আগামী পাঁচ কিংবা দশ বছরে এখানে পৌছাবে। দেশের অনেক কিছুই যেহেতু আমরা সহ্য করে নেই তাই মনে হচ্ছে এখানে থাকাও বেশ ইন্টারেস্টিং হবে।
জাকার্তার কিছু ছবি ফ্লিকারে -

× পোস্টকার্ডের জাকার্তা
× মেক আপ ছাড়া একই শহর
× ট্রেন যাত্রা
× বৃষ্টিবরণ

পোস্টের টাইটেলের জন্যে কৃতজ্ঞতা: হিমু

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Wednesday, July 22, 2009

বাহরাইন ও ওমানে বিদেশী শ্রমিকদের জীবন

মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যার বিশাল এক অংশ হচ্ছে মূলত: দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকরা। এই পোস্টে আমরা তেমন দুই ব্যক্তির কথা শুনব যারা দক্ষিন এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার জন্য এসেছেন।

মোহাম্মদ ইকবাল হচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার একজন নাগরিক যিনি বাহরাইনে থাকেন। তিনি বাংলাদেশী একজন শ্রমিকের গল্প বলেছেন (মূল ইংরেজী থেকে অনুবাদ):

আমি সম্প্রতি একজন বাঙ্গালীকে (বাংলাদেশী) দেখেছি যে একটা হোটেলে সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। সে আসলে হোটেলের পাবলিক এলাকাতে কাজ করে, যেমন কাচের জানালা পরিষ্কার করা, বা লবির মেঝে পরিষ্কার করা। সে অতিথি কক্ষের দায়িত্বে নেই বা কামরা ঠিক করে না। এখানে কোন বিষয়টি ঠিক না? তাকে ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) ব্যয় করতে হয়েছে বাহরাইনে কাজের ভিসা পাওয়ার জন্য। তার ২ বছর কাজ করার অনুমতি আছে। প্রতিদিন ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার) বেতন দেয়া হয় তাকে, তার মানে সে প্রতিমাসে ২৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৩৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৫ হাজার টাকা) আয় করে। এটা কি বেশ ভালো বেতন? দাড়ান...! তাকে তার ফ্লাট, পানি, বিদ্যুত, খাওয়ার জন্য টাকা দিতে হয় আর এরপর অবশ্যই দেশে টাকা পাঠাতে হয়।

আমরা হিসাব করি। বাড়ির জন্য সে অনেকের সাথে একটা ফ্লাটে থাকে যেটার জন্যে ব্যয় মাসে ধরা যাক ৫০ বাহরাইনি ডিনার (১৩২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার টাকা)। এরপরে পানি আর বিদ্যুত আরো ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার), আর এরপরে খাওয়া ৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৫ হাজার টাকা)। তাহলে বাড়ীতে নেওয়ার জন্যে পুরো অর্থ বাঁচবে বাংলাদেশী টাকায় ১১৫ (৩০৫ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২১ হাজার টাকা) প্রতি মাসে। এক বছরে (১২ মাসে) সে বাঁচাতে পারবে ১৩৮০ বাহরাইনি ডিনার (৩৬৬০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় আড়াই লাখ টাকা)। এই অর্থ ভিসা বা ঢোকার ফি হিসাবে দেয়া ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) শোধ করার জন্যে যথেষ্ট না। আমার কোন ধারণা নেই এই অর্থ সরকার নির্ধারিত কিনা, কিন্তু একটা জিনিষ আমার কাছে পরিষ্কার না যে ২ বছরে সে মাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) বাঁচাতে পারে। পরিশেষে সে তার ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) বিসর্জন দিয়ে আর দুই বছর কঠোর পরিশ্রম করেছে কেবলমাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) এর জন্য। আরো দুই বছরের কাজের ভিসা বাড়াতে তাকে আবার ১০০০ বাহরাইনি ডিনার (২৬৫২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ) বিনিয়োগ করতে হবে। তার মানে দুই বছর পরে, সে পারবে বাঁচাতে ২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৬৯০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৮ হাজার টাকা) মাত্র আর আমি এখনও জানিনা সে কিভাবে এরপর তার বিমান ভাড়া দেয়। আমি আসলেই বুঝতে পারি না যেহেতু এটা যুক্তিযুক্ত না!


বাহরাইনে অবস্থিত একজন ফরাসী লেখক ফ্রান্সিন বারলেট গত মে মাসে ওমানের মাস্কাট থেকে বাহরাইনে আসার সময়ে ইয়াসমিনা নামে ভারতীয় একজন মহিলার সাথে কথা বলেছেন। এটা ইয়াসমিনার গল্প (মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ):

আমার চেন্নাইয়ের (ভারতে) জীবন খুব সহজ ছিল না, জানেন। কলেজে আমার দুই মেয়ে আছে। একদিন তারা ডাক্তার হবে। কিন্তু প্রথমে আমাকে তার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, আরো অনেক কিছুর জন্যে টাকার যোগাড় করতে হবে। আপনি জানেন, আমি কেবলমাত্র ওমানের সালালাহতে দুই মাস কাটিয়ে আসলাম। আমি গতকাল সেখানে আমার কাজ ছেড়েছি। আমি একটা ওমানি পরিবারের সাথে ছিলাম। ম্যাডামের দশটা বাচ্চা ছিল- আটটা মেয়ে আর দুইটা ছেলে- আর মে মাসের শেষে তিনি এগারোতম সন্তানের জন্ম দেবেন। আপনি বুঝতে পারছেন? এগারোটা বাচ্চা...সেটা চমৎকার। কিন্তু আমি সেখানে থাকবো না দেখার জন্য যে সেটা ছেলে না মেয়ে। আমাকে যেতে হবে। এটা কঠিন তাকে একা রেখে আসা, জন্মের এতো কাছে কোন সাহায্য ছাড়া রেখে আসা, কিন্তু আমি থাকতে পারবো না।

