Sunday, January 28, 2007

আমাদের ওয়াহিদ ভাই

ওয়াহিদ ভাই অনেকের থেকেই আলাদা ছিলেন। যারা সাংবাদিকতা, ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসি কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন অথবা রবীন্দ্র সঙীতের সাথে কোন ভাবে যুক্ত তারা অবশ্যই ওয়াহিদ ভাইয়ের নাম শুনেছেন বা তার সংস্পর্শে এসেছেন। ১৮ বছরের তরুন কিংবা ৬০ বছরের প্রৌঢ় সবার কাছেই তিনি ওয়াহিদ ভাই। অত্যন্ত মৃদুভাষী ছিলেন তিনি। তার বাংলা কিংবা ইংরেজী ভাষার উপর দখল ছিল অসাধারন। বনেদী পরিবারে জন্ম (বাবা সাংসদ ছিলেন) তার। প্রচুর ভ্রমন করেছেন তিনি দেশে ও দেশের বাইরে। তার সামর্থ অনুযায়ী তিনি দেশের একজন ক্ষমতাধারী ব্যক্তিত্ব হতে পারতেন । কিন্তু তিনি সারা জীবন অত্যন্ত সাধারন জীবন যাপন করেছেন। নিজের নাম নয় নিজেকেই সম্প্র্রসারিত করেছেন তিনি দেশের আনাচে কানাচে। তাকে সবসময় দেখেছি পানজাবী পাজামা ও শান্তিনিকেতনী ঝোলা কাঁধে।

তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল যে মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। অত্যন্ত ট্যালেন্টেড মানুষ ছিলেন তিনি। একজন ভালো সাংবাদিকের যা থাকা দরকার - সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি বা ভাষা সব বিষয়েই ভালো দখল ছিল তার। তিনি সহধর্মিনী অধ্যাপিকা সনজিদা খাতুনকে নিয়ে ১৯৬২ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার প্রচার মাধ্যমে 'রবীন্দ্রনাথ' নিষিদ্ধ করলে উনি ছায়ানটের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গানের আসর শুরু করে মূলত রবীন্দ্র সংগীত এর মাধ্যমে। ১৯৭২ সালের পর এটি জাতীয় অনুষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াহিদ ভাই তার টিম নিয়ে বাঙালী শরনার্থীদের সাথে কলকাতা যান এবং ওখানে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে শরনার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। উনি স্বাধীন বাংলায় ছায়ানট সম্প্রসারনের পাশাপাশি কনঠশীলন, আনন্দধ্বণি ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন যার হাজার হাজার কর্মী দেশের সাংস্কৃতিক অঙনকে সমৃদ্ধ করেছে। সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে তোলা ছাড়াও একজন ভাল মানুষ হবার তাগিদ দিতেন সকলকে। রবীন্দ্র সঙীতের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আনচলিক সংগঠনের তিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং বাৎসরিক প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবীন্দ্র সঙীত প্রসারে অবদান রেখেছেন। তিনি নিজেও ভাল রবীন্দ্র সঙীত গেয়েছেন এবং এর শুদ্ধতা সম্পর্কে সর্বদাই সরব ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙনে তিনি ছিলেন অনেকের কাছেই দেবতাতুল্য। একজন মানুষ হিসাবে তার কিছু খারাপ দিকও হয়তো ধরা পড়েছিল কারো চোখে। তবে সেটাই স্বাভাবিক নয়কি? একজন মানুষ কখনই সমালোচনাবিহীন হতে পারে না। তার কৃতকর্ম, অপরের হৃদয় ছুয়ে যাওয়াটুকুকেই মানুষ মনে রাখে।

তার লেখার একটি বৈশিষ্ট ছিল যে তিনি অত্যাধিক শুদ্ধ ও অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করতেন। অবশ্য উনি গত দশকে তার খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে এসে খুব সাধারন ভাষা ব্যবহার শুরু করেন।

আমার ওনার কাছে একটি ব্যক্তিগত ঋণ স্বীকার করার আছে। ওনার সানি্নধ্যে যতটুকু এসেছি তার মধ্যে একবার আমাদের বইয়ের লাইব্রেরি করার উৎসাহ দিয়েছিলেন । বলেছিলেন একটি ভেতরকার ইচ্ছা দরকার বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে। তার সেই প্রেরনায় আজ আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ হাজারেরও অনেক উপরে। তার কথাগুলো এখোনো আমার কানে বাজে "ক'শো বই আছে তোমার?" ।