প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায়, তার স্বামী আমার শোয়ার ঘরে আসত। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি তাকে বলতাম, “আমি আপনার কর্মী, স্ত্রী নই। ফিরে যান, আপনার স্ত্রীর আপনাকে প্রয়োজন। নিজের বিছানায় ফিরে যান। আপনার অধিকার নেই আমার সাথে এমন করার। আমাকে বিশ্রাম নিতে দেন, আমি ক্লান্ত...”। আপনি কল্পনা করতে পারেন? দশটা বাচ্চা, বাড়ির কাজ, রান্না, কাপড় ধোয়া আর কয়েক টন ডিশডাশা আর আবায়া পোশাক ইস্ত্রী করা প্রত্যেক দিন যার সাথে ছিল চাদর, ডায়াপার আর তোয়ালে। কিন্তু আপনি জানেন, আমার কাজ করতে আপত্তি নেই। আমি অন্য কিছু কিভাবে করতে হয় জানিনা। আমি নিবেদিত। আমি কঠিন কাজকে ভয় পাইনা। কিন্তু রাত্রে আমার সাথে এমন করার অধিকার তার ছিল না। আমাকে ছোঁয়া, বিরক্ত করা। আমি তাকে থামাতে পারতাম না। জোর ছিল না... আমাকে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। দ্রুত।

বুঝেছেন, আমাদের মতো কাজের লোক যারা ভারত, শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া বা ফিলিপাইন্স থেকে আসে, তাদের দুই মাসের অর্ন্তবতীকালীন সময় থাকে, আর তার পরে তারা চুক্তি বাতিল করে ফিরে যেতে পারেনা। আমাদের পাসপোর্ট মালিকের হাতে আটক থাকে, আর তারা না চাইলে আমরা যেতে পারি না। আপনাকে আপনার দুই বছরের চুক্তি শেষ করতে হবে, বাড়িতে যেতে পারার আগে। এটাই আইন। আমি তাদেরকে বলেছিলাম আমি আমার অর্ন্তবতীকালীন সময় শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে চাই, এটা আমার অধিকার। তা সত্ত্বেও ওই গৃহস্বামী চায়নি যে আমি যাই।

এর পরে আমি খাওয়া বন্ধ করে দেই। পাঁচ দিন আমি আমার কামরা থেকে বের হইনি, আমি কিছু খাইনি, আমি স্নান করিনি। তারা ডাক্তার ডেকেছিল, আর সে পুলিশ ডেকেছিল। ওই! তারা আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। স্বামীকে আমার বাড়ী ফেরার প্লেনের টিকিট কিনে দিতে হলো, আর আমার পাসপোর্ট ফেরত দিল। এটা আইন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে খারাপ ছিল, জানেন। আমি পড়তে পারিনা। আমি বুঝতে পারিনি আমার প্লেনের টিকিটে কি লেখা আছে। বোর্ডিং এর সময়ে গালফ এয়ারের এটেন্ডেন্ট বলল যে আমার টিকিট রামানাথাপুরামের , আমার বাড়ী চেন্নাইএর না। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন? আমি প্লেনে উঠতে অস্বীকৃতি জানাই। কোথায় যাবো? রামানাথাপুরাম এমন একটা শহর যেটা আমি চিনি না। সাথে কোন টাকাকড়ি নেই, কোনো সাহায্য ছাড়া, আমার বাড়ি থেকে ৬০০ কিমি দুরে কি করব? ভাগ্যক্রমে, রামানাথাপুরাম থেকে চেন্নাই পর্যন্ত পুলিশ আমার টিকিটের টাকা দিয়েছে। সেই স্বামীটা তাদেরকে ফিরত দেবে। পুলিশরা ঠিক কাজ করেছে, জানেন। এটার খরচ পরেছে ৬০ রিয়াল (আমেরিকান ডলার ১৫৫)... আমার জন্য এক মাসের বেতন!

আমি দুবাইতে এর আগে পাঁচ বছর ছিলাম যেখানে আমি ‘লাফ’ দিয়েছিলাম (লাফ দেয়া মানে: মালিককে ছেড়ে দিয়ে, পাসপোর্ট ছেড়ে দিয়ে, অন্য কোথাও ভালো বেতনের একটা কাজ নেয়া, কিন্তু আইনসঙ্গতভাবে নয়)। আগে সৌদি আরবে আমি দুই বছর কাজ করেছি, দুই বছর ওমানে। আমি আবার আসব। এই দেশকে আমার আসলেই ভালো লেগেছে। কিন্তু এখনই না। প্রথমে আমি আমার মেয়েদেরকে দেখতে চাই আর একটু বিশ্রাম নিতে চাই।

প্রথম প্রকাশ: গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলায়আয়েশা সালদানহার রচনা থেকে অনুবাদ।

Monday, July 13, 2009

স্টে ওকে এবং স্পীড জিকিং


(পূর্ববর্তী পর্বগুলো , )

'স্টে ওকে' হচ্ছে আমস্টার্ডামে আমাদের থাকার জায়গার নাম। বিকেলে ট্রেন থেকে সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে ট্রামে করে ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম এটি একটি ব্যাগপ্যাকার্স হোটেল। এটি অনেকটা ইয়থ হোস্টেলের মত তবে এখানে পুরুষ- নারী, যুবা ও বয়স্করা সবাই থাকতে পারে। কনফারেন্স এর লজিস্টিক্স এর দায়িত্বে রয়েছে আমেরিকান বিশালদেহী মাইক যার মুখে একটি চিরন্তন হাসি ঝুলে আছে, খুবই মাইডিয়ার টাইপের। তার কাছ থেকে (ইলেক্ট্রনিক) চাবি বুঝে নেবার সময় আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বলল পড়। পড়ে দেখলাম একগাদা নিয়মকানুন। সে বলল, কিছু মনে করো না, এরা বড্ড কড়া। দয়া করে এগুলো মেনো না হলে ফাইন ২৫০ ইউরো। নিয়মগুলোর মধ্যে ছিল কোন রকম খাওয়াদাওয়া, ধুমপান, মদ্যপান, মাদক নেয়া ইত্যাদি করা যাবে না। আমি হেসে বললাম এমন ভাবে লিখেছে যেন মাদক ছেলে হাতের মোয়া। সে বলল জানো না এখানে হাশিস পাওয়া যায় কফি শপে; তাই বলে এখনই আবার তুমি কফি শপের উদ্দেশ্যে রওনা দিও না। ডিনার খেয়ে বের হয়ো।

আমার রুমে তিনটি বান্কার বেড, সাকুল্যে ছয়জন থাকা যায়। আমি নীচের এক বেড বেছে তার নীচে উঁকি দিলাম দেখি আরেকটি বেড রয়েছে বিছানা পাতার জন্যে। তার মানে কোন কিছুই চুড়ান্ত এমন ধারণা করা যাবে না। একটি টয়লেট, আলাদা বেসিন ও শাওয়ারের রুম। এক কোনায় স্যুটকেস রেখে ল্যাপটপের ব্যাগ সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমাদের ডিনারের সময় দেয়া হলো বিকেল ৬:৩০ এ। হোস্টেলের কিচেনের পাশে ডাইনিং এ লাইন দিলাম। বেশ মজাই লাগছিল, পাশের হট্টগোল করা ভেনেজুয়েলার একদল টিনএজারদের মত যেন বয়স অনেক কমে গেছে। আসলে পরিবেশ আমাদের চিন্তা চেতনার উপর ভালই প্রভাব রাখে।

সূর্য ডুবতে অনেক দেরী তাই নেপালের বসন্তের সাথে বেরিয়ে পরলাম খাওয়ার পরে। সে চালু ছেলে, রায়ান এয়ারের কিছু সস্তা প্লেন টিকেট কিনে ইউরোপ ভ্রমণের ব্যবস্থা পাকা করেছে। শুধু আমস্টারডাম-বার্লিনের টিকেট পায়নি। আমি ট্রেনে এসেছি শুনে ঠিক হলো তাকে বার্লিনের ট্রেনের টিকেট কিনে দিয়ে একটু বেড়াতে বের হব আমরা।

সেন্ট্রাল স্টেশনে যাওয়ার পর ট্রেনের টিকেট পাওয়া গেল। এরপর একটু ঘোরাঘুরি করে দাম স্কোয়্যারে আসলাম। বসন্ত সকালে এসেছে বলে ইতিমধ্যে একটি গাইডেড টুর দিয়ে ফেলেছে এই সব অঞ্চলে। সেখানে রাণীর প্রাসাদ দেখার পর হাটতে হাটতে বসন্ত আমাকে বলল আমার সাথে চল একটি জিনিষ দেখাব। আমি বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সে আমাকে নামকরা টুরিস্ট এট্রাকশন রেড লাইট এরিয়ার দিকে নিয়ে গেল। আমি তাকে বললাম তুমি এই যায়গা কেমনে চিনলা? সে বলে এতো গাইডেড ট্যুরের অংশ ছিল। সে আরও এলাকার ইতিহাস বলতে লাগল -দশ বছর আগে থেকে এখনকার কাচের বুথের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিকিনি পরা কড়া মেকাপসহ পতিতাদের কাচের দেয়ালের ভেতর থেকে শরীর প্রদর্শন আমার কাছে মোটেই রুচিকর কিছু মনে হলনা। আমি দেখতে লাগলাম মানুষকে, কারন খালের দুধারের সরু রাস্তায় পুরো গিজ গিজ করছে ট্যুরিস্ট। টিন এজার থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়ি সবাই অবাক বিষ্ময়ে হেটে হেটে দেখছে। এ যেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য, আর তার উইন্ডো শপিং। ক্যানেলে স্পেশাল বোট রাইড - রেড লাইট ট্যুর। হল্যান্ডের সেরা ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ।

পরের দিন কনফারেন্সে আলাপ হলো মধ্যবয়সী ডাচ অ্যাক্টিভিস্ট পেট্রার সাথে যিনি পতিতাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। তার ল্যাপটপে স্টীকার লাগানো 'হোরস রক' এবং এ নিয়ে ভারতে এক কনফারেন্সে তাকে কি রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে সে নিয়েও গল্প করলেন তিনি। তার বক্তব্য হচ্ছে এই রেড লাইট এরিয়ার জন্যে আমস্টারডামে অনেক ট্যুরিস্ট আসে তাই তাদের রক্ষার জন্যে আরও সুযোগ সুবিধা দিতে হবে সরকারকে। সেখানে নাপিত দেয় ৬% ভ্যাট (নিত্য প্রয়োজনীয়) আর পতিতারা দেয় ‌১৯% (লাক্সারী) ভ্যাট। কাজেই এই হার কমাতে হবে। আমি ভাবলাম কোথায় এসে পরলাম বাবা!

ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯

অবশেষে কনফারেন্স শুরু হলো। মডারেটর অ্যালেন গান (ডাক নাম গানার) বেশ মজার মানুষ। প্রথমে ছিল প্রায় ৭০ জন লোকের পরিচয়পর্ব। নাম ও ধামের সাথে তিনি জুড়ে দিলেন 'আজ আপনি কেমন বোধ করছেন' প্রশ্নটি। বেশ মজার মজার উত্তর বেড়িয়ে আসল এবং জড়তা ভাঙ্গল অনেকের। এর পরে ছিল ওপিনিয়ন স্পেক্টোগ্রাম - একটি খালি জায়গায় কাল্পনিক বিভক্তি ধরে দুটি বিপরীত মতামতের ক্ষেত্রে কার কি অবস্থান (দুই প্রান্তে, না মাঝামাঝি) তা বের করা হলো। সেগুলো ছবিতে তুলে রাখা হলো রেকর্ডের জন্যে। এরপর গানার গিয়ে কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে বা তারা তাদের অবস্থান নিয়েছে।

বর্তমান অনেক কনফারেন্সেই যেভাবে এজেন্ডা তৈরি করা হয়, সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো এখানেও। সবাই স্টিকি নোটে কি জানতে চায় ও জানাতে চায় তা লেখা শুরু করল। তারপর সবগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করা হলো। উইকিতে তোলার পর সেগুলো এরকম দাড়ালো