ওয়াহিদ ভাই তো গেলেন। কিন্তু আমরা কি আর এক ওয়াহিদ ভাইকে অচিরেই পাবো? এই প্রশ্নটা হয়ত আমি এখন থেকে করতেই থাকবো।

Friday, January 26, 2007

বাংলা একাডেমীর 'স্মৃতি: ১৯৭১' সিরিজ ৪র্থ খন্ড থেকে উদ্ধৃতি

"পাকিস্তানীরা আমাদেরকে বলে, আমরা হিন্দু জারজ সন্তান, নিজেদের মুসলমান বলার কোন অধিকার নাকি আমাদের নাই। রাগ হলে আমাদের বাঙালী কুত্তা, গাদ্দার বলে ডাকে। এই রকম নানা প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে বাঙালীদের কাজ করতে হতো। বাঙালীরা ভালো কাজ করে সুনাম ও প্রমোশন পাক এটা পাকিসতানিরা সহজে চাইত না । বাঙালী অফিসারকে ডিঙিয়ে তাদের প্রমোশন হতো । এইভাবেই বাঙালী অফিসার, সেপাহীদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

মোয়াজ্জেমকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন ভারত পালিয়ে যেতে। শুনে ভীষন রেগে গিয়েছিলেন, ভারতে আমি যাব না, ভারতের কাউকে বাংলার মাটিতে আসতেও দেব না। তাছাড়া মরতেই যদি হয় নিজের দেশের মাটিতে নিজের মানুষের সাথেই মরব ।

'বোল পাকিস্তান জিন্দাবাদ' মোয়াজ্জেমের উপর পাচটি রাইফেল টার্গেট করে বলে। বীরদর্পে উনি তর্জনী উচিয়ে বলেছিলেন 'এক দফা জিন্দাবাদ' । কারন তার দফা একটাই 'বাংলাদেশ স্বাধীন করা'। গর্জে উঠল একসাথে ৫টি রাইফেল। পড়ে গেলেন মাটিতে। সেখান থেকেই আবার বললেন 'এক দফা জিন্দাবাদ'।"

- কোহিনুর হোসেন, স্বামী, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দ্বিতীয় অভিযুক্ত) প্রসঙে।

"তোমার ছেলে মুক্তি? শান্ত কন্ঠে অধ্যাপক বলেন আমার ছেলে এখন সৈনিক। দেশ স্বাধীন করতে গেছে। কথা শেষ হবার আগেই গুলি। আহত হয়ে অধ্যাপক আহমেদ বলেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। ক্রুদ্ধ সৈন্যরা তখন তার জিহ্বা কেটে দেয়, বেয়নেট দিয়ে খোচাতে খোচাতে হত্যা করে। "

- নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ, শিক্ষক ডা: শামসুদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণে

"মওলানা কসিমুদ্দিন ছিলেন অসামপ্রদায়িক । তাকে ৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সাথিয়া এলাকার জনৈক জামাত কর্মী।"

- জিয়া হায়দার, শিক্ষক মওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ প্রসঙে

"যাদের রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা গড়া, আজ পর্যন্ত তার কতটুকু মুল্যায়ন হয়েছে? কি কৈফিয়ত দেবে এই দেশবাসী শহীদদের সন্তানের কাছে? তাদের পিতার রক্তের মুল্য কি?"

- রহীমা খাতুন, স্বামী পেশাজীবি আমিনুল ইসলাম প্রসঙে।

"২৮শে এপ্রিলের রাজশাহীগামী কোচ ধরা পড়ল মিরপুরের বিহারীদের হাতে। ওটাতেই আমার মেঝভাই ছিলেন। এইটুকুই তার হারিয়ে যাওয়ার খবর। আমার ভীরু ভাইটিকে কে বা কারা, কোথায়, কি ভাবে মারে, আমরা তা জানতে পারিনি।"

- ফজলুন্নেসা নার্গিস, ভাই প্রকৌশলী আবু সালেহ মো: এরশাদুল্লাহ প্রসঙে।

"নিহত শত শত বীর সন্তানদের নাম ও ঠিকানা পাওয়া যাবে না। তাই আমার ধারনা। যুদ্ধে তো অনেকেই শহীদ হলো এখানেও রাজনীতি। যখন যে চেয়ারে বসেন শুধু সে তার পক্ষের লোক নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন এবং তার দলের লোকের নাম লিপিবদ্ধ করেন ইতিহাসের পাতায়। এইভাবেই প্রতিযোগিতা চলছে ইতিহাসের পাতা দখল নিয়ে। সেখানেও চর দখলের মত যুদ্ধ হচ্ছে অহরহ। এরই মাঝে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকরা গুছিয়ে নিয়েছে তাদের আখের ও সামাজিক স্বীকৃতি। আর আমরা দর্শক এই নাটকের মনচে দাড়িয়ে আছি।