এই বিষয়গুলো নিয়েই কনফারেন্সের এজেন্ডাকে ঢেলে সাজানো হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে মূলত: দুটি ভাবে কার্যক্রম সাজানো হয়েছিল। ৮-১০টি বিষয় বাছা হতো একেক সেশনে এবং ইচ্ছে অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যোগ দেয়ার সুযোগ ছিল। ফলে সবাই তার সবচেয়ে আগ্রহের আলোচনায় যোগ দিয়েছে এবং আরও আলোচনায় যোগ না দিতে পারায় আক্ষেপ করেছে। ফলে অন্যান্য কনফারেন্সের মত নিজের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক বা বোরিং জিনিষ শুনতে হয়নি। শুধু শেষে সব কটি আলোচনার সামারী একেকটি দল পড়ে শুনিয়েছে যাতে অন্যেরা বুঝতে পারে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।


আরেকটি মজার জিনিষ ছিল - স্পিড-জিকিং - অনেকটা স্পিড ডেটিংয়ের মত। দৈবচয়নের মাধ্যমে নাম্বার দিয়ে পুরো গ্রুপকে ৮টি আলাদা দলে ভাগ করা হল। আটজন জিক (বা প্রযুক্তিবিদ) তাদের কোম্পানী বা কার্যক্রম সম্পর্কে বর্ণনা করতে লাগল ৪ মিনিটের মধ্যে এককটি গ্রুপের কাছে। ৪ মিনিট শেষ হতেই এক টেবিল থেকে আরেকট টেবিলে চলে গেল দলটি। এতে সুবিধা হলো কারও কোন কিছু শুনতে পছন্দ না হলে সেই টেবিল থেকে সরে গেলেই হলো বা ৪ মিনিটের বেশী বোরড হওয়া লাগল না। এভাবেই সারা দিন শেষেও সবাই ছিল পুরোপুরি ইনভল্ভড।

কনফারেন্সের আলোচনার যে অংশগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা নিয়ে আলাপ করব পরবর্তী পর্বে।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Monday, July 06, 2009

আমস্টার্ডামের পথে


সকালে রওনা হয়েছি বার্লিন হপ্টবানহফের (প্রধান রেল স্টেশন) দিকে। গাড়ীতে যাব তাই সেইভাবে সময় হিসেব করেই বেরিয়েছি। কিন্তু পথিমধ্যে দেখলাম শার্লোটেনবার্গের চারিদিকে ব্যারিকেড দিয়ে অনেক রাস্তা বন্ধ, একটি সাইকেলের রেস হবে। পুলিশকে অনুরোধ করলাম সাইকেলের বহর আসতে তো মনে হয় সময় লাগবে, মোড়ের পথটুকু ছেড়ে দিলেই আমি গন্তব্যস্থলে যেতে পারি, নতুবা আমি ট্রেন মিস করব। কিন্তু বুঝলাম বৃথা চেষ্টা, রোবটের মত নিয়মের বাইরে আর কোন কিছু বিবেচনা করাটা তাদের রক্তে নেই। আমাকে বলে কিনা এটি তো আমরা আগেই জানিয়েছি তুমি দেখোনি তাই তোমার দোষ। গাড়ীতে ঘুরে যেতে অনেক সময় লাগবে, আর কোথায় কোথায় রাস্তা বন্ধ আছে তাও জানা নেই। কি করে দ্রুত স্টেশনে পৌছানো যায় তাই ভাবছি। হঠাৎ করে মনে হলো সিটি ট্রেন (এস বান) তো আর আটকাতে পারবেনা। তাই দ্রুত নিকটস্থ এস বান স্টেশনে গিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত হপ্টবানহফে সময় মত পৌঁছুতে পারলাম।

আমস্টারডাম এর আগেও গিয়েছি, তবে স্বল্প সময়ের জন্যে। এবারের যাত্রাটি ভিন্ন -ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস ২০০৯ কনফারেন্সে যোগদান করতে যাচ্ছি। সাথে গ্লোবাল ভয়েসেসের কিছু বন্ধুরও দেখা হবে ভেবেই পুলকিত হচ্ছি।
ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের দুটি ট্রেন একসাথে লাগানো। কাধে হাত দিয়ে ঝমাঝম করে গিয়ে মাঝপথে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। না রুপকটা ঠিক হলো না। ঝমাঝম করবে কি, ট্রেনের লাইনে কোন কাটা নেই কাজেই ঝমাঝম বা ঝক্করঝক বলুন কোন শব্দই হয় না। এত বোরিং!!

স্টেশনের প্লাটফর্মের নোটিশ বোর্ডে ট্রেনের একটি ড্রয়িং আছে যেখান থেকে বোঝায় কোন বগী প্লাটফর্মের কোন জোনে থামবে। সেটি আগে থেকে দেখে রাখায় সঠিক ট্রেনে ও সঠিক বগীতেই উঠলাম। সাধারণত: ট্রেন থামে দুই মিনিটের জন্যে কাজেই ভুল হবার অবকাশ নেই। আইসিইতে ভ্রমণের একটি আরাম আছে, অনেক লেগ স্পেস, বিমানের চেয়েও আরামদায়ক সীট, কয়েক চ্যানেলে গান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, মোবাইল জোন আর চলে সর্বোচ্চ ২৫০ মাইল গতিতে। আমার বুকিং নির্দেশ করা জানালার পাশের সীটে বসলাম। কামরায় অনেক সিট বুকিং না করা যাত্রীও আছে তারা ফাঁকা সীটে বসতে পারে। তবে আমার পাশের সীট ফাঁকা রইল অনেকক্ষণ। আমি এটি মাঝে মাঝে খুব এনজয় করি। আমি এক কালো ভিনদেশী বলে মাঝে মধ্যে কিছু শেতাঙ্গ আমাকে সম্মান করে পাশের সীট ছেড়ে দিয়ে দুরে কোথাও বসে। এই বাড়তি স্পেসটুকুর সুযোগ মুফতে কোথায় পাওয়া যায় বলুন!

আমি পাসকাল মার্সিয়েরের বেস্টসেলার বই নাইট ট্রেন টু লিসাবন খুলে বসলাম, তবে কতক্ষণ পড়েই হোঁচট খেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কেন পড়া দ্রুত আগাচ্ছে না। আসলে এটি বার্বারা হারসভ কর্তৃক মূল জার্মান থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ। ভাবতে লাগলাম অনুবাদক কি ইচ্ছে করেই কিছু অংশ দুর্বোধ্য করেছেন না মূল সংস্করণের দিকে বেশী নজর রেখেছেন লেখার মসৃণতার দিকে খেয়াল না রেখে। এ বিষয় নিয়েও আলাপ হবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সে।
এবার কানে হেডফোন দিয়ে সঙ্গীতে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ করে মনোযোগে ছেদ হলো। হানোভার থেকে উঠা এক তরুণী আমার পাশে এসে বসল। তার স্যুটকেসটি পায়ের সামনে রাখলো, তাই লেগস্পেস অনেক কমে যাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আমি ইংরেজীতে বললাম যে মাথার উপরে স্যুটকেসটি রাখতে পারেন। সে বলল আমি তো তুলতে পারব না এটা। আমি বললাম নো প্রবলেম আমি তুলে দিচ্ছি। এরপর আবার সঙ্গীতে ডুবে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম কোন দেশী হতে পারে মেয়েটি। টার্কিশ? নাকী ভারতীয় উপমহাদেশের? একসময় আলাপ হলো মেয়েটির সাথে। নিউ দিল্লী থেকে এসেছে ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটে ভাইভা দিতে। মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স করেছে, এখন পিএইচডি করার ইচ্ছা। জিজ্ঞেস করলাম যে ভাইভা দিতে এতদুর এসেছে কেন। বলল যে শর্ট লিস্টে থাকা অ্যাপ্লিকান্টদের আসা যাওয়া থাকার খরচ ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটই দিচ্ছে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হোক বা না হোক। ভাল ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে তাদের এই পরিমাণ উদ্যোগ দেখে অবাক হওয়ারই কথা। ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্টে সে নামবে দিল্লির প্লেন ধরবে তাই। আমি নেমে গেলাম ডুইসবুর্গে, ট্রেন চেন্জ করতে। আধা ঘন্টা সময় ছিল তার মধ্যেই পিজ্জা দিয়ে লান্চ সাড়া হলো।

এর পরে আবার যাত্রা শুরু হলো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম কখন বর্ডার পার হব সেটি খেয়াল করার জন্যে। নাহ, এবারও ব্যর্থ হলাম। কখন নেদারল্যান্ডে ঢুকে গিয়েছি টের পাইনি। একটি শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার সাইন দেখে টের পেলাম। শেনঘেন চুক্তির আওতায় যে সমস্ত ইউরোপীয় দেশ আছে তাদের বিপুল পরিমান কর্মঘন্টা প্রতিদিন বেচে যায় এই ভিসা/ইমিগ্রেশন উঠিয়ে দেবার কারনে। আর লোকজনেরও কত আরাম! অথচ ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে কি হ্যাপা পোহাতে হয় আর কত ঘন্টা নষ্ট হয় ভিসি/ইমিগ্রেশনের কারনে সেটা ভাবলে কষ্ট হয়।

ওপেন ট্রান্সলেশন:

এই বিষয়ে বলতে গেলে ওপেন সোর্স আন্দোলনের কথা বলতে হয়। এটি আসলে ব্যাপক আলোচনার বিষয়, আমি শুধু সংক্ষেপে বলব। এখানে ওপেন মানে হচ্ছে রয়্যাল্টি বিহীন এবং সোর্স মানে হচ্ছে সোর্স কোড, অর্থাৎ যেই সোর্স কোড সবাই অ্যাক্সেস করতে পারে। এই টার্মটি প্রথম অফিশিয়ালি ব্যবহার করা হয় ১৯৯৮ সালে আয়োজিত "ফ্রিওয়্যার সামিটে"। পরবর্তীতে এই সামিটের নামকরণ করা হয় ওপেন সোর্স সামিট। সে বছরই ওপেন সোর্স ইনিশিয়েটিভ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে যা বিশ্বব্যাপী ওপেন সোর্স আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাজ শুরু করে।
এসপায়ারেশনটেক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি এনজিও যারা বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার তৈরী, কমিউনিটি এবং নেটওয়ার্কিং সুবিধা দেয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচী আয়োজন করে। তারা এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫টি বিভিন্ন ইভেন্টের আয়েোজন করেছে নানা ডোনরের সহযোগীতায়। তাদের আরেকটি সাফল্য বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার টুলসের একটি পোর্টাল তৈরী করা যার নাম সোশ্যাল সোর্সেস কমন্স

২০০৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে তারা প্রথম ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সের আয়োজন করে। সেখানে ওপেন সোর্স ট্রান্সলেশন টুলস এবং ওপেন কন্টেন্ট অনুবাদের ব্যাপারটি নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়।

আসলে ট্রান্সলেশন বা অনুবাদ সারা বিশ্বে একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। অনুবাদের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে এবং এর জন্যে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়। উদাহরণস্বরুপ ইইউর প্রতিটি কার্যাবলী বা স্টেটমেন্ট যা প্রকাশিত হয় তা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর ২৫টিরও বেশী সদস্যদেশের ভাষায় অনুদিত হতে হয়। মার্কিন সরকারের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষা (আরবী, ফার্সী) ইত্যাদিতে প্রকাশিত সংবাদ, ব্লগ, ওয়েবসাইট ইত্যাদি অনুবাদ করে মনিটর করার জন্যে। এইসব সংগঠনের প্রচেষ্টা মেশিন ট্রান্সলেশন সফ্টওয়্যার তৈরী যা তাদেরকে কম খরচে অনুবাদের সুবিধা দেবে। ওপেন সোর্সেও কিছু মেশিন ট্রান্সলেশন সুবিধা আছে যেমন গুগল ট্রান্সলেট। কিন্তু কোন মেশিন ট্রান্সলেশনই এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি। ভাল অনুবাদের জন্যে মানুষের দ্বারা অনুবাদের বিকল্প নেই। কিন্ত পেশাজীবি অনুবাদকের দ্বারা সেই কাজ করতে অনেক খরচ।