পুর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির শহীদ বিপ্লবী প্রকৌশলী সিরাজ সিকদার এর বড় ভাই বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদ প্রকৌশলী বাদশা আলম শিকদার এর গর্বিত বাবা মাকে কোনদিনও প্রচার মাধ্যমে ডাকা হয় নাই এমনকি তার নামটাও উচ্চারন করা হয় নাই।

পাক আর্মিরা আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিগ্গেস করেছিল কোথায় তোমার সন্তানেরা। বাঙালীরাতো সবাই হিন্দু, তোমরা মুসলমান হয়ে কেন হিন্দুদের সাথে যোগ দিয়েছ? তোমরা হাত দিয়ে কেন খাও, এটাতো হিন্দুরা করে, তোমরা কাটা চামচ দিয়ে খেতে পারনা?"

- ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার, ভাই প্রকৌশলী বাদশা আলম শিকদার স্মৃতিচারণ

Tuesday, January 23, 2007

বাংলা একাডেমীর 'স্মৃতি: ১৯৭১' সিরিজ ৩য় খন্ড থেকে উদ্ধৃতি

"জনগনের যুক্তিসংগত দাবী যে প্রাদেশিক ভাষা বাংলাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান ২ হাজার মাইল, ভাষার কোন মিল নেই এমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভাষা দুইটি করাই সংগত। সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোকেরই মাতৃভাষা বাংলা (১৯৫২ সালের পরিসংখ্যান)। পুর্ব পাকিস্তানের কত লোক বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে?

মিলিটারীরা আমাকে হয়ত এখানেই গুলি করে মারবে। আমার বিশেষ অনুরোধ, তোমরা আমার লাশটা বারান্দায় ফেলে রেখো যাতে সকলে আমার মৃতদেহ দেখে মনে মনে সাহস পায় বিদ্রোহ করার জন্যে।"

-- শহীদ ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পৌত্রি আরমা গুনের স্মৃতিচারনে।

"আমরা গ্রামের বাড়ী চলে যাবার পনের দিন পরেই বাবা গিয়ে হাজির হলেন- সাথে চারটে হিন্দু পরিবারের ৩০/৩৫ জন সদস্য। বাগেরহাট শহরে ঢোকার পর পাক-আর্মিদের প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের হত্যা করা এবং লুটপাট চালানো। শহরে নিরাপত্তার অভাব বলেই বাবা ওদের নিয়ে গ্রামে এসেছেন। আমাদের গ্রামটা ছিল কিছুটা দুর্গম এলাকায়। পাক-আর্মি সহজে ঢুকতে পারছিল না। কিন্তু রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকদের অত্যাচারে সাধারন মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠল। সন্ধ্যা হলেই ওরা লুটতরাজ, ঘরবাড়ী জ্বালানো, মেয়েদের উপর অত্যাচার এবং একটা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিত।

ভয়াবহ রাতটা ছিল ২৮শে অক্টোবর। শত্রুরা জানত সামনা-সামনি ওরা বাবার সাথে পারবে না। তাই চোরের মত রাতের আধাঁরে লুকিয়ে থেকে পিছন থেকে গুলি করেছিল।"

- রোকেয়া খান, বাবা শিক্ষাবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন সম্পর্কে।

"আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ সৈনিক ছিলেন না। তিনি কখনো কারো অমঙল সাধন করেননি, কারো অকল্যান সাধনও করেননি। তাহলে এমন সরল ও নিরীহ মানুষটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানওয়ালারা হত্যা করল কেন? একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্য ও দালালরা কেন নির্বিচারে হত্যা করল বাংলাদেশের হিন্দুকে?

যদি এসব হত্যাকারিদের (স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি) ধরা হতো তাহলে জেরার মুখে নিশ্চয়ই সেই সত্যটি প্রকাশ করত তারা। এই মানবিকবোধশুন্য জন্তুদের ক্ষমা করে সামাজিক সংকল্পকে বিপন্ন করেছি। বড় ভুল করেছি আমরা।"

-- মমতাজউদ্দিন আহমেদ, শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত স্মৃতিচারনে।

"মুসলিম লীগের স্থানীয় দোসররা হানাদার বাহীনিকে সাথে নিয়ে গ্রামে গ্রামে চিহ্নিত করে দিয়েছিল হিন্দুদের এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের।"

- প্রফুল্লরন্জন সিংহ, বাবা সমাজসেবী নূতনচন্দ্র সিংহ সম্পর্কে।

"একদিন সন্ধ্যার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের পিছনে, রেল লাইনের কাছাকাছি তাঁদের সকলকে পিছনে হাত বেঁধে জল্ল্লাদেরা একটা নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা একটি বড় গর্তের পাশে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। কেউ নিহত, কেউ মারাত্মকভাবে আহত, আবার কেউবা অল্প আহত হয়েছিলেন। যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁদের মৃত্যুর আগেই জল্লাদেরা সকলকে টেনে হিঁচড়ে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে তড়িঘড়ি মাটি চাপ দিয়ে চলে যায়। অল্প আহত ওই কর্মচারীটি প্রাণপণে দু'হতে মাটি সরিয়ে 'জীবন্ত কবর' থেকে কোনমতে বেরিয়ে অসেন।"

- সাঈদউদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক, নাট্যশিল্পী এম এ সাঈদ স্মৃতিচারণে ।

"না, খুঁজে পাওয়া যায়নি বাবার লাশ। প্রিয় স্বদেশের মাত্র সাড়ে তিনহাত জায়গা জুড়ে অবস্থান করবেন, বাবার অহংকারী মন হয়ত মেনে নিতে পারেনি। তাইতো স্বদেশের বক্ষ জুড়ে নিজ অস্তিত্বকে স্বাক্ষী রেখে অহংকারী হয়েছেন আমার বাবা।"

- মো: শাহেদুল ইসলাম, বাবা শিক্ষাবিদ এবিএম আশরাফুল ইসলাম ভুঁইয়া প্রসঙে।

Monday, January 22, 2007

স্মৃতি: ১৯৭১ সিরিজ থেকে উদ্ধৃতি (২)

"আজ আমাদের দায়িত্ব হবে আমাদের সন্তানদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের ঠিক দলিলটি তুলে দেয়া।"

- সেলিম আখ্তার জাহান, চাচা চিকিৎসক আব্দুল জব্বার এর স্মৃতিচারনে ।

"আপনি কি বাঙালি? আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা? আপনি কি রাজাকার আল্ বদর? আপনি কি পাকিস্তানী বর্বরতার স্বীকার? উল্লেখিত প্রশ্নগুলো আজ আমরা সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলতে চাই। কেননা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মনে হয় এদেশে কোন মুক্তিযুদ্ধই হয়নি।

বুদ্ধিজীবি হত্যা শুধু দেশীয় চক্রান্ত নয়.. তাঁর ধারনা এটি আন্তর্জাতিক..। তাঁর এই ধারনা আরও বদ্ধমূল হলো যখন তিনি জামাতে ইসলামীর তৎকালীন অফিস সেক্রেটারীর বাসায় একখানা ইংরেজীতে টাইপ করা মুল্যবান চিঠি দেখেন। চিঠিখানা ভিন দেশের বিদেশ মন্ত্রনালয় থেকে পাঠানো এবং তাতে বুদ্ধিজীবিদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।"

- জাকারিয়া হাবিব, ভ্রাতা কথাশিল্পী জহির রাহয়ান স্মৃতিচারনে।

"একটি জীবন শেষ হলো, একটি সংযোজন ছিন্ন হলো। আর ইতিহাস অবাক হয়ে রইল। হ্যা, ইতিহাস অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে আজও। গিয়াসভাইদের ধ্যানধারনা, মুক্তবুদ্ধি, বিবেক আর বাঙালী সত্বাকে ধ্বংস করে দেয়ার পায়তারা করেছিল যে পাকিস্তানীরা, তাদের ঘৃন্য উত্তরসূরীরা আজও ষড়যন্ত্র করে চলেছে এই বাংলার বুকে। পবিত্র শিক্ষাঙনে আজও তাই ঝলসে ওঠে একাত্তরের আলবদরদের উত্তরাধিকারের তীক্ষ্ন কিরীচ।"

- হামিদা বানু, ভাই শিক্ষাবিদ গিয়াসউদ্দিন আহমদ প্রসঙে।

"কারা সেই ভয়ন্কর পিশাচ, যারা এই কবিতার প্রাণকে (মেহেরুনি্নসা) ছুরিকাবিদ্ধ করে হত্যা করলো? কল্পনা করতেও শিউরে উঠি কি ভয়ন্করভাবে একসাথে বেঁধে ছুরি দিয়ে খুচিয়ে মেরেছে একটি কুসুমপ্রতীম তরুনী আর তার স্নেহের দুটো ভাইকে। মেরেছে ওরই বৃদ্ধা মায়ের চোখের সামনে। আর সেই অসহায় জননীর তীক্ষ্ন আর্তনাদে সেদিন বুঝি মীরপুরের ধুসর আকাশের বুক চিরে গিয়েছিল, কিন্তু এতটুকু কাঁপেনি সেই প্রতিবেশী অবাঙালি পশুদের বুক। "