ওদিকে পাশাপাশি আরেক ধরনের কমিউনিটি বেইজড অনুবাদ আন্দোলন কিন্তু আমাদের অগোচরে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক সফ্টওয়্যার এখন বাংলাতে পাই। যেমন ওপেন অফিস, গুগল, ওয়ার্ডপ্রেস। এইসব লোকালাইজেশন কিন্তু সম্ভব হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি ট্রান্সলেশন দ্বারা। অনেকেই অনুবাদ করে নিজের চর্চার জন্যে বা শখের বসে। এতে টাকা পাওয়া যায়না বটে, কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়া যায় এবং হয়ত নানামুখী অনেক সুযোগ গুগল ইন ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ সেরকম একটি বড় প্রকল্প। সে তো হলো সফ্টওয়্যার। স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি দ্বারা কন্টেন্ট অনুবাদের কয়েকটি উদাহরন হলো ডটসাব (বিভিন্ন ভাষায় ভিডিও সাবটাইটেল করা), গ্লোবাল ভয়েসেস লিঙ্গুয়া প্রকল্প (ব্লগ কন্টেন্ট বিশটির মত ভাষায় অনুবাদ), টেড ওপেন ট্রান্সলেশন প্রকল্প ইত্যাদি। এসবই ওপেন ট্রান্সলেশনের উদাহরণ।
(আগামী পর্বে থাকবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯ এবং আমস্টার্ডামের গল্প)

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Sunday, July 05, 2009

বহুভাষী ওয়েব এবং উন্মুক্ত অনুবাদ


এমন এক সময় ছিল যখন তথ্য শুধু লাইব্রেরী, বা সরকারী তথ্যাগারে থাকত। মানুষের কাছে তা সহজলভ্য হতো বই বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু ইন্টারনেটের প্রথম বিপ্লব এই বাধাকে ঘুঁচিয়ে দিল। বিভিন্ন স্ট্যাটিক ওয়েব পেইজের মাধ্যমে এবং অনলাইন সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ চলতে লাগল।

এরপর আসল ইন্টারনেটের দ্বিতীয় জাগরণ। এটি ভেঙ্গে দিল কারা তথ্য সৃষ্টি করবে তার মনোপলি। লক্ষ কোটি মানুষ ডিসকাশন ফোরাম, ব্লগ, ছবি, ভিডিও ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্যের সৃষ্টি ও আদান প্রদান করতে লাগল বিশ্বব্যাপী পাঠক-শ্রোতাদের জন্যে।

কিন্তু তথ্যের মনোপলি কি ভেঙ্গেছে? তথ্য আগেও উৎকৃষ্ট পণ্য ছিল, এখনও আছে। যেই তথ্যের চাহিদা বেশী, যোগান কম, তার মূল্য তত বেশী। বর্তমানে তথ্যের চাহিদা একই আছে (মানুষের তথ্য গ্রহণ করার ক্ষমতা অপরিবর্তিত আছে)। কিন্তু এখন তথ্যের যোগান অনেক। কিবোর্ড টিপলেই ডজনখানেক বাংলা পত্রিকা পড়া যায় আর ইংরেজীতো অগুণতি। তথ্যের এই বিস্ফোরণকে কেভিন কেলী বলেছেন দ্যা এক্সপানশন অফ ইগনোরেন্স। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে যত বেশি তথ্য সহজলভ্য হচ্ছে তত আমাদের প্রশ্ন বেড়ে যাচ্ছে এবং উত্তরের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের উত্তরের যোগানের বিপরীতে প্রশ্নের হার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অজ্ঞানতা বাড়ছে। এটাকেই তিনি বলছেন দ্যা এক্সপানশন অফ ইগনোরেন্স।

তথ্যের প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে অপ্রক্রিয়াজাত তথ্যের মূল্য কমে যায় এবং মূল্য থাকে সেই সব তথ্যের যা আমাদের কাছে সংকলিত, অনুবাদিত, সহজবোধ্য; আমাদের বোধগম্য অবস্থায় যা পাওয়া যায়।

আপনি চিন্তা করুন দশ বছর আগের ইন্টারনেটের কথা। তখন বাংলা ইউনিকোড ছিল না। বাংলা ভাষায় কটি ডকুমেন্ট পাওয়া যেত? আজকে বাংলা উইকিপিডিয়ায় ২০০০০ এরও বেশী এন্ট্রি আছে। বাংলা ব্লগগুলোতে হাজার হাজার পোস্ট (যদিও যথার্থতা, মান নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকগুলোর)। কয়েক বছর আগের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাঁচ কোটি ব্লগের ৩৯% ইংরেজী ভাষায় ছিল। এর পরে ছিল জাপানী (৩৩%), চৈনিক (১৪%), স্প্যানিশ (৩%), ইটালিয়ান (৩%), রাশিয়ান (২%), ফ্রেন্চ (২%), পর্তুগীজ (১%), জার্মান (১%) ইত্যাদি। বর্তমানে এই পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই অনেক বদলেছে, ইংরেজী ভাষার আধিপত্য কমে অন্যান্য ভাষার জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারন সবাই তার নিজের ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।

তবে ইথান জুকারম্যান বলছেন যে আজকের ইন্টারনেট পরিমন্ডলে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার ভয় রয়েছে। আগের ইংরেজী ভাষার আধিপত্যের সময় পাঠকরা ভাষার বাধা ডিঙ্গিয়ে এক ভাষায় কথোপকথনের চেষ্টা চালাতো। বর্তমানে নিজের ভাষায় কথোপকথনের সুবিধার কারনে ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন ভাষা ভাষাভাষীদের কমিউনিটিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানেই ব্যস্ত বেশী এবং অন্যান্য ভাষার কমিউনিটির সাথে যোগাযোগে আগ্রহী নয়। বা আগ্রহী নয় অন্যান্য ভাষায় পাওয়া যাওয়া বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে।

বিশ্বের অনেক কিছুই আমরা ভাষা জানি না বলে অন্যের দৃষ্টিতে দেখি। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর বই বাংলায় অনুদিত হচ্ছে কি না বলে হা পিত্যেশ করে বসে থাকি, যাও হয়ত অনুবাদ করা হবে ইংরেজী অনুবাদ থেকে।
ভাষার বাধা তথ্য প্রবাহে মস্ত বড় বাধা। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পাওয়া যাওয়া ইন্টারনেট কন্টেন্টের কত অংশ বুঝতে পারি? এমন তথ্য নিশ্চয়ই আছে যা আমি জানতে চাই কিন্তু ফার্সী ভাষায় আছে বলে জানতে পাচ্ছি না। কিন্তু এই বাধা দুর করার উপায় কি?