- মকবুলা মনজুর, কবি মেহেরুনি্নসা সম্পর্কে।

"গাড়ীতে খান সেনাদের সাথে আরো ক'জন উঠে বসলো। ওরা সবাই এ শহরের বাসিন্দা..পেশায় পাহারাদার..পশ্চিম পাকিস্তানী.. কেউ বেলুচি, কেউ পাঠান..অথচ এদেশের জল-হাওয়া, মানুষের ভালবাসা এসবই ধরে রেখেছিল তাদের। তাই গভীর বিশ্বাসেই শহরের মানুষ তাদের কে দিয়েছিল প্রহরির দায়িত্ব। এই কি সেই বিশ্বস্ততার পরিচয়? গোটা শহরের দায়িত্ব ওদের হাতে তুলে দিয়ে সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে -- ওরা তখন বিশ্বাসঘাতক সেজে একের পর এক ধরিয়ে দিচ্ছে রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবিদের।"

- শোভারানী দাক্ষী, স্বামী চিকিৎষক অমলেন্দু দাক্ষী স্মৃতিচারনে ।

"স্বাধীনতা - এক স্বজন কে হারিয়ে পাওয়া আরেক স্বজন। এইতো আমার পরম পাওয়া, এইতো আমার অহন্কার।"

- সাহারা বানু , স্বামী আইনজীবি আমিনুদ্দিন স্মৃতিচারনে।

Tuesday, January 16, 2007

স্মৃতি: ১৯৭১ সিরিজ থেকে উদ্ধৃতি (১)

"এতো বছর পর হলেও আমরা কি সবাই মিলে আর একবার জেগে উঠতে পারি না?"

- মাসতুরা খানম, স্বামী মীর আব্দুল কাউয়ুম, শিক্ষাবিদ প্রসঙে

"এখনও সময় আছে, কামনা করি, বাংলার বাতাসে শহীদের দীর্ঘশ্বাস যেন শোনা না যায়।"

- যেবা মাহমুদ, বাব মামুন মাহমুদ, ডি আইজি রাজশাহী রেনজ প্রসঙে

"এখন অনেককেই মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে "গন্ডগোলের সময়" বলতে শুনি। মুক্তিযুদ্ধটা কি গন্ডগোল ছিল?"

- সুমন হায়দার চৌধুরী, বাবা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রসঙে

"দেশপ্রেমের অপরাধে ৫ই মে ১৯৭১ সালে তার প্রিয় নদীর পাড়ে তাকে হত্যা করা হলো। তার লাশ নদীতে ভাসতে লাগল।"

- হুমায়ুন আহমেদ, বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ, মহকুমা পুলিশ প্রধান সম্পর্কে

Monday, January 15, 2007

পড়ছি স্মৃতি: ১৯৭১ সিরিজ

পাকিস্তানি ঘাতকবাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালীদের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার একটি গুরুত্মপুর্ন দলিল হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত "স্মৃতি: ১৯৭১ সিরিজ"। ১৯৮৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এ সিরিজটির প্রথম থেকে ১১তম খন্ড পর্যন্ত (৬ষ্ঠ বাদে) ১০টি আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাধারন মানুষ ও বুদ্ধিজীবিদের পরিবারের সদস্য ও কাছের মানুষের বর্ননায় তাদের দেশপ্রেম ও কি পরিস্থিতিতে তারা শহীদ হয়েছেন তার মর্মস্পর্শী বিবরন আছে এই বইগুলোতে। কারো যদি পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের (প্রায় ৩৫০০০ লোক ইস্ট পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যানস দ্্বারা গঠিত) সম্পর্কে বিন্দু মাত্র সন্দেহ থাকে তাহলে সিরিজটি পড়ে দেখবেন দয়া করে।

দেখবেন রাজাকার শুধুমাত্র বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের অধিকারী নয়, এরা আমাদের আশে পাশেরই লোক, কারো প্রতিবেশী বা ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এই ধরনের লোক আজও এদেশে আছে যারা অপরের ভালো সহ্য করতে পারেনা। সুযোগ পেলেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। দেশের উন্নতির চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও মতবাদ প্রতিষ্ঠাই তাদের কাছে মূখ্য। এদের চেনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

আমরা যেন স্বার্থপর না হই। এইসব শহীদদের রক্তদান আমরা যেন ভুলে না যাই।