বর্তমানে বেশ কিছু ভাষার জন্যে মেশিন ট্রান্সলেশন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। গুগল ৪২টি ভাষা সাপোর্ট করে, কিন্তু তার মধ্যে বাংলা নেই। আর মেশিন অনুবাদের মানও আশানুরুপ নয়। মেশিন ট্রান্সলেশন নিয়ে কাজ করছে এমন এক প্রযুক্তিবিদের সাথে আলাপ করে জানলাম যে আগামী দশ বছরেও পার্ফেক্ট অনুবাদ প্রযুক্তি আবিষ্কারের সম্ভাবনা কম। কারন অনুবাদের সাথে স্টাইল, প্রাসঙ্গিকতা, সাংস্কৃতিক পটভূমি ইত্যাদি জড়িত এবং এটি শিল্প বলেই একে লজিকের দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা যায় না। মেশিন অনুবাদের দ্বারা খুঁটিনাটি ও খাপছাড়া কাজ চলবে কিন্তু রিসার্চ বা প্রচলিত অনুবাদের জন্যে মানুষ কর্তৃক অনুবাদের বিকল্প নেই।

সারা বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষ একের অধিক ভাষা জানে। যে বাংলা এবং হিন্দি জানে, সে সহজেই হিন্দি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে পারে (যা মেশিন অনুবাদের মাধ্যমে সম্ভব নয়, এখনো)। অনেকেরই সময় আছে তা করার জন্যে। ওপেন সোর্সের মত ওপেন ট্রান্সলেশন ও একটি আন্দোলন যার মাধ্যমে ইতিমধ্যে বেশ অনেকগুলো সফল কাজ হয়েছে বিশ্বের অনেক ভাষায়ই। বাংলার ক্ষেত্রে কলাবরেটিভ ট্রান্সলেশন এবং লোকালাইজেশন এর উদাহরণস্বরুপ বাংলা উইকিপিডিয়া, গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা সংস্করণ, ওয়ার্ডপ্রেস বাংলা লোকাইলেজেশন প্রকল্প মেঘদুত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

একটি বাংলা মেশিন ট্রান্সলেশন প্রকল্প - অনুবাদক কাজ করছে সেটিও ক্রাউডসোর্সিং (স্বেচ্ছাসেবীদের ইনপুট) এর মাধ্যমে এগিয়ে চলছে।

ইন্টারনেটকে আমাদের নিজস্ব ভাষায় সহজবোধ্য করার জন্যে দরকার বিভিন্ন টুল এবং আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবী। যে যেই দ্বিতীয় ভাষা জানেন সেই ভাষার কন্টেন্ট যদি বাংলায় অনুবাদ করেন ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন তাহলে বাংলা ভাষা ইন্টারনেটে প্রাণ পাবে। বেশী পরিমান লোক অনায়াসে তথ্য পাবে যা এখনও সহজলভ্য নয়।

ইথান জুকারম্যানের কথা দিয়েই শেষ করি:
"For the internet to reach its potential in bridging human differences, we need to make the problems of language and translation center to our conversations about the future of the internet."
অনুবাদের ভারটুকু আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

বি: দ্র: গত মাসে আমস্টারডামে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সে অংশ নেয়ার পর তা নিয়ে লিখব লিখব করছিলাম। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এটি তার পটভূমি মাত্র। পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব।

(ছবির সূত্র)

 প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Friday, July 03, 2009

অন্কেল আর টান্টে ক্লুটজকোভস্কি

ক্লুটজকোভস্কি দম্পত্তি
আশি বছর বয়সী এই জার্মান বুড়ো এবং তার স্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি? তাদের সাথে দেখা হওয়ার আগে তা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করার উপায় ছিল না।

হঠাৎ করেই এক দাওয়াতে পরিচয় তাদের সঙ্গে। উনি প্রথমেই উপস্থিত সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন যে তার ইংরেজী জ্ঞান খুবই সীমিত। ওনার স্ত্রী একেবারেই পারেন না, তাই আমাদের কারও কারও কথা অনুবাদ করে দিতে হচ্ছিল। পাশে বসেছিলাম বলেই অনেক কথা বলার সুযোগ হলো এবং আস্তে আস্তে আমরা সত্তুরের দশকে চলে গেলাম। আশে-পাশের সব কিছুই তখন গৌণ মনে হতে লাগল।

১৯৩০ সালে জন্ম হর্সট ক্লুটজকোভস্কির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার অনেক অংশই চোখের সামনে দেখা। বাস তার বৃহত্তর বার্লিনের বুখ অঞ্চলে। ১৯৭২ সালে তিনি একটি ফিল্ম স্টুডিওতে কাজ করতেন। তিনি ছবি তুলতেন আর তার স্ত্রী সাহায্য করতেন তা প্রসেস করতে। হঠাৎ করেই তার কাছে খবর এল বাংলাদেশ থেকে কিছু আহত যোদ্ধা এসেছে বুখের সলিডারিটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। বাংলাদেশ! তার স্ত্রী বলছিলেন যে সাধারণ: জার্মানদের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবাই হচ্ছে ইন্ডার (ভারতীয়)। ভারত সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনী জানা থাকায় তাদের সম্পর্কে কৌতুহলও কম ছিল না। তাই তারা ছুটে গেলেন এই যোদ্ধাদের সম্পর্কে জানতে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটি ডকুমেন্টারী করার। সেটি করলেনও এবং তার থেকেও বেশী এই বাদামী কিছু মানুষের টান্টে (মাসী) আর অন্কেল (কাকা) হয়ে গেলেন চিরদিনের জন্যে।

পূর্ব জার্মানী হচ্ছে তৃতীয় দেশ যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় (১১ই জানুয়ারী ১৯৭২)। এর পরেই ধাপে ধাপে বেশ কিছু আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্যে। এদের প্রাথমিক সমস্যা ছিল ভাষা। অন্কেল হর্সট তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী দিয়ে এদের সাহায্য করতে থাকেন।

টান্টে বলছিলেন যে নার্স খাবার নিয়ে এসেছে। মসলা ছাড়া আলু ভর্তা আর সব্জি দেখে আহত যোদ্ধা বলে চলে নো নো রাইস, রাইস। নার্স বুঝতে পারছে না কি করবে। তখন তিনি নার্সকে বলে সস বা ভাত যোগ করে কিছুটা খাবার উপযোগী করে দেন। একজনের কনুই থেকে দুই হাত কাটা পড়েছে। টান্টে প্রতিদিন চলে যেতেন তার কাছে। বাহু দুটো চুলকে দিলে কিছুটা আরাম পেতেন যোদ্ধা। পরম মমতাভরা তাদের এইসব সাহায্য বাঙালী যোদ্ধারা কৃতজ্ঞতা ভরে এখনও স্মরণ করে, তারা বললেন।

সে অনেক নাম; হারুন, হক, দৌলা, শেরু যাদের তারা শুশ্রূষা করেছেন। আমি অধিকাংশকেই চিনতে পারলাম না, চেনার কথাও না। এর পর ব্যাচের পর ব্যাচ আহত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে যেতে লাগল পরবর্তী কয়েক বছরে। তারা পূর্ব বার্লিনে নেমেই অন্কেল-টান্টের খোঁজ করতে লাগলেন। শেরুর (প্রাক্তন কুটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী) কথা বলতে থাকলেন যে শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল কারন পায়ের হাড্ডি চূর্ণবিচুর্ণ হয়েছিল। ডাক্তাররা মনে করেছিলেন বাঁচাতে পারবে না। অপারেশনের দিন সারারাত টান্টে জেগে ছিলেন। তারপর ভালো হয়ে যাওয়ার পর পায়ের ব্যান্ডেজের জন্যে প্লেনে ফিরতে পারছিলেন না শেরু। বিশেষ কার্গো প্লেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হলো তিন মাস। এ তিন মাস তিনি টান্টে-অন্কেলের কাছেই নিজের ছেলের মত ছিলেন এবং খুব ভালোভাবে জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। এভাবেই নানাপ্রকারে এই দম্পতি বাঙ্গালীদের সাহায্য করেছেন।

তিনি শুনেছেন যোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি তার ডকুমেন্টারিটি বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছিল নাকি ৭৩-৭৪ সালে। আমি জিজ্ঞেস করলাম জার্মানিতে প্রচারিত হয়নি? তিনি বললেন, "না" এবং আর কিছু বললেন না। আমি নাছোরবান্দা ভাবে জিজ্ঞেস করেতে লাগলাম ডিডিআর সরকারের ভূমিকা ছিল কত বাঙ্গালীদের সাহায্য করায়?

তিনি তখন বলা শুরু করলেন, "আমি যা করেছি ব্যাক্তিগত ভাবেই করেছি। আমি জানি যুদ্ধের বিভীষিকা কি। আমি যখন তাদের সাহায্য করা শুরু করি তখন নানা পক্ষ বিভিন্ন ভাবে ব্যাপারটি দেখে। বাংলাদেশ এম্ব্যাসী থেকেও আমার ডাক শুরু হয়, যেন আমার কাজই তাদের সাহায্য করার। আমার বাসায় কয়েকজন বাঙ্গালী থাকা অবস্থায় আমি লক্ষ্য করলাম আমার বাড়ীর সামনে পুলিশ পাহাড়া। আমি ভাবলাম ডিডিআর সরকার হয়ত তাদের সিকিউরিটির জন্যেই রেখেছে। কিন্তু ক্রমেই পরিস্কার হতে লাগলো আমি তাদের পূর্ণ নজরদারীতে। এম্ব্যাসীর সাথে যোগাযোগও তারা ভাল চোখে দেখে না। আমার বাড়ীতে যেসব গাড়ী আসে সেসবের নম্বর প্লেট তারা টুকে নেয়। দুই জার্মান একত্রীকরণের পরে পুরোনো স্টাসী রেকর্ডগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে আমার ফাইলে দেখে এসেছি - আমার বিরুদ্ধে সন্দেহ করা হচ্ছিল যে আমি গোয়েন্দাবৃত্তি করে বাংলাদেশে তথ্য পাচার করছি।"

বাংলাদেশে কখনও জাননি? জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন "পূর্ব জার্মান সময়ে সেটা তো সম্ভবই ছিল না। শেরু ইতালীর দুতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমাকে রোমে নিয়ে যাবার জন্যে ডিডিআর এর মন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ করে। কিন্তু ছাড়পত্র মেলেনি। আর এখন তো বুড়ো হয়ে গেছি, আমার স্ত্রীর প্লেনে চড়া মানা।"

এতসব বাধা-বিপত্তি সত্বেও বাঙ্গালীদের প্রতি তাদের স্নেহ কখনো কমেনি। তিনি বললেন এখনও মাঝে মধ্যে তিনি ফোনকল পান "হাই অন্কেল, হাউ আর ইউ। আর ইউ স্টিল ড্রাইভিং ইওর কার? দেন ইউ আর স্টিল ইয়ং।" আর তাদের স্মৃতি রোমন্থন করে বুড়োবুড়ির দিন কাটে।

আমি বললাম আপনার কাছে এত গল্প এগুলোতো প্রকাশ করা উচিৎ। লিখেই ফেলুন না একটি বই। উনি বললেন "হ্যা আগে তো সম্ভব ছিল না। এখন তা করাই যায়।" কিন্তু কথা আর এগুলো না, কারন সবারই যাওয়ার পালা।

আমি ভাবতে লাগলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই যে নানা গল্প রয়েছে সেগুলো হয়ত একসময় এমন মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। অন্কেল-টান্টের মত এইসব সুহৃদরা কি অনুল্লেখিতই থেকে যাবে?

তাদের নিয়ে কোন লেখা বা তাদের ডকুমেন্টারিটি নিয়ে কোন রিপোর্ট চোখে পড়েনি। কেউ যদি কখনও খুঁজে পান জানালে বাঁধিত হব।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন