Thursday, December 31, 2009

দেনা

"বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা"
- উৎপলকুমার বসু

Monday, December 28, 2009

জাকার্তা বার্তা: প্রাকৃতিক সম্পদ ও দেশের অর্থনীতি


বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল জাকার্তা শহরে। ইন্দোনেশিয়াকে একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করেছে। কারণ দেশটির মূল সৌন্দর্য রাজধানীর বাইরে এবং ইতিমধ্যে জাকার্তার আশে পাশে বেশ কয়েকটি সুন্দর জায়গায় যাওয়া হয়েছে। সেইসব সম্পর্কে লেখা ও ছবি পরবর্তী পর্বের জন্যে তোলা রইল। আজ আরেকটি বিষয় নিয়ে লিখছি।
আগেই বলেছিলাম যে জাকার্তার সাথে বাংলাদেশের অনেক মিল। তবে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশ থেকে অনেক ভাল। এর একটি নমুনা হচ্ছে এ দেশে প্রচুর গাড়ি এবং মটর সাইকেল আর তাদের অধিকাংশই নিজেদের দেশে সংযোজন করা। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাকার্তা শহরে (ঢাকা শহরের দ্বিগুণ আয়তন) প্রায় ৯৫ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন আছে যার মধ্যে ২০ লাখ গাড়ি এবং ৬৬ লাখ মটর সাইকেল। শহরটিতে যানজটের কারণ হচ্ছে যানবাহনের সংখ্যা প্রতি বছর ১০% করে বাড়ছে এবং মাত্র ২% লোক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এত গাড়ি কেনার সামর্থ আছে কি না লোকের।

এখানে সরকারী গাড়ি আছে অনেক। সরকারের ছোট পদের কর্মচারীরাও গাড়ি/মটরসাইকেল পায়। বাংলাদেশের সাথে ইন্দোনেশিয়ার মূল পার্থক্য এটিই, সরকারের প্রচুর অর্থ আছে খরচ করার মত।

রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর ৩০ বছরের সরকারের সাফল্য হচ্ছে পার ক্যাপিটা জিডিপির প্রভূত উন্নতি। ১৯৬৬ সালে জেনারেল সুহার্তোর ক্ষমতা নেবার সময় ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রতি জিডিপি ছিল ৭০ ডলার যা ১৯৯৬ সালে বেড়ে ১০০০ ডলার হয় (বর্তমানে তা বেড়ে ৩৯০০ ডলার হয়েছে, বাংলাদেশের ১৫০০ ডলার)। এই ত্রিশ বছরের সাফল্যের মূলে রয়েছে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে তেল ও গ্যাস রপ্তানি। ১৯৭৩ সালের দিকে যখন তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায় তখন জিডিপি বেড়েছে বছরে ৫৪৫% করে প্রতি বছর। এই উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে প্রচুর দুর্নীতির মধ্যেও সরকার অর্জন করতে পেরেছে কিছু সাফল্য - যেমন চাল উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে ১৯৮০র দশকে। সব নাগরিকের জন্যে প্রাইমারী লেভেলে শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সফল পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলন। প্রচুর বিদেশী কোম্পানী এদেশে আসে উৎপাদনের ফ্যাক্টরি বসানোর জন্যে। তবে তবুও সুহার্তোর শাসনের শেষের দিকে প্রায় ৮০% ইন্দোনেশিয়ান প্রতিদিন প্রায় ১ ডলারের কিছু বেশী আয় করত। অর্থাৎ এই বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ধনীদের আরও ধনী করেছে আর গরীবরা গরীবই থেকেছে। সুহার্তো পরিবারের সম্পত্তি ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং সে বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা

তেল এবং গ্যাস (দৈনিক দশ লাখ ব্যারেল উত্তোলন) ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার রফতানির তালিকায় রয়েছে তৈরি খনিজ, ইলেকট্রনিক্স, পোষাক, রাবার, প্লাইউড ইত্যাদি। আর তাদের রয়েছে গ্রাসবার্গ স্বর্ণখনির আয়।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণখনি এবং তৃতীয় সর্ববৃহৎ তামার খনি গ্রাসবার্গ ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া দ্বীপে অবস্থিত। এর বেশীর ভাগ শেয়ার রয়েছে আমেরিকার ফ্রিপোর্ট ম্যাকমোরানের (৬৭%) এবং বাকিটুকু ইন্দোনেশিয়ার সরকারের। এই মাইনে কাজ করে প্রায় বিশ হাজার লোক। বছরে এটি প্রায় ৫৮,৫০০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ, ১৭৫,০০০ কেজি রুপা এবং ৬ লাখ টন তামা উৎপন্ন করে। এই খনি নিয়ে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস।

১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়া নেদারল্যান্ডস এর কাছ থেকে স্বাধীন হবার পরেও পাপুয়া দ্বীপটি (ইরিন জায়া/ পশ্চিম নিউ গিনি) ছিল মূলত: ডাচদের দখলে (কিছু অংশে জার্মান মালিকানা ছিল)। ১৯৬০ সালে ফ্রিপোর্টের একদল সার্ভেয়ার খনিটির সন্ধান পান ১৯৩৬ সালের ডাচ একটি রিপোর্টের সূত্র ধরে। ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিম পাপুয়া দখল করতে ব্যর্থ হয়ে সামরিক অভিযান চালায় সুকর্ন সরকার। পরবর্তীতে আমেরিকার মধ্যস্ততায় জাতিসংঘ ইন্দোনেশিয়াকে শর্ত দেয় যে ১৯৬৯ সালের মধ্যে তাকে একটি গনভোটের আয়োজন করতে হবে পাপুয়ার জনগণের মতামত জানার জন্যে এবং তারপরে তারা পশ্চিম পাপুয়াকে সংযুক্ত করতে পারবে।

সুহার্তো ১৯৬৬ সালের একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জের ধরে ক্ষমতায় আসেন (যার ফলশ্রতিতে প্রায় ৫ লাখ কমিউনিষ্টকে মারা হয়) । সুহার্তো অর্থনীতিকে মুক্ত করে দেন এবং বিদেশী কোম্পানীকে বিনিয়োগের লাইসেন্স দেন (বলা হয় ঘুষের বিনিময়ে)। ১৯৬৭ সালে প্রথম কোম্পানী হিসেবে কন্ট্রাক্টটি পায় আমেরিকার ফ্রিপোর্ট সালফার - পাপুয়ায় স্বর্ণ ও তামা খনি প্রতিষ্ঠার জন্যে। কিন্তু তখনও খনিটি যেখানে অবস্থিত সেই পশ্চিম পাপুয়া স্বীকৃতভাবে ইন্দোনেশিয়ার করায়ত্ব ছিল না।

আমেরিকার অবমুক্ত সিকিউরিটি ফাইল অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ায় আমেরিকান রাষ্ট্রদুত ১৯৬৮ সালে একটি তারবার্তা পাঠায় যে দুর্নীতি এবং অন্যান্য অভিযোগের কারণে ইন্দোনেশিয়া সরকারের ভাবমূর্তি খারাপ - তাই তারা নির্বাচনে জিততে পারবে না। কমিউনিষ্টদের নিধনের কারনে ইন্দোনেশিয়া তখন আবার আমেরিকার গুড বুকে।

১৯৬৯ সালের জুন মাসে কিসিন্জার ও নিক্সন ইন্দোনেশিয়া সফর করেন যখন পাপুয়ার অ্যাক্ট অফ চয়েস ভোটাভুটি চলছিল। কিন্তু একজন এক ভোটের নীতি পাল্টিয়ে ৮ লাখ ভোটারের যায়গায় মাত্র ১০০০ আদিবাসী নেতাদের দিয়ে প্রহসনের ভোটটি ঘটায় ইন্দোনেশিয়ার সরকার। ওদিকে কিসিন্জার সুহার্তোকে বাহবা দিচ্ছিলেন 'মডার্ন মিলিটারি ম্যান বলে'। আমেরিকার সমর্থন থাকায় এই ভোট স্বীকৃতি পায় ও পশ্চিম পাপুয়া ইন্দোনেশিয়ার হয়।

১৯৭২ সাল থেকে এর্টসবার্গ মাইন থেকে উত্তোলন শুরু করে ফ্রিপোর্ট। ১৯৮৮ সালে এই মাইনটি খালি হয়ে গেলে ৩ কিলোমিটার দুরে (৪০ বিলিয়ন ডলারে রিজার্ভের) গ্রাসবার্গ মাইন থেকে উত্তোলন শুরু করে। ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করে যে ফ্রিপোর্ট ফ্রি পাপুয়া মুভমেন্টের আক্রমণ থেকে খনিকে বাঁচার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর সেবা (?) নেয় এবং ১৯৯৮ -২০০৪ সালে কোম্পানির খাতায় এই খাতে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ দেখানো আছে (সামরিক বাহিনীর কোন কোন কর্মকর্তা ১৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত পেয়েছে। দেশের আইন অনুযায়ী বিদেশী কোম্পানী থেকে সামরিক সদস্যের অর্থগ্রহণ দন্ডনীয় অপরাধ।

এই মাইনের বিক্রির অংশ ছাড়াও এর শুল্ক ইন্দোনেশিয়ার সরকারের এই খাতে সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়।
পশ্চিম পাপুয়া দ্বীপের ধন সম্পদ নষ্ট করে আয় করার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ২০০৮ সালের সামার অলিম্পিক্সের জন্যে চীন ১ বিলিয়ন ডলারের কাঠের অর্ডার দেয় ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে যা এই দ্বীপের ব্যাপক অংশের বন উজাড় করে মেটানো হয়।

আমি খালি চিন্তা করছি আমাদের দেশের যদি এরকম প্রাকৃতিক সম্পদ আর এত আয় থাকত তাহলে দেশটি কোথায় যেত। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার মত হয়ত কিছু লোকের কাছেই সব ধন যেত আর অধিকাংশ লোকেরই ভাগ্য পরিবর্তন হত না। কত বিচিত্র এই বিশ্ব।

(ছবি নাসার সৌজন্যে)

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Monday, November 30, 2009

বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি: মনের দেয়াল ভাঙ্গাটাই আসল

আজকের খবরের চ্যানেলগুলোতে শুধু বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানমালা - অনেকেই লাইভ দেখাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের এই পতন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপব্যাপী সমাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবেরই শক ওয়েভের ফসল হিসেবে ধরা হয়। তবে এটি আরও তাৎপর্য পূর্ণ। এটি হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সমন্বিত পরাশক্তিরা ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জার্মানী দখল করে রাখে। ১৯৪৯ সালে আমেরিকা গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলে থাকা ১২টি স্টেটের সমন্বয়ে পশ্চিম জার্মানী গঠিত হয় এবং রাশিয়ার দখলে থাকা ৫টি স্টেট নিয়ে পূর্ব জার্মানী গঠিত হয়। প্রাক্তন রাজধানী বার্লিন শহরটি দুইভাগ হয়ে যায় এবং পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী বন নির্ধারিত হয়। ১৯৫৫ সালে রাশিয়া পূর্ব জার্মানীকে পুরোপুরি স্বাধীন ঘোষণা করে, তবে রাশিয়ার সৈন্যরা পটস্ডাম চুক্তি অনুযায়ী সেখানে থেকে যায়, যেমন পশ্চিম জার্মানীতে আমেরিকা, ইউকে আর ফ্রান্স এর সৈন্যরা ছিল।

আলাদা হবার পরপরই ১৯৫০ এর দশকে পশ্চিম জার্মানী একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির অনেকটাই তারা কাটিয়ে উঠে। ঐদিকে পূর্ব জার্মানরা তেমন সৌভাগ্যবান ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই তাদের উপর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা পোল্যান্ড আর চেকোস্লোভাকিয়া ছাড়া কোথাও যেতে পারত না (তাও বিশেষ অনুমতিক্রমে)। কিন্তু তবুও সীমিত আকারে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হত তখনও। তবে পশ্চিম জার্মানীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকায় ১৯৫০ এর দশকে প্রায় ৩৫ লাখ পূর্ব জার্মানবাসী পশ্চিম জার্মানীতে চলে আসে। এই ঢল ঠেকাতে হঠাৎ করে ১৯৬১ সালে বার্লিনের মাঝামাঝি দেয়াল তুলে দেয়া হয় ও ডেথ জোন তৈরি করা হয় নো ম্যানস ল্যান্ডে। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকে এই ডেথ জোন পার হয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায় পূর্ব জার্মান সৈন্যদের কাছে।

দুই জার্মানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পূর্ব জার্মানীর সরকার খুব তৎপর ছিল। পশ্চিম জার্মান সরকারও মানবাধিকার ইস্যুগুলো খুঁচিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি বজায় রাখত। কিন্তু একই ভাষা, একই জাতি এবং একই পরিবারের মধ্যে টান কিন্তু ঘুঁচাতে পারে নি। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রায় ১৩০০০ পুর্ব জার্মানবাসী অষ্ট্রিয়া -হাঙ্গেরিয়ান সীমান্তে পালিয়ে আসে। চেকোস্লোভাকিয়ায় পশ্চিম জার্মান দুতাবাসে কয়েকশ পূর্ব জার্মান আশ্রয় নেয় এবং পরে তাদের বিশেষ ট্রেনে করে পশ্চিম জার্মানী নিয়ে আসা হয়। সে মাসেই এরিক হোনেকার পূর্ব জার্মানীর প্রিমিয়ার পদ থেকে সরে দারান।
ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপে ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পূর্ব জার্মানদের উপর ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। সেটা ছিল এক নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তা নিয়ে কোন প্রস্তুতি ছিল না, এমনকি বর্ডার গার্ডরাও কিছু জানতেন না। তবে সেই ঘোষণা দেয়ার সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন এই সিদ্ধান্ত কি কখন থেকে কার্যকর হবে? তখন মূখপাত্রটি আমতা আমতা করে বলেন আমিতো কোন সময় উল্লেখ দেখছি না - এখন থেকেই ধরতে পারেন। এটি সরাসরি টিভিতে দেখানো হচ্ছিল। তা শুনে দলে দলে লোক বার্লিনের বিভিন্ন চেকপোষ্টে চলে আসে। লোকের প্রচন্ড চাপে সীমান্তরক্ষীরা হাল ছেড়ে দেয় এবং সরে দাঁড়ায়। প্রায় বিশ হাজার লোক সেদিন দেয়াল ভেঙ্গে ও টপকে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসে। বার্লিন ওয়ালের পতন হয়।

এই ঘটনা পরবর্তী বছরে দুই জার্মান একীভূত করাকে তরান্বিত করে। 'আমরা এক জাতি - এই স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাও এক সময় আলাদা হয়েছিল। জার্মানদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল দেশ ভাগ এবং ভাবধারার ভিন্নতা। আমাদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ধর্মীয় ভাগ। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই জাতীয়তা। অথচ ধর্মের ভিন্নতা আমাদের দুরে ঠেলে দিল।

দুই জার্মানীকে আলাদা রাখার জন্যে সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। পূর্ব জার্মানীতে টিভিতে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করা হত পশ্চিম জার্মানীর বিরুদ্ধে খুনসুটি করার জন্যে। বাইরে দেয়াল থাকলেও কিন্তু লোকজনের মনে দেয়াল ছিল না। তাই দুই জার্মানীর আবার এক হওয়া সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু আমাদের দুই বঙ্গের কি অবস্থা? ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প এখনও ছড়ায়। পশ্চিম বঙ্গে বাংলা ভাষার কদর কমে যাচ্ছে। নেই সেখানে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের প্রবেশাধিকার। সাংস্কৃতিক বিনিময় আগের চাইতে অনেক কম। পশ্চিম বঙ্গে বাংলাদেশের ক'জন লেখকের বই বিক্রি হয়? পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষ এখন রাজনৈতিক এজেন্ডা- এটি কিছু মানুষের রুটি রুজির ব্যাপার। বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে তারা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলতে ব্যস্ত। আমরা না চাইলেও দুরত্বটা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সব মিলে দুই বঙ্গের কারও কি ইচ্ছে হয় আবার কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে এক সাথে মেলার? জানি বর্তমান বাস্তবতায় হয়ত একত্রীকরণ বেশীই চাওয়া হবে। তবে নিদেনপক্ষে ভিসা বিহীন যাতায়াত, ইইউর মত ইকনমিক জোন?
কিন্তু সেটা সম্ভব করার আগে আমাদের মনের দেয়াল ভাঙ্গতে হবে।

প্রথম  প্রকাশ: সচলায়তন

Sunday, November 01, 2009

বাংলাদেশের বাক স্বাধীনতায় চীনের হস্তক্ষেপ



দৃক বাংলাদেশ এবং স্টুডেন্টস ফর এ ফ্রি তিবেত সংস্থার বাংলাদেশ শাখা সম্প্রতি তিব্বতের উপর এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীটি গতকাল শুরু হয়ে নভেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত হবার কথা ছিল।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকার চীন দুতাবাসের সাংস্কৃতিক এটাশে এবং কাউন্সেলর দৃক গ্যালারীতে এসে এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ড: শহীদুল আলমের সাথে দেখা করেন এবং প্রদর্শনীটি বন্ধ করতে বলেন। তারা কিছু উপঢৌকনও নিয়ে এসেছিলেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে তিব্বৎ চীনের অন্তর্গত এবং এই প্রদর্শনী বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। ড: আলম বলেন যে দৃক একটি স্বাধীন গ্যালারী এবং চীনা দুতাবাস চাইলে তাদের বক্তব্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনে পেশ করতে পারেন। এমনকি চীন চাইলে তাদের প্রদর্শনীও এখানে করতে পারবে। তারা গ্যালারী দেখে প্রস্থান করে।

কিন্তু এরপর নানা হুমকি আসতে থাকে দৃক এর উপর। ওদিকে স্টুডেন্টস ফর এ ফ্রি তিবেত এর সদস্যদের বাড়ীর আসে পাশে গোয়েন্দা হানা দেয়া শুরু করে। ফোন আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে: "চায়না আমাদের বন্ধু। দালাই লামার ছবি দেখিও না।" "না না, আমরা সেন্সরশীপের কথা বলছি না। তবে জানেনই তো..." এর পর এক নামকরা তারকার কাছ থেকে ফোন আসে। জাসদের এমপি হাসানুল হক ইনু ফোন করেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন বাংলাদেশের এক চীন নীতির কথা এবং এই প্রদর্শনী বাংলাদেশের জনগণের জন্যে কি প্রভাব বয়ে আনবে তা। চারিদিক থেকেই চাপ আসতে থাকে এবং শেষে তা পুলিশী ধমকিতে পরিণত হয়।

এসবির লোক আসে শহিদুল আলমের সাথে দেখা করতে। তারা উদ্যোক্তাদের সবার পরিচয় জানতে চান। শহিদুল অফিসিয়াল অর্ডারের কথা জানতে চান। উত্তর আসে "আপনি খামাখা জটিল করে ফেলছেন।" এবং তাকে শুনিয়েই উপরওয়ালার সাথে কথাবার্তা চলতে থাকে। " উনি সহযোগিতা করছেন না.. আমরা বুঝিয়েছি ওনাকে ব্যাপারটা.. না না এখনও কিছু করি নি। এর পরে তারা আবার আসে এবং ধমক দেয় সরকারকে সহযোগিতা না করলে ভবিষ্যতে দৃকের কপালে খারাবি আছে।

গতকাল (পহেলা নভেম্বর) বিকেলে পুলিশের ফোন আসে, "প্রদর্শনী বন্ধ করুণ না হলে ফোর্স পাঠাবো।" ফোর্স পাঠাতে হল তাদের এবং তালা মেরে দেয়া হলো প্রদর্শনী হল। কাউকে ঢুকতে দেয়া হলো না দৃকে। প্রধান অতিথি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল) দু ঘন্টা পর প্রতীকী উদ্বোধন করলেন। তখনও প্রদর্শনী বন্ধ ছিল - পুলিশ নাকি চাবি হারিয়ে ফেলেছে।

চীন সরকারের অন্যান্য দেশের উপর খবরদারীর এই লক্ষণ খুবই খারাপ। আর তাদের এই আন্তর্জাতিক সেন্সরশীপ অবশ্য বাংলাদেশ, নেপালের মত দুর্বল দেশের উপর শুধু ভালভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

দৃক নিউজ সাইটটি এখন একটি রিপোর্টেড অ্যাটাক সাইট । এই কাজটি চীনের নেট সৈনিকদেরই কাজ হতে পারে। তাদের সেন্সরশীপের পরিধি তারা যত দুর সম্ভব বাড়াতে চেষ্টা করে এভাবে - যেমন তারা গত জুলাইতে মেলবোর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভালে উইঘুর দের নিয়ে রাবেয়া কাদিরের চলচ্চিত্রটি দেখানো রোধ করতে ফেস্টিভ্যালের সাইট হ্যাক করে চাইনিজ পতাকা ঝুলিয়ে দেয়।

এর কারণ আমাদের রাজনীতিবিদগন এবং রাষ্ট্রযন্ত্র যারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে চীনের পা চাটে। আমরা কোন দেশে বাস করছি? চীন না বাংলাদেশ? একটি প্রদর্শনী করার জন্যে কেন চীনের অনুমতি নেয়া লাগবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীনের অবস্থান সবাই জানে। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে। নব্বুই এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশীরা তাইওয়ান যেতে পারত না। কারণ পাসপোর্টে লেখা থাকতে ইজরায়েল ও তাইওয়ান ব্যাতিত সকল দেশে ভ্রমণ করা যাবে। এর পেছনেও ছিল চীন তোষণ নীতি। অথচ তাইওয়ানের সাথে ব্যবসা কি থেমে থেকেছে? বর্তমানে কি চীনের চাপে আবার বাংলাদেশ এরূপ ব্যান আরোপ করার ক্ষমতা রাখে (যখন কম্পিউটারের অনেক যন্ত্রাংশ আসে তাইওয়ান থেকে)?

চীন আমাদের তাদের ঠুনকো সস্তা জিনিষ বিক্রি করা ছাড়া কি দেয়? তারা সেতু নির্মাণ ইত্যাদিতে যেসব সহায়তা দেয় তা উসুল করে নেয় নিজস্ব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও নিজস্ব লোকবল লাগিয়ে। কেন কারণ ছাড়া চীনকে তোষণ করতে হবে?

চীন একটি একনায়কতন্ত্র আর বাংলাদেশ একটি গণতন্ত্র। এদেশে চীনের নীতি ফলানো গণতন্ত্রের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। কি হতো প্রদর্শনীটি হতে দিলে? কয়েকশ লোক হয়ত তা দেখত, ব্যাস। এখন এটি বন্ধ করে বাংলাদেশ যে পরিমাণ প্রচার পেল তাতে বরঞ্চ দেশের ইমেজের ক্ষতি হল। আমাদের তোষণ ও মোসাহেবী স্বভাব যে কবে পাল্টাবে এবং আমরা ভিক্ষার থালা ফেলে দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে কোনদিন বাঁচতে পারব সে বলা মুস্কিল।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের সাংবিধানিক অধিকার - বাক স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা - চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে জিইয়ে রাখার জন্যে তাদের মদদ করা নয়। এই ব্যাপারটি তারা যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।

এ নিয়ে আরও পড়ুন:

* শহিদুল আলমের ব্লগটুইটার

* গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইন

* মাশুকুর রহমান

* সাদা কালো

* রব গডেন

* মিডিয়া হেল্পিং মিডিয়া

Thursday, October 15, 2009

বৃটেনে যুদ্ধাপরাধীদের দৌরাত্ম্য

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্র দেলোয়ার হোসেইন সম্প্রতি গার্জিয়ান পত্রিকার কমেন্ট ইজ ফ্রি সেকশনে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ব্রিটেন যে কিছু যুদ্ধাপরাধী আছে তা নিয়ে একটি তথ্য বহুল লেখা লেখেন গত ৭ই মার্চ। তার রিপোর্টটির মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে নিয়ে কয়েকটি প্যারা যা সেন্সর করার পর বর্তমানে এখানে দেখা যাবে
প্রতিবেদনটি প্রকাশের সপ্তাহখানেক পরে মঈনুদ্দিনের আইনজীবিদের কাছ থেকে উকিল নোটিশ পাবার পর গার্ডিয়ান পত্রিকা উক্ত প্যারাগুলো মুছে ফেলে একটি ডিসক্লেইমার ঝুলিয়ে দেয়:

• On 13 October this article was changed following a legal complaint.
এ প্রসঙ্গে হ্যারি'স প্লেস ব্লগ জানাচ্ছে যে জামাতে ইসলামী এখন বিলেতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তারা মুসলিম কাউন্সিল অফ ব্রিটেন আর লন্ডন মুসলিম সেন্টার (ইস্ট লন্ডন মসজিদ) পুরো নিয়ন্ত্রণ করে। যখনই কোন ব্লগ আর পত্রিকা তাদের উপর রিপোর্ট করে তখনই জামাতে ইসলামী আর মুসলিম ব্রাদারহুডের আইনজীবিরা আইনি হুমকি পাঠায়। ফলে অনেকেই তাদের ঘাঁটাতে সাহস করে না।
এই ব্লগ মন্তব্য করেছে:
আইনের হুমকিতে গার্ডিয়ান পত্রিকা সত্যি প্রকাশে পিছু হটেছে যা বাক স্বাধীনতার উপর বড় আঘাত। এটি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জনগণের ন্যায় বিচার লাভের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আরও বড় হুমকি।
মুক্তাঙ্গণ ব্লগে অবিশ্রুত লিখেছিলেন:

ব্রিটেন যে যুদ্ধাপরাধীদের ভূস্বর্গে পরিণত হয়েছে, এই ক্ষোভ এর আগেও প্রকাশ পেয়েছে অন্যান্য দেশের বিভিন্ন নাগরিকদের মন্তব্য থেকে। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের কারও কারও নিরাপদ বাসস্থান এখন এই ব্রিটেন। এই ব্রিটেনে বসেই গোলাম আযম পরিচালনা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন।
গার্ডিয়ানের সেন্সরশীপ নিয়ে সেই ব্লগের মন্তব্য:
বাংলাদেশ যখন প্রত্যাশা করছে, ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, বিদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী যুদ্ধাপরাধীদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে, ঠিক তখনই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী চক্র আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, এ-ধরণের বিচার প্রক্রিয়াকে ঠেকানোর জন্যে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত তথ্যায়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার জন্যে তারা যথেষ্ট সংঘবদ্ধ।
গার্ডিয়ানের এই কাপুরুষোচিত কার্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বাক স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারে বিশ্বাসী সবাইকে এই সকল যুদ্ধাপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহ্বান জানাচ্ছি।


× বাংলাদেশ গণহত্যা আর্কাইভে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের ফ্যাক্টশীট

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Thursday, October 08, 2009

সব সমস্যার সমাধান যদি জিন্জিরাতে তৈরি হত

মানুষের এই ছোট জীবনে শারীরিক সমস্যার অন্ত নেই। আমাদের বেশীরভাগই নিজস্বতা ছাপিয়ে অন্য কেউ হতে চাই, কোন রোল মডেলের মত। আমাদের কারও হয়ত রঙ ময়লা, কেউ খাটো (ছেলে হলে) বা কেউ লম্বা (মেয়ে হলে)। কারও নাক বোঁচা, কারও দাত উঁচু, কারও মাথায় টাক। কারও গলার স্বর চিকন, কারও মোটা। কেউ তালপাতার সেপাই আবার কেউ হাতির মত। কারও মুখে ব্রণের দাগ, কারও ত্বক তেলতেলে।

খেয়াল করে দেখেছেন? উপরের প্রত্যেকটি সমস্যাগুলো সমাধানে বাণিজ্যিক পণ্য পাওয়া যাবে। এক গায়ের রঙ ফর্সা করার পণ্যেরই তো বিশ্বব্যাপী বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রী। মানুষ নিজের খুঁতগুলোকে ঢাকার জন্যে অঢেল টাকা খরচ করতে রাজি। কারণ একজনের সমস্ত পৃথিবী আবর্তিত হয় তার নিজের স্বত্বা, তার চাওয়া পাওয়াকে কেন্দ্র করেই।
বিশ্বের নানা দেশে বিবিধ বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে মানুষের এইসব চাহিদা মেটাতে। ভোগবাদের মূলমন্ত্র যে জিনিষ কেনার সাথে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি তা এসব পণ্যে বিদ্যমান। এই সমস্ত পণ্য প্রলোভন দেখানো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিক্রি হয় (হোক দেশটি বাংলাদেশ, ভারত অথবা ইন্দোনেশিয়া)। মেয়ের রঙ ময়লা বলে সে চাকরি পাচ্ছে না, অথচ সংসারের আয় দরকার। বাবা তাকে ত্বক উজ্জ্বল করার ক্রিম কিনে দেয় আর সে এয়ার হোস্টেসের চাকুরি পায়, সংসার চালায় - কি সংবেদনশীল আবেগ। আরেক বিজ্ঞাপনে এক ছোট অভিনেতা ত্বক সাদা করার ক্রিম মেখে শ্যুটিংয়ের সময় নামকরা পরিচালকের নজরে পড়ে যায় ও নায়কের অভিনয়ের প্রস্তাব পায়। এইসব প্রচার ও আবেগের মাধ্যমে আমাদের সমাজের বর্ণবাদী মনোভাব আরও প্রতিষ্ঠা পায়।

শুধু এই নয়, ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করেও অনেক পণ্য এসে গেছে বাজারে। ইসলামী ব্যান্কিং ব্যান্ক পরিমন্ডলে ভাল ব্যবসা করছে। নানা স্ন্যাক্সের সাথে হালাল শব্দটি জুড়ে দিলে বেশী বিক্রি হয়। শুদ্ধ ভেজিটারিয়ান পণ্যের কাটতি অনেক দেশেই। হিজাব পড়া বার্বি ডল বা ইসলামি সাতারের পোশাক জাতীয় পণ্য এখন হালের ফ্যাশন।

আর এসব পণ্য তৈরি ও বাণিজ্যে সেরা দেশ হচ্ছে চীনদেশ। আমাদের দেশে জিন্জিরায় ও তাদের মতই নানা পণ্য তৈরি হয় (পড়ুন নকল হয়) এবং সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে তাদের পণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

চীন দেশে বিএমডাব্লিউ এক্স ফাইভ জীপটির ডিজাইনে গাড়ি বিক্রি হয় চাইনিজ ব্র্যান্ড সহকারে। তবে শোরুমের বাইরেই বিএমডাব্লিউর লোগোটি পাওয়া যায় যা লাগিয়ে নিলে আপনার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে।


(কৃত্রিম সতীচ্ছদ কিট - ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা এনওয়াই ডেইলি নিউজ)

তাদের উদ্ভাবনী শক্তিরও তারিফ করতে হয়। এক চাইনিজ কোম্পানি বের করেছে আর্টিফিসিয়াল ভার্জিনিটি হাইমেন কিট (কৃত্রিম সতীচ্ছদ কিট) এবং মাত্র ৩০ ডলারে মেয়েদের হাতের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এমন এক কবচ যা তাদের রক্ষা করবে সেই সব বিকারগ্রস্ত ছেলেদের কাছ থেকে যাদের বিবাহিত বধু হিসেবে শুধুমাত্র সতী মেয়েদেরই চায়। অবশ্য বিকারগ্রস্ত বলি কেন - এটি তো এখনও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেরই প্রথা - সাদা চাদরে রক্তে মেয়েদের স্বাক্ষর রেখে সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়। খেলাধুলা বা অন্য কারনে সতীচ্ছদ ছেঁড়ার কারণে যেসব মেয়েদের বিবাহিত জীবন/বিবাহ হুমকির মুখে তাদের জন্যে এই পণ্যটি জীবন রক্ষাকারীই বটে। তবে মেয়েদের সে স্বাধীনতা তো দেবে না সমাজ। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড (সংসদের ২০% আসন যাদের) আন্দোলন করছে এই ভার্জিনিটি কিট নিষিদ্ধ করার জন্যে। এটির বিক্রেতাদের উপর ফতোয়া জারী হয়ে গেছে।

আমি শুরু করেছিলাম মানুষের শারীরিক সমস্যা গুলো দিয়ে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে এগুলোর অনেকগুলোই মানসিক সমস্যা যা আমাদের সমাজ লালন পালন করে থাকে। আমরাও এর বাইরে নই তাই আমরা ধরতে পারি না, সব স্বাভাবিক লাগে।

সেদিন এক ভারতীয় টিভি চ্যানেলে দেখলাম কাঁচ দিয়ে তৈরি চোখের আদলে লকেটের এক রক্ষা কবচ বের হয়েছে যা ইন্টারনেটে অর্ডার করা যাবে। আমাদের সফলতার দিকে যারা কুদৃষ্টি দেয় সেগুলো থেকে রক্ষা করবে এই কাঁচের চোখের রক্ষাকবচ। গ্রাফিক্সের মাধ্যমে মানুষের চোখ থেকে ঠিকরানো লাল কুদৃষ্টি কিভাবে ঠেকিয়ে দিচ্ছে কবচটি তা দেখানো হল। নিশ্চয়ই এর কাটতিও প্রচুর কারণ এই কুসংস্কারে ধর্ম-বর্ণ ভেদে অনেকেই বিশ্বাসী।

আমাদের এই সব মানসিক সমস্যাগুলো সমাধানে ভার্জিনিটি কিট বা কুদৃষ্টি থেকে রক্ষার মত জিন্জিরার কোন একটি পণ্যের প্রতীক্ষায় আছি।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Monday, September 28, 2009

শুভ বিজয়া

আজ (সেপ্টেম্বর ২৮) ছিল বিজয়া দশমী। বেলা বারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শারদীয় দুর্গা পুজা মন্ডপে গিয়ে দেখি বাইরে ট্রাক দাঁড়ানো - বিসর্জনের প্রস্তুতি চলছে। প্রবেশ পথটি মরিচা বাতি দিয়ে ছাওয়া। রাতে নিশ্চয়ই বেশ লাগে।

জগন্নাথ হলে পুজা মন্ডপ 
জগন্নাথ হলে পুজা মন্ডপ

প্রতিমার সামনে তেমন ভীড় দেখলাম না। ঢাক বেজে চলেছে এবং কিছু বাচ্চা নাচছে। অনেককেই দেখলাম প্রতিমাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে নিজেদের ছবি তোলায় ব্যস্ত, ডিজিটাল ক্যামেরা, সাধারণ ফিল্ম ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনের ক্যামেরার ছড়াছড়ি।

মা দুর্গা 
মা দুর্গা

মা দুর্গা দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। আর দেখছেন চেয়ারে বসে অনেকে।

প্রতিমা 
প্রতিমা

বিকেলে বিসর্জনের সময় ঢাকায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হল। মা দুর্গা পতি শিবের কাছে ফিরে যাবার সময় সমস্ত ঢাকাই কাঁদল।

সবাইকে শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Sunday, September 20, 2009

কোন এক বিকেলে ধানমন্ডিতে

সচলাড্ডায় যাব পণ করে রেখেছিলাম আগেই। কাল সকালে নজরুলকে ফোন করে বললাম আসছি। সে জানালো যে সাড়ে পাঁচটা থেকেই অনেকে থাকবে। আমার যেতে যেতে হল সাড়ে ছটা। বাবুর্চী রেঁস্তোরার দোতালা তিনতলা ঘুরেও কারও দেখা না পেয়ে আবার নজরুলকে ফোন দিলাম। সে পরিবারের সাথে তখনও রাস্তায় এবং তৎক্ষণাৎ খবর দিল উপস্থিত সচলদের। তিন তলার পাশে একটি বিশেষ জায়গায় ঠাই হয়েছে সচলদের। একে একে পরিচয় হল সবজান্তা, রণদীপম, জালাল ভাই, আনিস ভাই, সীমন, মামুন হক এবং আরও অনেকের সাথে।

খাবার ছিল মজাদার, এর বর্ণনা দিয়ে পেটে পিলে জন্মাবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। তারপর সে তো অনেক গল্প, এক পোস্টে হবে না। তাই ছবিই কথা বলুক:

সচলায়তনের অফিসিয়াল মডেল 
সচলায়তনের অফিসিয়াল মডেল

সবজান্তা 
সবজান্তা
জালাল ভাই 
জালাল ভাই
রণদীপম বসু 
রণদীপম বসু
খাবারের কিয়দংশ 
খাবারের কিয়দংশ
'কথা কম কাজ বেশী' এই কথায় 'বিপ্লব' 
'কথা কম কাজ বেশী' এই কথায় 'বিপ্লব'
"কাবাব পরোটা ভাল হয়েছে, আর আছে কি?" - ভাস্কর 
"কাবাব পরোটা ভাল হয়েছে, আর আছে কি?" - ভাস্কর
মেয়ের সাথে আহমেদুর রশীদ 
মেয়ের সাথে আহমেদুর রশীদ
আনিস ভাই জুবায়ের ভাইয়ের স্মরণে জমায়েতের দাওয়াত দিচ্ছেন 
আনিস ভাই জুবায়ের ভাইয়ের স্মরণে জমায়েতের দাওয়াত দিচ্ছেন
এক ঝাক সচল 
এক ঝাক সচল
আরও এক ঝাক সচল 
আরও এক ঝাক সচল

Sunday, September 06, 2009

তবে কেন আমরা হব এক নম্বর?

ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের ২০০৮ সালের দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ১০ম (১৪৭) আর ইন্দোনেশিয়ার অবস্থা ১৫তম (১২৬)। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ছিল যুগ্মভাবে প্রথম (১৫৮) আর ইন্দোনেশিয়া ষষ্ঠ (১৩৭)।

অর্থাৎ ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের সার্টিফিকেট অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতির অবস্থা বাংলাদেশ থেকে অনেক ভাল। এখন আপনাদের আমার কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলি। ইন্দোনেশিয়ায় আসার পর আমার কিছু টার্গেট ছিল: প্রথমত: একটি ব্যান্ক একাউন্ট খোলা, ভিসা বাড়িয়ে থাকার অনুমতি যোগাড় করা, আর জার্মানী থেকে পাঠানো সংসারের কিছু সামগ্রী পোর্ট থেকে ছাড়ানো। প্রায় দুমাস হতে চলল এর একটি মাত্র করতে পেরেছি, অর্থাৎ থাকার অনুমতিটুকু (একটি বছর মেয়াদী ভিসা মাত্র), আর বাকী সব এখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকা পড়েছে। মাল এসে পোর্টে রয়েছে - ডেমারেজ বাড়ছে, আর আমরা কোন এক সরকারী কর্মকর্তার একটি সীল ও সইয়ের জন্যে বসে আছি।

বাংলাদেশই দুর্নীতির আখড়া এই বিশ্বাস যাদের আছে তাদের জন্যে আমার গল্প বলি। স্বল্প মেয়াদী থাকার অনুমতি পত্র (কিতাস) এর ফর্ম ফিল আপ করে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রাদি ও ছবি সহ জমা দেবার পরে সেটা আবার ফেরত আসল। কারণ নতুন ফর্ম এসেছে। তো আমাদের কেন পুরোনো ফর্ম দেয়া হল আগে? জানা গেল ওটি ঠিক জায়গা থেকে আনা হয় নি। কিছু অসাধু লোক পুরোনোটি বিক্রি করে তাই দুর্নীতি দমনের জন্যে নতুন ফর্ম ছাপানো হয়েছে যা দেয়া হচ্ছে বিনা পয়সায়। এরপর তা জমা দেবার পর ফেরত এল কারণ ছবি নাকি ঠিক হয় নি, লাল ব্যাকগ্রাউন্ড লাগবে (আগেরবার জমা দেবার সময় বললেই পারত)। আবার ছবি তৈরি করে দিয়ে আসা হল, এভাবে এক সপ্তাহ পা্র হয়ে গেল। তার পর সব চুপচাপ। মেসেন্জারকে পাঠানো হয় খোঁজ নিতে আর বলে তারা নাকি জানাবে। কিন্তু সেই পাথর তো আর নড়ে না। এবার শরণাপন্ন হলাম স্থানীয় প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে। তারা বলল পয়সা ছাড়া তো কিছু হবে না।
এখানে কোন কাজ করানোর জন্যে ইন্দোনেশীয়ার ভাষা জানা খুবই জরুরী - কারন অনেকেই ইংরেজী জানে না। তাই ইন্দোনেশিয়ান মেসেন্জারকেই টাকা দিয়ে পাঠালাম। সে এরপর দিনে দিনে ফিরিস্তি দেয় কিভাবে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল নড়ে। প্রথমে আপনি একটি ফাইল কিনে এক টেবিলে জমা দেবেন। সাথে থাকবে একটা সাদা খামে গিফ্ট। তারপর হুজুরের মর্জি হলে (আর ক্রমাগত ফলোআপের পরে) সে আপনার কাগজের উপর কাজ করে পাশের টেবিলে স্থানান্তরের জন্যে একটি চিঠি দেবে। সেটি টাইপ করতে নিশ্চয়ই অনেক কাজ কারণ মেসেন্জার তা করানোর জন্যে সারাদিন সেখানেই বসে থাকে। তারপর সেই চিঠি পাশের টেবিলে না গিয়ে মেসেন্জারের কাছে আসে। সে এনে আমাদের দেখায় যে কাজ হচ্ছে। পরের দিন আবার পাশের টেবিলে নতুন ফাইল কিনে খামসহ কাগজপত্র জমা পরে। এভাবেই কাজ আগাতে থাকে ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব গতিতে। সবশেষে প্রায় মাসখানেক পার করে সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ আসল যখন একজন পরিচিতজন সেই অফিসে কি কাজে গিয়েছিলেন - তিনি জায়গা মত কিছু টাকা দিয়ে বের করে নিয়ে আসলেন ভিসাটুকু। তার বক্তব্য আমাদের মেসেন্জার নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত টাকা দেয় নি, কিছু পকেটে পুরেছে, না হলে এত সময় লাগার কথা নয়।

ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতির ব্যাপারটি বুঝতে হলে একটু পেছনের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। দেশটিতে এতকাল শাসন করে গেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতের পুতুল, সামরিক নেতা ও কিছু স্বৈরশাসক, এবং তাদের সর্ব শেষজন, সুহার্তো যিনি ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত শাসন করে গেছেন। সুহার্তোকে ধরা হয় বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ নেতা হিসেবে।

দেশটিতে পাবলিক সার্ভিসের কোন ধারণাই ছিল না এত দিন এবং গণতান্ত্রিক দেশ এবং জনগণই সর্ব ক্ষমতার উৎস এই সংস্কৃতি এখনও লোকজনের রক্তে গেড়ে বসে নি। দেশটিতে সরকারী চাকুরি মানে হচ্ছে খুবই মর্যাদার ব্যাপার এবং এর সাথে অনেক সুবিধা আপনা আপনি আসে। এই সব সুবিধার মধ্যে আছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের কাছ থেকে উপঢৌকন (মনে রাখবেন ঘুষ কিন্তু ওরা কখনও বলে না, বলে গিফ্ট), এবং সরকারী সম্পদ নয়ছয় করার অব্যক্ত অধিকার।

সুহার্তোর সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হচ্ছে এই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া। না দিয়েও উপায় ছিল না। তার শাসনামলে তার নিকট আত্মীয় থেকে দুরতম আত্মীয় পর্যন্ত সবাইকে সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে বসানো হয়েছিল । বিভিন্ন বেদরকারী মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারী অনুমোদনের আওতায় এনে তিনি তার আত্মীয় স্বজনকে প্রভূত অর্থ কামানোর সুযোগ করে দেন। সুহার্তো পুত্রের যে সব দুর্নীতির কথা এবং তার বিদেশে থকা সম্পদের কথা শুনেছি সে তুলনায় আমাদের দেশের রাজকুমারেরা ছিঁচকে চোর।

১৯৯০ সালে তার ঘোষিত নিউ অর্ডার এর বৈশিষ্ট্য ছিল সিভিল সোসাইটির প্রভাব কমানো, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাতন্ত্রের ভেতরে ঢুকানো ইত্যাদি। আর ঐতিহ্যগতভাবে দেশটিতে আমলাদের সাধারণ মনোভাব হচ্ছে দেশের অন্যান্য লোকদের চেয়ে তারা বেশী মর্যাদাপূর্ণ। যত উঁচু আমলা তত বেশী মর্যাদার, তত বেশী ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তার কাছে কোন সেবা চাওয়া তার কাছে ভিক্ষা চাওয়ার মত এবং অবশ্যই তার কাছে সেই অনুরোধের সাথে আপনার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী একটি গিফ্ট কাম্য (একটি খামভর্তি টাকা সেই গিফটের সাধারণ ধরণ)। আপনি যদি কোন উপঢৌকনের প্রস্তাব না করেন তাহলে সেটি অবমাননাকর হিসেবে ধরা হবে এবং আপনার কাজে প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে সেই প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হবে।

আমাদের দেশের মতই এদেশেও দাড়ি টুপীর ছড়াছড়ি না থাকলেও অনেকেই ধর্মীয় আচারে রত (নামাজ রোজা) এবং প্রচুর মসজিদ। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম রোজার সময় হয়তো ওরা ঘুষ নেবে না, তাহলে কি এ মাসে কোন কাজ হবে না। উত্তর মিলেছে আরে ঘুষ কেন বলেন? এটি তো ওদের কাছে গিফ্ট মাত্র, আপনি খুশী হয়ে আপনার কাজের জন্যে দিচ্ছেন, ওরা তো চাচ্ছে না! এটিতে ধর্মে কি বাঁধা(??) ?

সবচেয়ে দু:খজনক ব্যাপারটি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ জনগণ ঐতিহ্যগতভাবে এই উপঢৌকনের সংস্কৃতিকে মেনে নেয়। একজন সরকারী কর্মচারীকে একটি রুটিন কাজের জন্যে উপঢৌকন না দেয়াকে তাকে অসম্মান করা মনে করে। আমার এখনও জানা হয় নি ওদের সরকারী কর্মকর্তাদের মূল বেতন কি স্ট্যান্ডার্ডের। কিন্তু এদেশে অনেকেরই লাইফস্টাইল দেখে মনে হয় বেতনভোগী কর্মচারীরা এই জীবনযাত্রা কোনদিনই পোষাতে পারবে না। এখানে ১০ টাকার নুডলস খেয়ে কারও একবেলা কাটে আর কেউ ফ্রেস জ্যুস খায় ১৫০ টাকা দিয়ে।

ইন্দোনেশিয়াতে এখনও পুলিশের চাকুরী পাওয়ার যোগ্যতা নির্ভর করে বাবা-মার সচ্ছলতার উপর (অবশ্য এটি ভাল ইনভেস্টমেন্ট, দ্রুতই টাকা উঠে আসে)।

তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে যে দুর্নীতি দমনের প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে সুহার্তো পরবর্তী সরকারগুলো। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন (কেপিকে) বেশ কিছু উচ্চপদস্থ আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু এর পরিচালককে এক মার্ডার কেসে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিশোধ হিসেবে।

এখানে বৈদ্যুতিক মিটার রিডিং নেয়া হয় ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলে। বেশ কিছু সরকারী অফিসে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো আছে উপঢৌকন সংস্কৃতি রোধের জন্যে (যদিও শুনেছি সেসব স্থানে কাজ দ্রুত আদায় হয় বাড়ীতে উপঢৌকন পৌঁছানোর মাধ্যমে)।

আমাদের দেশেও দুর্নীতি আছে কিন্তু সেটি কি এই লেভেলে? কিন্তু ট্রান্সপ্যারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের মতে গত দশকে বাংলাদেশ বারংবার দুর্নীতিতে ১ নম্বর হয়েছে। আমার কিন্তু তাদের স্ট্যাটিস্টিক্সে একদম ভরসা উঠে গেছে।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Wednesday, July 29, 2009

জাকার্তা বার্তা

সাড়ে তিন বছর ইউরোপে বসবাসের পর আমার নতুন বসতি এখন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। দোহাতে উড়োজাহাজ পরিবর্তন করে সিঙাপুরের ফ্লাইটে উঠতে যাব তখন দেখি মাথায় কাপড় দেয়া বিশাল একদল ইন্দোনেশীয় নারী লাইন ভেঙ্গে বোর্ডিং এর জন্যে দাড়াতে তৎপর। এরা মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের বাড়ীর গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে বাড়ী ফিরছে। এছাড়া লাইনের বেশ কিছু লোকজনের পোষাকে বোঝা গেল তারা ওমরাহ করে দেশে ফিরছে। সিঙাপুরে যাত্রাবিরতিটা হলো খুব মজার। একই বিমান জাকার্তা যাবে, ফুয়েলিং এর জন্যে থেমেছে। কিন্তু আমাদের সবাইকে নামানো হল এবং আবার নতুন করে চেকইন ও বোর্ডিং করানো হল। জিজ্ঞেস করায় বলা হলো যে সিঙাপুরের আইন নাকি কড়া। দোহা থেকে বিমানে সাথে তরল পদার্থ নেয়ার অনুমতি ছিল কিন্তু সিঙাপুরে বিমানে নেয়া যাবে না।

সেখান থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের ফ্লাইট জাকার্তা পর্যন্ত। প্লেন নামার সময় নীচে বেশ সবুজ দেখলাম। এয়ারপোর্টটি বেশ বড় মনে হলো না। আমাদের 'জিয়া' এর থেকে বেশ বড়। তবে বেশ একটি গোছানো ভাব আছে। নীচে গ্রাউন্ড স্টাফের ছড়াছড়ি, একটু পরপর মোছা হচ্ছে মেঝে। শোয়াইন ফ্লুর জন্যে আমাদের একটি ডিক্লারেশন দিতে হলো (জ্বর আছে কিনা, কোথা থেকে এসেছি) ইত্যাদি। একজায়গায় দেখলাম জটলা। স্ক্রীনিং করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সবার কাছ থেকে ডিক্লারেশনটি নিয়ে পড়ে না দেখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বুঝলাম সেই ব্যুরোক্রেসী - আমরা নিজেও জানিনা এসব কেন করছি - ফলাফল শুন্য।

ইমিগ্রেশনে অনেক সময় লাগল। উল্টে পাল্টে পাসপোর্ট ভিসা দেখল অফিসার, কিছু টাইপ করল, একবার কাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল। তারপর মুক্তি। নিতে লোক এসেছিল, তাই মালপত্র গাড়ীতে উঠিয়ে চললাম জাকার্তা শহরের উদ্দেশ্যে (এয়ারপোর্টটি মূল শহরের একটু বাইরে)। আমরা যাচ্ছি একটি টোল রোডে এবং আমাদের যাত্রাপথের উল্টোদিকে প্রচুর জ্যাম।

কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য 
কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য

সত্যিই শহরে ঢুকে প্রথমেই মনে হল ঢাকার কথা। মেগাসিটির অন্যতম চিহ্ন হচ্ছে স্মগ (কুয়াশা), হাইরাইজ এবং অগুণতি শপিং মল। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জাকার্তাকে একটু একটু করে আরও চিনলাম। উচু বিল্ডিঙ এর ধারেই ভাঙ্গা বাড়ী - যদিও আমাদের বস্তির মত জীর্ণ নয়। অনেক এলাকায়ই চিপা গলি, রাস্তা ভাঙ্গা।

বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র 
বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র

ওদের রিক্সা নেই কিন্তু রাস্তায় গিজগিজ করে মোটরসাইকেল, ওরা বলে ওজেক। ছোট রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওজেকের স্টল, ভাড়ায় খাটে। জ্যামের কারনে দ্রুত চলাচলের জন্যে বেশ জনপ্রিয়।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্যে আছে তাদের মিনিবাস। যেখান সেখান থেকে লোক উঠাচ্ছে। আর ট্রান্স জাকার্তা এসি বাস যার জন্যে রয়েছে আলাদা লাইন। রাস্তায় গাড়ী চলাচলে কেউ নিয়ম মানে না। তবে বিশৃংখলাও নেই।

জাকার্তার লোকেরা এমনিতে খুব ভদ্র। তবে নৈতিকতার অভাব রয়েছে বড্ড, আমাদের মতই। ট্যাক্সি ড্রাইভার এমন ভাব করবে যে তার কাছে কোন ভাংতি নেই, অর্থাৎ চেন্জটুকু রেখে দিতে চাচ্ছে। তাই ভাষা না জানলে রাস্তায় চলা খুব অসুবিধা। এখানে টুরিস্ট বা বানিজ্যিক এলাকা ছাড়া দোকানে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ইংরেজী জানা লোক খুব কম।
আমার প্রথমে অসুবিধা হলো ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে। এক ইন্টারনেট কাফেতে গেলাম সেখানে স্পীড অনেক স্লো। বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করলেও অনেক চেষ্টা করেও ইন্সটল করতে পারলাম না। ভাষার সমস্যা সত্বেও ক্যাফের লোকটিকে বোঝালাম যে আমার ফন্টটি ইন্সটল করা জরুরী। সে এসে কিছুক্ষণ গুঁতাগুতি করে বলল আমি পারব না। আমাদের ইন্জিনিয়ারকে লাগবে। আমি বললাম তাহলে অনুগ্রহ করে কালকে করিয়ে নিও। বলল সে তো সব সময় আসে না।

এরপর অনেক খুঁজে পেতে গেলাম মোবাইল ইন্টারনেটের জন্যে সিম কিনতে। আমাকে একগাদা লিস্ট ধরিয়ে দিল - যে এই কাগজপত্র লাগবে। দেখলাম আমার এসব বের করতে মাস তিনেকের ধাক্কা। এই কদিন আমি ইন্টারনেট ছাড়া থাকব! পরবর্তীতে এক স্থানীয় আমাকে সাহায্য করে তার নামে পোস্ট পেইড সিমটি কিনতে। আমি কানেকটেড হতে পারলেও সার্ভিসের অবস্থা চরম খারাপ, কখনই তাদের উদ্ধৃত স্পীড পাওয়া যায়না। আর সন্ধ্যার পরে তো একেবারে স্লো হয়ে যায়। এর চেয়ে আমাদের দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের সার্ভিস অনেক ভাল।

চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম 
চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম

শ্রমের মূল্য কম বলেই বোধহয় এখানে কর্মদক্ষতাও কম। আর রয়েছে দুর্নীতি। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। কর্মচারী সংসদ থেকে রিসিট পর্যন্ত দেবে আপনাকে ঘুষের জন্যে। তাই সেবার মানও সেইরকম - কড়ি ঢালবেন তো সবকিছু এসে হাজির, না হলে কিছুই নড়বে না।

তবে দুর্নীতির মূলে মনে হয় ধনী গরীবের চরম বৈষম্য। এখানে আছে কারওয়ান বাজারের মত কাঁচা বাজার আবার নন্দন আগোরার মত শপিং মল (কারফুর, জায়ান্ট)। কারফুরে মাছের দাম কাঁচা বাজারের তুলনায় ২-৪গুণ। এমনিতে জাকার্তা খুব এক্সপেনসিভ জায়গা, একবার কারফুরে বাজার কররেই ৪০-৫০ ডলার নেমে যায়। এখানে সবই পাওয়া যায় কিন্তু তার মূল্য আছে - অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপের চেয়ে বেশী লাগল। রাস্তায় দেখা যায় মার্সিডিজ, বিএমডাব্লু। আবার এই দেশেই ১০০ ডলারে কাজের লোক পাওয়া যায়। ঠিক আমাদের দেশের মত। তারা কিভাবে এই শহরে বেঁচে থাকে জানার ইচ্ছে খুব।

সেদিন বৃষ্টি হলো। ঘন্টাখানেকের বৃষ্টিতেই শহরের কিছু অংশের রাস্তায় দেখা গেল একফুট পানি। জানা গেল নালা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে এই অবস্থা। সরকার ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে - কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

এদেশের তরুণদের মধ্যে ব্যান্ডপ্রীতি প্রচুর। সেদিন গেলাম আনচোল বীচে। সেখানে দেখি ব্যান্ড সংগীত হবে তাই নিয়ে লোকজনের উৎসাহের কমতি নেই। টিভিতে একেকজন শিল্পীর পোষাক দেখি আর মেলাই আমাদের পরিচিত শিল্পীর সাথে -এই যে জেমসের মতো চুল, আবার ওড়না পরেছে; এর গলার স্বরে হাসানের মত টান , আবার চুলও লম্বা।
আনচোল বীচ 
আনচোল বীচ

এই কদিনে আমাদের বিনোদন ছিল ইন্দোনেশিয়ার ভাষার চ্যানেলের টিভি দেখা। এদের কিছু জটিল সোপ আছে - যাতে ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর মত প্যাচ। কিছু সিরিয়ালের মূল লেখকও নাকি ভারতীয়। এখানে বেশীরভাগ সিরিয়ালেই মেয়েরা হয় ভিলেইন আর পুরুষরা হয় গোবেচারা টাইপের। পরে জানলাম আসলেই অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েশাষিত সমাজ এখানে।

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম এশিয়ার সর্ববৃহত মসজিদ - বিশাল পাঁচ তলা কম্পলেক্স এবং সামনে ঈদগাহের বিশাল খোলা মাঠ। তার অতি নিকটেই একটি ক্যাথেড্রাল। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ মুসলিম দেশে ধর্মীয় পোষাক কিন্তু দেখেছি কম। গরম বলে রাস্তা ঘাটে মেয়েরা পরে টি শার্ট এবং স্কার্ট বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, বিশেষ করে গৃহপরিচারিকারা। ছেলেরা সাধারণ শার্ট, প্যান্ট। কিছু ধনী মহিলাদের মাথায় হিজাব পড়তে দেখেছি, তবে তাদের অনেকেই ড্রাইভ করে। এটি মুসলিম দেশ বোঝানোর জন্যে আজান শোনা যায় পাড়ায় পাড়ায়। আমাদের দেশের মতই নামাজীর সংখ্যাও বেশী আর ঘুষখোরের সংখ্যাও।

এতসব মিলেই জাকার্তাকে আমার ঢাকার খুব কাছাকাছি লেগেছে। হয়ত ঢাকা আগামী পাঁচ কিংবা দশ বছরে এখানে পৌছাবে। দেশের অনেক কিছুই যেহেতু আমরা সহ্য করে নেই তাই মনে হচ্ছে এখানে থাকাও বেশ ইন্টারেস্টিং হবে।
জাকার্তার কিছু ছবি ফ্লিকারে -

× পোস্টকার্ডের জাকার্তা
× মেক আপ ছাড়া একই শহর
× ট্রেন যাত্রা
× বৃষ্টিবরণ

পোস্টের টাইটেলের জন্যে কৃতজ্ঞতা: হিমু

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Wednesday, July 22, 2009

বাহরাইন ও ওমানে বিদেশী শ্রমিকদের জীবন

মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যার বিশাল এক অংশ হচ্ছে মূলত: দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকরা। এই পোস্টে আমরা তেমন দুই ব্যক্তির কথা শুনব যারা দক্ষিন এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার জন্য এসেছেন।

মোহাম্মদ ইকবাল হচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার একজন নাগরিক যিনি বাহরাইনে থাকেন। তিনি বাংলাদেশী একজন শ্রমিকের গল্প বলেছেন (মূল ইংরেজী থেকে অনুবাদ):

আমি সম্প্রতি একজন বাঙ্গালীকে (বাংলাদেশী) দেখেছি যে একটা হোটেলে সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। সে আসলে হোটেলের পাবলিক এলাকাতে কাজ করে, যেমন কাচের জানালা পরিষ্কার করা, বা লবির মেঝে পরিষ্কার করা। সে অতিথি কক্ষের দায়িত্বে নেই বা কামরা ঠিক করে না। এখানে কোন বিষয়টি ঠিক না? তাকে ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) ব্যয় করতে হয়েছে বাহরাইনে কাজের ভিসা পাওয়ার জন্য। তার ২ বছর কাজ করার অনুমতি আছে। প্রতিদিন ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার) বেতন দেয়া হয় তাকে, তার মানে সে প্রতিমাসে ২৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৩৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৫ হাজার টাকা) আয় করে। এটা কি বেশ ভালো বেতন? দাড়ান...! তাকে তার ফ্লাট, পানি, বিদ্যুত, খাওয়ার জন্য টাকা দিতে হয় আর এরপর অবশ্যই দেশে টাকা পাঠাতে হয়।

আমরা হিসাব করি। বাড়ির জন্য সে অনেকের সাথে একটা ফ্লাটে থাকে যেটার জন্যে ব্যয় মাসে ধরা যাক ৫০ বাহরাইনি ডিনার (১৩২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার টাকা)। এরপরে পানি আর বিদ্যুত আরো ১০ বাহরাইনি ডিনার (২৬ আমেরিকান ডলার), আর এরপরে খাওয়া ৪০ বাহরাইনি ডিনার (৬৬ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৫ হাজার টাকা)। তাহলে বাড়ীতে নেওয়ার জন্যে পুরো অর্থ বাঁচবে বাংলাদেশী টাকায় ১১৫ (৩০৫ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২১ হাজার টাকা) প্রতি মাসে। এক বছরে (১২ মাসে) সে বাঁচাতে পারবে ১৩৮০ বাহরাইনি ডিনার (৩৬৬০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় আড়াই লাখ টাকা)। এই অর্থ ভিসা বা ঢোকার ফি হিসাবে দেয়া ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) শোধ করার জন্যে যথেষ্ট না। আমার কোন ধারণা নেই এই অর্থ সরকার নির্ধারিত কিনা, কিন্তু একটা জিনিষ আমার কাছে পরিষ্কার না যে ২ বছরে সে মাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) বাঁচাতে পারে। পরিশেষে সে তার ১৫০০ বাহরাইনি ডিনার (৩৯৮০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৩ লাখ টাকা) বিসর্জন দিয়ে আর দুই বছর কঠোর পরিশ্রম করেছে কেবলমাত্র ১২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৩৩৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা) এর জন্য। আরো দুই বছরের কাজের ভিসা বাড়াতে তাকে আবার ১০০০ বাহরাইনি ডিনার (২৬৫২ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ) বিনিয়োগ করতে হবে। তার মানে দুই বছর পরে, সে পারবে বাঁচাতে ২৬০ বাহরাইনি ডিনার (৬৯০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৪৮ হাজার টাকা) মাত্র আর আমি এখনও জানিনা সে কিভাবে এরপর তার বিমান ভাড়া দেয়। আমি আসলেই বুঝতে পারি না যেহেতু এটা যুক্তিযুক্ত না!


বাহরাইনে অবস্থিত একজন ফরাসী লেখক ফ্রান্সিন বারলেট গত মে মাসে ওমানের মাস্কাট থেকে বাহরাইনে আসার সময়ে ইয়াসমিনা নামে ভারতীয় একজন মহিলার সাথে কথা বলেছেন। এটা ইয়াসমিনার গল্প (মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ):

আমার চেন্নাইয়ের (ভারতে) জীবন খুব সহজ ছিল না, জানেন। কলেজে আমার দুই মেয়ে আছে। একদিন তারা ডাক্তার হবে। কিন্তু প্রথমে আমাকে তার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, আরো অনেক কিছুর জন্যে টাকার যোগাড় করতে হবে। আপনি জানেন, আমি কেবলমাত্র ওমানের সালালাহতে দুই মাস কাটিয়ে আসলাম। আমি গতকাল সেখানে আমার কাজ ছেড়েছি। আমি একটা ওমানি পরিবারের সাথে ছিলাম। ম্যাডামের দশটা বাচ্চা ছিল- আটটা মেয়ে আর দুইটা ছেলে- আর মে মাসের শেষে তিনি এগারোতম সন্তানের জন্ম দেবেন। আপনি বুঝতে পারছেন? এগারোটা বাচ্চা...সেটা চমৎকার। কিন্তু আমি সেখানে থাকবো না দেখার জন্য যে সেটা ছেলে না মেয়ে। আমাকে যেতে হবে। এটা কঠিন তাকে একা রেখে আসা, জন্মের এতো কাছে কোন সাহায্য ছাড়া রেখে আসা, কিন্তু আমি থাকতে পারবো না।

প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায়, তার স্বামী আমার শোয়ার ঘরে আসত। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি তাকে বলতাম, “আমি আপনার কর্মী, স্ত্রী নই। ফিরে যান, আপনার স্ত্রীর আপনাকে প্রয়োজন। নিজের বিছানায় ফিরে যান। আপনার অধিকার নেই আমার সাথে এমন করার। আমাকে বিশ্রাম নিতে দেন, আমি ক্লান্ত...”। আপনি কল্পনা করতে পারেন? দশটা বাচ্চা, বাড়ির কাজ, রান্না, কাপড় ধোয়া আর কয়েক টন ডিশডাশা আর আবায়া পোশাক ইস্ত্রী করা প্রত্যেক দিন যার সাথে ছিল চাদর, ডায়াপার আর তোয়ালে। কিন্তু আপনি জানেন, আমার কাজ করতে আপত্তি নেই। আমি অন্য কিছু কিভাবে করতে হয় জানিনা। আমি নিবেদিত। আমি কঠিন কাজকে ভয় পাইনা। কিন্তু রাত্রে আমার সাথে এমন করার অধিকার তার ছিল না। আমাকে ছোঁয়া, বিরক্ত করা। আমি তাকে থামাতে পারতাম না। জোর ছিল না... আমাকে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। দ্রুত।

বুঝেছেন, আমাদের মতো কাজের লোক যারা ভারত, শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া বা ফিলিপাইন্স থেকে আসে, তাদের দুই মাসের অর্ন্তবতীকালীন সময় থাকে, আর তার পরে তারা চুক্তি বাতিল করে ফিরে যেতে পারেনা। আমাদের পাসপোর্ট মালিকের হাতে আটক থাকে, আর তারা না চাইলে আমরা যেতে পারি না। আপনাকে আপনার দুই বছরের চুক্তি শেষ করতে হবে, বাড়িতে যেতে পারার আগে। এটাই আইন। আমি তাদেরকে বলেছিলাম আমি আমার অর্ন্তবতীকালীন সময় শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে চাই, এটা আমার অধিকার। তা সত্ত্বেও ওই গৃহস্বামী চায়নি যে আমি যাই।

এর পরে আমি খাওয়া বন্ধ করে দেই। পাঁচ দিন আমি আমার কামরা থেকে বের হইনি, আমি কিছু খাইনি, আমি স্নান করিনি। তারা ডাক্তার ডেকেছিল, আর সে পুলিশ ডেকেছিল। ওই! তারা আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। স্বামীকে আমার বাড়ী ফেরার প্লেনের টিকিট কিনে দিতে হলো, আর আমার পাসপোর্ট ফেরত দিল। এটা আইন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে খারাপ ছিল, জানেন। আমি পড়তে পারিনা। আমি বুঝতে পারিনি আমার প্লেনের টিকিটে কি লেখা আছে। বোর্ডিং এর সময়ে গালফ এয়ারের এটেন্ডেন্ট বলল যে আমার টিকিট রামানাথাপুরামের , আমার বাড়ী চেন্নাইএর না। আপনি বিশ্বাস করতে পারেন? আমি প্লেনে উঠতে অস্বীকৃতি জানাই। কোথায় যাবো? রামানাথাপুরাম এমন একটা শহর যেটা আমি চিনি না। সাথে কোন টাকাকড়ি নেই, কোনো সাহায্য ছাড়া, আমার বাড়ি থেকে ৬০০ কিমি দুরে কি করব? ভাগ্যক্রমে, রামানাথাপুরাম থেকে চেন্নাই পর্যন্ত পুলিশ আমার টিকিটের টাকা দিয়েছে। সেই স্বামীটা তাদেরকে ফিরত দেবে। পুলিশরা ঠিক কাজ করেছে, জানেন। এটার খরচ পরেছে ৬০ রিয়াল (আমেরিকান ডলার ১৫৫)... আমার জন্য এক মাসের বেতন!

আমি দুবাইতে এর আগে পাঁচ বছর ছিলাম যেখানে আমি ‘লাফ’ দিয়েছিলাম (লাফ দেয়া মানে: মালিককে ছেড়ে দিয়ে, পাসপোর্ট ছেড়ে দিয়ে, অন্য কোথাও ভালো বেতনের একটা কাজ নেয়া, কিন্তু আইনসঙ্গতভাবে নয়)। আগে সৌদি আরবে আমি দুই বছর কাজ করেছি, দুই বছর ওমানে। আমি আবার আসব। এই দেশকে আমার আসলেই ভালো লেগেছে। কিন্তু এখনই না। প্রথমে আমি আমার মেয়েদেরকে দেখতে চাই আর একটু বিশ্রাম নিতে চাই।

প্রথম প্রকাশ: গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলায়আয়েশা সালদানহার রচনা থেকে অনুবাদ।

Monday, July 13, 2009

স্টে ওকে এবং স্পীড জিকিং


(পূর্ববর্তী পর্বগুলো , )

'স্টে ওকে' হচ্ছে আমস্টার্ডামে আমাদের থাকার জায়গার নাম। বিকেলে ট্রেন থেকে সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে ট্রামে করে ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম এটি একটি ব্যাগপ্যাকার্স হোটেল। এটি অনেকটা ইয়থ হোস্টেলের মত তবে এখানে পুরুষ- নারী, যুবা ও বয়স্করা সবাই থাকতে পারে। কনফারেন্স এর লজিস্টিক্স এর দায়িত্বে রয়েছে আমেরিকান বিশালদেহী মাইক যার মুখে একটি চিরন্তন হাসি ঝুলে আছে, খুবই মাইডিয়ার টাইপের। তার কাছ থেকে (ইলেক্ট্রনিক) চাবি বুঝে নেবার সময় আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বলল পড়। পড়ে দেখলাম একগাদা নিয়মকানুন। সে বলল, কিছু মনে করো না, এরা বড্ড কড়া। দয়া করে এগুলো মেনো না হলে ফাইন ২৫০ ইউরো। নিয়মগুলোর মধ্যে ছিল কোন রকম খাওয়াদাওয়া, ধুমপান, মদ্যপান, মাদক নেয়া ইত্যাদি করা যাবে না। আমি হেসে বললাম এমন ভাবে লিখেছে যেন মাদক ছেলে হাতের মোয়া। সে বলল জানো না এখানে হাশিস পাওয়া যায় কফি শপে; তাই বলে এখনই আবার তুমি কফি শপের উদ্দেশ্যে রওনা দিও না। ডিনার খেয়ে বের হয়ো।

আমার রুমে তিনটি বান্কার বেড, সাকুল্যে ছয়জন থাকা যায়। আমি নীচের এক বেড বেছে তার নীচে উঁকি দিলাম দেখি আরেকটি বেড রয়েছে বিছানা পাতার জন্যে। তার মানে কোন কিছুই চুড়ান্ত এমন ধারণা করা যাবে না। একটি টয়লেট, আলাদা বেসিন ও শাওয়ারের রুম। এক কোনায় স্যুটকেস রেখে ল্যাপটপের ব্যাগ সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমাদের ডিনারের সময় দেয়া হলো বিকেল ৬:৩০ এ। হোস্টেলের কিচেনের পাশে ডাইনিং এ লাইন দিলাম। বেশ মজাই লাগছিল, পাশের হট্টগোল করা ভেনেজুয়েলার একদল টিনএজারদের মত যেন বয়স অনেক কমে গেছে। আসলে পরিবেশ আমাদের চিন্তা চেতনার উপর ভালই প্রভাব রাখে।

সূর্য ডুবতে অনেক দেরী তাই নেপালের বসন্তের সাথে বেরিয়ে পরলাম খাওয়ার পরে। সে চালু ছেলে, রায়ান এয়ারের কিছু সস্তা প্লেন টিকেট কিনে ইউরোপ ভ্রমণের ব্যবস্থা পাকা করেছে। শুধু আমস্টারডাম-বার্লিনের টিকেট পায়নি। আমি ট্রেনে এসেছি শুনে ঠিক হলো তাকে বার্লিনের ট্রেনের টিকেট কিনে দিয়ে একটু বেড়াতে বের হব আমরা।

সেন্ট্রাল স্টেশনে যাওয়ার পর ট্রেনের টিকেট পাওয়া গেল। এরপর একটু ঘোরাঘুরি করে দাম স্কোয়্যারে আসলাম। বসন্ত সকালে এসেছে বলে ইতিমধ্যে একটি গাইডেড টুর দিয়ে ফেলেছে এই সব অঞ্চলে। সেখানে রাণীর প্রাসাদ দেখার পর হাটতে হাটতে বসন্ত আমাকে বলল আমার সাথে চল একটি জিনিষ দেখাব। আমি বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সে আমাকে নামকরা টুরিস্ট এট্রাকশন রেড লাইট এরিয়ার দিকে নিয়ে গেল। আমি তাকে বললাম তুমি এই যায়গা কেমনে চিনলা? সে বলে এতো গাইডেড ট্যুরের অংশ ছিল। সে আরও এলাকার ইতিহাস বলতে লাগল -দশ বছর আগে থেকে এখনকার কাচের বুথের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিকিনি পরা কড়া মেকাপসহ পতিতাদের কাচের দেয়ালের ভেতর থেকে শরীর প্রদর্শন আমার কাছে মোটেই রুচিকর কিছু মনে হলনা। আমি দেখতে লাগলাম মানুষকে, কারন খালের দুধারের সরু রাস্তায় পুরো গিজ গিজ করছে ট্যুরিস্ট। টিন এজার থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়ি সবাই অবাক বিষ্ময়ে হেটে হেটে দেখছে। এ যেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য, আর তার উইন্ডো শপিং। ক্যানেলে স্পেশাল বোট রাইড - রেড লাইট ট্যুর। হল্যান্ডের সেরা ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ।

পরের দিন কনফারেন্সে আলাপ হলো মধ্যবয়সী ডাচ অ্যাক্টিভিস্ট পেট্রার সাথে যিনি পতিতাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। তার ল্যাপটপে স্টীকার লাগানো 'হোরস রক' এবং এ নিয়ে ভারতে এক কনফারেন্সে তাকে কি রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে সে নিয়েও গল্প করলেন তিনি। তার বক্তব্য হচ্ছে এই রেড লাইট এরিয়ার জন্যে আমস্টারডামে অনেক ট্যুরিস্ট আসে তাই তাদের রক্ষার জন্যে আরও সুযোগ সুবিধা দিতে হবে সরকারকে। সেখানে নাপিত দেয় ৬% ভ্যাট (নিত্য প্রয়োজনীয়) আর পতিতারা দেয় ‌১৯% (লাক্সারী) ভ্যাট। কাজেই এই হার কমাতে হবে। আমি ভাবলাম কোথায় এসে পরলাম বাবা!

ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯

অবশেষে কনফারেন্স শুরু হলো। মডারেটর অ্যালেন গান (ডাক নাম গানার) বেশ মজার মানুষ। প্রথমে ছিল প্রায় ৭০ জন লোকের পরিচয়পর্ব। নাম ও ধামের সাথে তিনি জুড়ে দিলেন 'আজ আপনি কেমন বোধ করছেন' প্রশ্নটি। বেশ মজার মজার উত্তর বেড়িয়ে আসল এবং জড়তা ভাঙ্গল অনেকের। এর পরে ছিল ওপিনিয়ন স্পেক্টোগ্রাম - একটি খালি জায়গায় কাল্পনিক বিভক্তি ধরে দুটি বিপরীত মতামতের ক্ষেত্রে কার কি অবস্থান (দুই প্রান্তে, না মাঝামাঝি) তা বের করা হলো। সেগুলো ছবিতে তুলে রাখা হলো রেকর্ডের জন্যে। এরপর গানার গিয়ে কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে বা তারা তাদের অবস্থান নিয়েছে।

বর্তমান অনেক কনফারেন্সেই যেভাবে এজেন্ডা তৈরি করা হয়, সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো এখানেও। সবাই স্টিকি নোটে কি জানতে চায় ও জানাতে চায় তা লেখা শুরু করল। তারপর সবগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করা হলো। উইকিতে তোলার পর সেগুলো এরকম দাড়ালো

এই বিষয়গুলো নিয়েই কনফারেন্সের এজেন্ডাকে ঢেলে সাজানো হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে মূলত: দুটি ভাবে কার্যক্রম সাজানো হয়েছিল। ৮-১০টি বিষয় বাছা হতো একেক সেশনে এবং ইচ্ছে অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যোগ দেয়ার সুযোগ ছিল। ফলে সবাই তার সবচেয়ে আগ্রহের আলোচনায় যোগ দিয়েছে এবং আরও আলোচনায় যোগ না দিতে পারায় আক্ষেপ করেছে। ফলে অন্যান্য কনফারেন্সের মত নিজের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক বা বোরিং জিনিষ শুনতে হয়নি। শুধু শেষে সব কটি আলোচনার সামারী একেকটি দল পড়ে শুনিয়েছে যাতে অন্যেরা বুঝতে পারে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।


আরেকটি মজার জিনিষ ছিল - স্পিড-জিকিং - অনেকটা স্পিড ডেটিংয়ের মত। দৈবচয়নের মাধ্যমে নাম্বার দিয়ে পুরো গ্রুপকে ৮টি আলাদা দলে ভাগ করা হল। আটজন জিক (বা প্রযুক্তিবিদ) তাদের কোম্পানী বা কার্যক্রম সম্পর্কে বর্ণনা করতে লাগল ৪ মিনিটের মধ্যে এককটি গ্রুপের কাছে। ৪ মিনিট শেষ হতেই এক টেবিল থেকে আরেকট টেবিলে চলে গেল দলটি। এতে সুবিধা হলো কারও কোন কিছু শুনতে পছন্দ না হলে সেই টেবিল থেকে সরে গেলেই হলো বা ৪ মিনিটের বেশী বোরড হওয়া লাগল না। এভাবেই সারা দিন শেষেও সবাই ছিল পুরোপুরি ইনভল্ভড।

কনফারেন্সের আলোচনার যে অংশগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা নিয়ে আলাপ করব পরবর্তী পর্বে।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Monday, July 06, 2009

আমস্টার্ডামের পথে


সকালে রওনা হয়েছি বার্লিন হপ্টবানহফের (প্রধান রেল স্টেশন) দিকে। গাড়ীতে যাব তাই সেইভাবে সময় হিসেব করেই বেরিয়েছি। কিন্তু পথিমধ্যে দেখলাম শার্লোটেনবার্গের চারিদিকে ব্যারিকেড দিয়ে অনেক রাস্তা বন্ধ, একটি সাইকেলের রেস হবে। পুলিশকে অনুরোধ করলাম সাইকেলের বহর আসতে তো মনে হয় সময় লাগবে, মোড়ের পথটুকু ছেড়ে দিলেই আমি গন্তব্যস্থলে যেতে পারি, নতুবা আমি ট্রেন মিস করব। কিন্তু বুঝলাম বৃথা চেষ্টা, রোবটের মত নিয়মের বাইরে আর কোন কিছু বিবেচনা করাটা তাদের রক্তে নেই। আমাকে বলে কিনা এটি তো আমরা আগেই জানিয়েছি তুমি দেখোনি তাই তোমার দোষ। গাড়ীতে ঘুরে যেতে অনেক সময় লাগবে, আর কোথায় কোথায় রাস্তা বন্ধ আছে তাও জানা নেই। কি করে দ্রুত স্টেশনে পৌছানো যায় তাই ভাবছি। হঠাৎ করে মনে হলো সিটি ট্রেন (এস বান) তো আর আটকাতে পারবেনা। তাই দ্রুত নিকটস্থ এস বান স্টেশনে গিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত হপ্টবানহফে সময় মত পৌঁছুতে পারলাম।

আমস্টারডাম এর আগেও গিয়েছি, তবে স্বল্প সময়ের জন্যে। এবারের যাত্রাটি ভিন্ন -ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস ২০০৯ কনফারেন্সে যোগদান করতে যাচ্ছি। সাথে গ্লোবাল ভয়েসেসের কিছু বন্ধুরও দেখা হবে ভেবেই পুলকিত হচ্ছি।
ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের দুটি ট্রেন একসাথে লাগানো। কাধে হাত দিয়ে ঝমাঝম করে গিয়ে মাঝপথে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। না রুপকটা ঠিক হলো না। ঝমাঝম করবে কি, ট্রেনের লাইনে কোন কাটা নেই কাজেই ঝমাঝম বা ঝক্করঝক বলুন কোন শব্দই হয় না। এত বোরিং!!

স্টেশনের প্লাটফর্মের নোটিশ বোর্ডে ট্রেনের একটি ড্রয়িং আছে যেখান থেকে বোঝায় কোন বগী প্লাটফর্মের কোন জোনে থামবে। সেটি আগে থেকে দেখে রাখায় সঠিক ট্রেনে ও সঠিক বগীতেই উঠলাম। সাধারণত: ট্রেন থামে দুই মিনিটের জন্যে কাজেই ভুল হবার অবকাশ নেই। আইসিইতে ভ্রমণের একটি আরাম আছে, অনেক লেগ স্পেস, বিমানের চেয়েও আরামদায়ক সীট, কয়েক চ্যানেলে গান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, মোবাইল জোন আর চলে সর্বোচ্চ ২৫০ মাইল গতিতে। আমার বুকিং নির্দেশ করা জানালার পাশের সীটে বসলাম। কামরায় অনেক সিট বুকিং না করা যাত্রীও আছে তারা ফাঁকা সীটে বসতে পারে। তবে আমার পাশের সীট ফাঁকা রইল অনেকক্ষণ। আমি এটি মাঝে মাঝে খুব এনজয় করি। আমি এক কালো ভিনদেশী বলে মাঝে মধ্যে কিছু শেতাঙ্গ আমাকে সম্মান করে পাশের সীট ছেড়ে দিয়ে দুরে কোথাও বসে। এই বাড়তি স্পেসটুকুর সুযোগ মুফতে কোথায় পাওয়া যায় বলুন!

আমি পাসকাল মার্সিয়েরের বেস্টসেলার বই নাইট ট্রেন টু লিসাবন খুলে বসলাম, তবে কতক্ষণ পড়েই হোঁচট খেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কেন পড়া দ্রুত আগাচ্ছে না। আসলে এটি বার্বারা হারসভ কর্তৃক মূল জার্মান থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ। ভাবতে লাগলাম অনুবাদক কি ইচ্ছে করেই কিছু অংশ দুর্বোধ্য করেছেন না মূল সংস্করণের দিকে বেশী নজর রেখেছেন লেখার মসৃণতার দিকে খেয়াল না রেখে। এ বিষয় নিয়েও আলাপ হবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সে।
এবার কানে হেডফোন দিয়ে সঙ্গীতে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ করে মনোযোগে ছেদ হলো। হানোভার থেকে উঠা এক তরুণী আমার পাশে এসে বসল। তার স্যুটকেসটি পায়ের সামনে রাখলো, তাই লেগস্পেস অনেক কমে যাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আমি ইংরেজীতে বললাম যে মাথার উপরে স্যুটকেসটি রাখতে পারেন। সে বলল আমি তো তুলতে পারব না এটা। আমি বললাম নো প্রবলেম আমি তুলে দিচ্ছি। এরপর আবার সঙ্গীতে ডুবে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম কোন দেশী হতে পারে মেয়েটি। টার্কিশ? নাকী ভারতীয় উপমহাদেশের? একসময় আলাপ হলো মেয়েটির সাথে। নিউ দিল্লী থেকে এসেছে ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটে ভাইভা দিতে। মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স করেছে, এখন পিএইচডি করার ইচ্ছা। জিজ্ঞেস করলাম যে ভাইভা দিতে এতদুর এসেছে কেন। বলল যে শর্ট লিস্টে থাকা অ্যাপ্লিকান্টদের আসা যাওয়া থাকার খরচ ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটই দিচ্ছে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হোক বা না হোক। ভাল ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে তাদের এই পরিমাণ উদ্যোগ দেখে অবাক হওয়ারই কথা। ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্টে সে নামবে দিল্লির প্লেন ধরবে তাই। আমি নেমে গেলাম ডুইসবুর্গে, ট্রেন চেন্জ করতে। আধা ঘন্টা সময় ছিল তার মধ্যেই পিজ্জা দিয়ে লান্চ সাড়া হলো।

এর পরে আবার যাত্রা শুরু হলো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম কখন বর্ডার পার হব সেটি খেয়াল করার জন্যে। নাহ, এবারও ব্যর্থ হলাম। কখন নেদারল্যান্ডে ঢুকে গিয়েছি টের পাইনি। একটি শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার সাইন দেখে টের পেলাম। শেনঘেন চুক্তির আওতায় যে সমস্ত ইউরোপীয় দেশ আছে তাদের বিপুল পরিমান কর্মঘন্টা প্রতিদিন বেচে যায় এই ভিসা/ইমিগ্রেশন উঠিয়ে দেবার কারনে। আর লোকজনেরও কত আরাম! অথচ ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে কি হ্যাপা পোহাতে হয় আর কত ঘন্টা নষ্ট হয় ভিসি/ইমিগ্রেশনের কারনে সেটা ভাবলে কষ্ট হয়।

ওপেন ট্রান্সলেশন:

এই বিষয়ে বলতে গেলে ওপেন সোর্স আন্দোলনের কথা বলতে হয়। এটি আসলে ব্যাপক আলোচনার বিষয়, আমি শুধু সংক্ষেপে বলব। এখানে ওপেন মানে হচ্ছে রয়্যাল্টি বিহীন এবং সোর্স মানে হচ্ছে সোর্স কোড, অর্থাৎ যেই সোর্স কোড সবাই অ্যাক্সেস করতে পারে। এই টার্মটি প্রথম অফিশিয়ালি ব্যবহার করা হয় ১৯৯৮ সালে আয়োজিত "ফ্রিওয়্যার সামিটে"। পরবর্তীতে এই সামিটের নামকরণ করা হয় ওপেন সোর্স সামিট। সে বছরই ওপেন সোর্স ইনিশিয়েটিভ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে যা বিশ্বব্যাপী ওপেন সোর্স আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাজ শুরু করে।
এসপায়ারেশনটেক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি এনজিও যারা বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার তৈরী, কমিউনিটি এবং নেটওয়ার্কিং সুবিধা দেয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচী আয়োজন করে। তারা এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫টি বিভিন্ন ইভেন্টের আয়েোজন করেছে নানা ডোনরের সহযোগীতায়। তাদের আরেকটি সাফল্য বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার টুলসের একটি পোর্টাল তৈরী করা যার নাম সোশ্যাল সোর্সেস কমন্স

২০০৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে তারা প্রথম ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সের আয়োজন করে। সেখানে ওপেন সোর্স ট্রান্সলেশন টুলস এবং ওপেন কন্টেন্ট অনুবাদের ব্যাপারটি নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়।

আসলে ট্রান্সলেশন বা অনুবাদ সারা বিশ্বে একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। অনুবাদের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে এবং এর জন্যে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়। উদাহরণস্বরুপ ইইউর প্রতিটি কার্যাবলী বা স্টেটমেন্ট যা প্রকাশিত হয় তা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর ২৫টিরও বেশী সদস্যদেশের ভাষায় অনুদিত হতে হয়। মার্কিন সরকারের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষা (আরবী, ফার্সী) ইত্যাদিতে প্রকাশিত সংবাদ, ব্লগ, ওয়েবসাইট ইত্যাদি অনুবাদ করে মনিটর করার জন্যে। এইসব সংগঠনের প্রচেষ্টা মেশিন ট্রান্সলেশন সফ্টওয়্যার তৈরী যা তাদেরকে কম খরচে অনুবাদের সুবিধা দেবে। ওপেন সোর্সেও কিছু মেশিন ট্রান্সলেশন সুবিধা আছে যেমন গুগল ট্রান্সলেট। কিন্তু কোন মেশিন ট্রান্সলেশনই এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি। ভাল অনুবাদের জন্যে মানুষের দ্বারা অনুবাদের বিকল্প নেই। কিন্ত পেশাজীবি অনুবাদকের দ্বারা সেই কাজ করতে অনেক খরচ।

ওদিকে পাশাপাশি আরেক ধরনের কমিউনিটি বেইজড অনুবাদ আন্দোলন কিন্তু আমাদের অগোচরে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক সফ্টওয়্যার এখন বাংলাতে পাই। যেমন ওপেন অফিস, গুগল, ওয়ার্ডপ্রেস। এইসব লোকালাইজেশন কিন্তু সম্ভব হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি ট্রান্সলেশন দ্বারা। অনেকেই অনুবাদ করে নিজের চর্চার জন্যে বা শখের বসে। এতে টাকা পাওয়া যায়না বটে, কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়া যায় এবং হয়ত নানামুখী অনেক সুযোগ গুগল ইন ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ সেরকম একটি বড় প্রকল্প। সে তো হলো সফ্টওয়্যার। স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি দ্বারা কন্টেন্ট অনুবাদের কয়েকটি উদাহরন হলো ডটসাব (বিভিন্ন ভাষায় ভিডিও সাবটাইটেল করা), গ্লোবাল ভয়েসেস লিঙ্গুয়া প্রকল্প (ব্লগ কন্টেন্ট বিশটির মত ভাষায় অনুবাদ), টেড ওপেন ট্রান্সলেশন প্রকল্প ইত্যাদি। এসবই ওপেন ট্রান্সলেশনের উদাহরণ।
(আগামী পর্বে থাকবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯ এবং আমস্টার্ডামের গল্প)

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Sunday, July 05, 2009

বহুভাষী ওয়েব এবং উন্মুক্ত অনুবাদ


এমন এক সময় ছিল যখন তথ্য শুধু লাইব্রেরী, বা সরকারী তথ্যাগারে থাকত। মানুষের কাছে তা সহজলভ্য হতো বই বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু ইন্টারনেটের প্রথম বিপ্লব এই বাধাকে ঘুঁচিয়ে দিল। বিভিন্ন স্ট্যাটিক ওয়েব পেইজের মাধ্যমে এবং অনলাইন সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ চলতে লাগল।

এরপর আসল ইন্টারনেটের দ্বিতীয় জাগরণ। এটি ভেঙ্গে দিল কারা তথ্য সৃষ্টি করবে তার মনোপলি। লক্ষ কোটি মানুষ ডিসকাশন ফোরাম, ব্লগ, ছবি, ভিডিও ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্যের সৃষ্টি ও আদান প্রদান করতে লাগল বিশ্বব্যাপী পাঠক-শ্রোতাদের জন্যে।

কিন্তু তথ্যের মনোপলি কি ভেঙ্গেছে? তথ্য আগেও উৎকৃষ্ট পণ্য ছিল, এখনও আছে। যেই তথ্যের চাহিদা বেশী, যোগান কম, তার মূল্য তত বেশী। বর্তমানে তথ্যের চাহিদা একই আছে (মানুষের তথ্য গ্রহণ করার ক্ষমতা অপরিবর্তিত আছে)। কিন্তু এখন তথ্যের যোগান অনেক। কিবোর্ড টিপলেই ডজনখানেক বাংলা পত্রিকা পড়া যায় আর ইংরেজীতো অগুণতি। তথ্যের এই বিস্ফোরণকে কেভিন কেলী বলেছেন দ্যা এক্সপানশন অফ ইগনোরেন্স। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে যত বেশি তথ্য সহজলভ্য হচ্ছে তত আমাদের প্রশ্ন বেড়ে যাচ্ছে এবং উত্তরের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের উত্তরের যোগানের বিপরীতে প্রশ্নের হার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অজ্ঞানতা বাড়ছে। এটাকেই তিনি বলছেন দ্যা এক্সপানশন অফ ইগনোরেন্স।

তথ্যের প্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে অপ্রক্রিয়াজাত তথ্যের মূল্য কমে যায় এবং মূল্য থাকে সেই সব তথ্যের যা আমাদের কাছে সংকলিত, অনুবাদিত, সহজবোধ্য; আমাদের বোধগম্য অবস্থায় যা পাওয়া যায়।

আপনি চিন্তা করুন দশ বছর আগের ইন্টারনেটের কথা। তখন বাংলা ইউনিকোড ছিল না। বাংলা ভাষায় কটি ডকুমেন্ট পাওয়া যেত? আজকে বাংলা উইকিপিডিয়ায় ২০০০০ এরও বেশী এন্ট্রি আছে। বাংলা ব্লগগুলোতে হাজার হাজার পোস্ট (যদিও যথার্থতা, মান নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকগুলোর)। কয়েক বছর আগের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাঁচ কোটি ব্লগের ৩৯% ইংরেজী ভাষায় ছিল। এর পরে ছিল জাপানী (৩৩%), চৈনিক (১৪%), স্প্যানিশ (৩%), ইটালিয়ান (৩%), রাশিয়ান (২%), ফ্রেন্চ (২%), পর্তুগীজ (১%), জার্মান (১%) ইত্যাদি। বর্তমানে এই পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই অনেক বদলেছে, ইংরেজী ভাষার আধিপত্য কমে অন্যান্য ভাষার জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারন সবাই তার নিজের ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।

তবে ইথান জুকারম্যান বলছেন যে আজকের ইন্টারনেট পরিমন্ডলে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার ভয় রয়েছে। আগের ইংরেজী ভাষার আধিপত্যের সময় পাঠকরা ভাষার বাধা ডিঙ্গিয়ে এক ভাষায় কথোপকথনের চেষ্টা চালাতো। বর্তমানে নিজের ভাষায় কথোপকথনের সুবিধার কারনে ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে যে বিভিন্ন ভাষা ভাষাভাষীদের কমিউনিটিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানেই ব্যস্ত বেশী এবং অন্যান্য ভাষার কমিউনিটির সাথে যোগাযোগে আগ্রহী নয়। বা আগ্রহী নয় অন্যান্য ভাষায় পাওয়া যাওয়া বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে।

বিশ্বের অনেক কিছুই আমরা ভাষা জানি না বলে অন্যের দৃষ্টিতে দেখি। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর বই বাংলায় অনুদিত হচ্ছে কি না বলে হা পিত্যেশ করে বসে থাকি, যাও হয়ত অনুবাদ করা হবে ইংরেজী অনুবাদ থেকে।
ভাষার বাধা তথ্য প্রবাহে মস্ত বড় বাধা। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় পাওয়া যাওয়া ইন্টারনেট কন্টেন্টের কত অংশ বুঝতে পারি? এমন তথ্য নিশ্চয়ই আছে যা আমি জানতে চাই কিন্তু ফার্সী ভাষায় আছে বলে জানতে পাচ্ছি না। কিন্তু এই বাধা দুর করার উপায় কি?

বর্তমানে বেশ কিছু ভাষার জন্যে মেশিন ট্রান্সলেশন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। গুগল ৪২টি ভাষা সাপোর্ট করে, কিন্তু তার মধ্যে বাংলা নেই। আর মেশিন অনুবাদের মানও আশানুরুপ নয়। মেশিন ট্রান্সলেশন নিয়ে কাজ করছে এমন এক প্রযুক্তিবিদের সাথে আলাপ করে জানলাম যে আগামী দশ বছরেও পার্ফেক্ট অনুবাদ প্রযুক্তি আবিষ্কারের সম্ভাবনা কম। কারন অনুবাদের সাথে স্টাইল, প্রাসঙ্গিকতা, সাংস্কৃতিক পটভূমি ইত্যাদি জড়িত এবং এটি শিল্প বলেই একে লজিকের দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা যায় না। মেশিন অনুবাদের দ্বারা খুঁটিনাটি ও খাপছাড়া কাজ চলবে কিন্তু রিসার্চ বা প্রচলিত অনুবাদের জন্যে মানুষ কর্তৃক অনুবাদের বিকল্প নেই।

সারা বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষ একের অধিক ভাষা জানে। যে বাংলা এবং হিন্দি জানে, সে সহজেই হিন্দি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে পারে (যা মেশিন অনুবাদের মাধ্যমে সম্ভব নয়, এখনো)। অনেকেরই সময় আছে তা করার জন্যে। ওপেন সোর্সের মত ওপেন ট্রান্সলেশন ও একটি আন্দোলন যার মাধ্যমে ইতিমধ্যে বেশ অনেকগুলো সফল কাজ হয়েছে বিশ্বের অনেক ভাষায়ই। বাংলার ক্ষেত্রে কলাবরেটিভ ট্রান্সলেশন এবং লোকালাইজেশন এর উদাহরণস্বরুপ বাংলা উইকিপিডিয়া, গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা সংস্করণ, ওয়ার্ডপ্রেস বাংলা লোকাইলেজেশন প্রকল্প মেঘদুত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

একটি বাংলা মেশিন ট্রান্সলেশন প্রকল্প - অনুবাদক কাজ করছে সেটিও ক্রাউডসোর্সিং (স্বেচ্ছাসেবীদের ইনপুট) এর মাধ্যমে এগিয়ে চলছে।

ইন্টারনেটকে আমাদের নিজস্ব ভাষায় সহজবোধ্য করার জন্যে দরকার বিভিন্ন টুল এবং আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবী। যে যেই দ্বিতীয় ভাষা জানেন সেই ভাষার কন্টেন্ট যদি বাংলায় অনুবাদ করেন ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন তাহলে বাংলা ভাষা ইন্টারনেটে প্রাণ পাবে। বেশী পরিমান লোক অনায়াসে তথ্য পাবে যা এখনও সহজলভ্য নয়।

ইথান জুকারম্যানের কথা দিয়েই শেষ করি:
"For the internet to reach its potential in bridging human differences, we need to make the problems of language and translation center to our conversations about the future of the internet."
অনুবাদের ভারটুকু আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

বি: দ্র: গত মাসে আমস্টারডামে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সে অংশ নেয়ার পর তা নিয়ে লিখব লিখব করছিলাম। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এটি তার পটভূমি মাত্র। পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব।

(ছবির সূত্র)

 প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Friday, July 03, 2009

অন্কেল আর টান্টে ক্লুটজকোভস্কি

ক্লুটজকোভস্কি দম্পত্তি
আশি বছর বয়সী এই জার্মান বুড়ো এবং তার স্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি? তাদের সাথে দেখা হওয়ার আগে তা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করার উপায় ছিল না।

হঠাৎ করেই এক দাওয়াতে পরিচয় তাদের সঙ্গে। উনি প্রথমেই উপস্থিত সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন যে তার ইংরেজী জ্ঞান খুবই সীমিত। ওনার স্ত্রী একেবারেই পারেন না, তাই আমাদের কারও কারও কথা অনুবাদ করে দিতে হচ্ছিল। পাশে বসেছিলাম বলেই অনেক কথা বলার সুযোগ হলো এবং আস্তে আস্তে আমরা সত্তুরের দশকে চলে গেলাম। আশে-পাশের সব কিছুই তখন গৌণ মনে হতে লাগল।

১৯৩০ সালে জন্ম হর্সট ক্লুটজকোভস্কির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার অনেক অংশই চোখের সামনে দেখা। বাস তার বৃহত্তর বার্লিনের বুখ অঞ্চলে। ১৯৭২ সালে তিনি একটি ফিল্ম স্টুডিওতে কাজ করতেন। তিনি ছবি তুলতেন আর তার স্ত্রী সাহায্য করতেন তা প্রসেস করতে। হঠাৎ করেই তার কাছে খবর এল বাংলাদেশ থেকে কিছু আহত যোদ্ধা এসেছে বুখের সলিডারিটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। বাংলাদেশ! তার স্ত্রী বলছিলেন যে সাধারণ: জার্মানদের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবাই হচ্ছে ইন্ডার (ভারতীয়)। ভারত সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনী জানা থাকায় তাদের সম্পর্কে কৌতুহলও কম ছিল না। তাই তারা ছুটে গেলেন এই যোদ্ধাদের সম্পর্কে জানতে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটি ডকুমেন্টারী করার। সেটি করলেনও এবং তার থেকেও বেশী এই বাদামী কিছু মানুষের টান্টে (মাসী) আর অন্কেল (কাকা) হয়ে গেলেন চিরদিনের জন্যে।

পূর্ব জার্মানী হচ্ছে তৃতীয় দেশ যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় (১১ই জানুয়ারী ১৯৭২)। এর পরেই ধাপে ধাপে বেশ কিছু আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্যে। এদের প্রাথমিক সমস্যা ছিল ভাষা। অন্কেল হর্সট তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী দিয়ে এদের সাহায্য করতে থাকেন।

টান্টে বলছিলেন যে নার্স খাবার নিয়ে এসেছে। মসলা ছাড়া আলু ভর্তা আর সব্জি দেখে আহত যোদ্ধা বলে চলে নো নো রাইস, রাইস। নার্স বুঝতে পারছে না কি করবে। তখন তিনি নার্সকে বলে সস বা ভাত যোগ করে কিছুটা খাবার উপযোগী করে দেন। একজনের কনুই থেকে দুই হাত কাটা পড়েছে। টান্টে প্রতিদিন চলে যেতেন তার কাছে। বাহু দুটো চুলকে দিলে কিছুটা আরাম পেতেন যোদ্ধা। পরম মমতাভরা তাদের এইসব সাহায্য বাঙালী যোদ্ধারা কৃতজ্ঞতা ভরে এখনও স্মরণ করে, তারা বললেন।

সে অনেক নাম; হারুন, হক, দৌলা, শেরু যাদের তারা শুশ্রূষা করেছেন। আমি অধিকাংশকেই চিনতে পারলাম না, চেনার কথাও না। এর পর ব্যাচের পর ব্যাচ আহত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে যেতে লাগল পরবর্তী কয়েক বছরে। তারা পূর্ব বার্লিনে নেমেই অন্কেল-টান্টের খোঁজ করতে লাগলেন। শেরুর (প্রাক্তন কুটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী) কথা বলতে থাকলেন যে শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল কারন পায়ের হাড্ডি চূর্ণবিচুর্ণ হয়েছিল। ডাক্তাররা মনে করেছিলেন বাঁচাতে পারবে না। অপারেশনের দিন সারারাত টান্টে জেগে ছিলেন। তারপর ভালো হয়ে যাওয়ার পর পায়ের ব্যান্ডেজের জন্যে প্লেনে ফিরতে পারছিলেন না শেরু। বিশেষ কার্গো প্লেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হলো তিন মাস। এ তিন মাস তিনি টান্টে-অন্কেলের কাছেই নিজের ছেলের মত ছিলেন এবং খুব ভালোভাবে জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। এভাবেই নানাপ্রকারে এই দম্পতি বাঙ্গালীদের সাহায্য করেছেন।

তিনি শুনেছেন যোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি তার ডকুমেন্টারিটি বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছিল নাকি ৭৩-৭৪ সালে। আমি জিজ্ঞেস করলাম জার্মানিতে প্রচারিত হয়নি? তিনি বললেন, "না" এবং আর কিছু বললেন না। আমি নাছোরবান্দা ভাবে জিজ্ঞেস করেতে লাগলাম ডিডিআর সরকারের ভূমিকা ছিল কত বাঙ্গালীদের সাহায্য করায়?

তিনি তখন বলা শুরু করলেন, "আমি যা করেছি ব্যাক্তিগত ভাবেই করেছি। আমি জানি যুদ্ধের বিভীষিকা কি। আমি যখন তাদের সাহায্য করা শুরু করি তখন নানা পক্ষ বিভিন্ন ভাবে ব্যাপারটি দেখে। বাংলাদেশ এম্ব্যাসী থেকেও আমার ডাক শুরু হয়, যেন আমার কাজই তাদের সাহায্য করার। আমার বাসায় কয়েকজন বাঙ্গালী থাকা অবস্থায় আমি লক্ষ্য করলাম আমার বাড়ীর সামনে পুলিশ পাহাড়া। আমি ভাবলাম ডিডিআর সরকার হয়ত তাদের সিকিউরিটির জন্যেই রেখেছে। কিন্তু ক্রমেই পরিস্কার হতে লাগলো আমি তাদের পূর্ণ নজরদারীতে। এম্ব্যাসীর সাথে যোগাযোগও তারা ভাল চোখে দেখে না। আমার বাড়ীতে যেসব গাড়ী আসে সেসবের নম্বর প্লেট তারা টুকে নেয়। দুই জার্মান একত্রীকরণের পরে পুরোনো স্টাসী রেকর্ডগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে আমার ফাইলে দেখে এসেছি - আমার বিরুদ্ধে সন্দেহ করা হচ্ছিল যে আমি গোয়েন্দাবৃত্তি করে বাংলাদেশে তথ্য পাচার করছি।"

বাংলাদেশে কখনও জাননি? জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন "পূর্ব জার্মান সময়ে সেটা তো সম্ভবই ছিল না। শেরু ইতালীর দুতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমাকে রোমে নিয়ে যাবার জন্যে ডিডিআর এর মন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ করে। কিন্তু ছাড়পত্র মেলেনি। আর এখন তো বুড়ো হয়ে গেছি, আমার স্ত্রীর প্লেনে চড়া মানা।"

এতসব বাধা-বিপত্তি সত্বেও বাঙ্গালীদের প্রতি তাদের স্নেহ কখনো কমেনি। তিনি বললেন এখনও মাঝে মধ্যে তিনি ফোনকল পান "হাই অন্কেল, হাউ আর ইউ। আর ইউ স্টিল ড্রাইভিং ইওর কার? দেন ইউ আর স্টিল ইয়ং।" আর তাদের স্মৃতি রোমন্থন করে বুড়োবুড়ির দিন কাটে।

আমি বললাম আপনার কাছে এত গল্প এগুলোতো প্রকাশ করা উচিৎ। লিখেই ফেলুন না একটি বই। উনি বললেন "হ্যা আগে তো সম্ভব ছিল না। এখন তা করাই যায়।" কিন্তু কথা আর এগুলো না, কারন সবারই যাওয়ার পালা।

আমি ভাবতে লাগলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই যে নানা গল্প রয়েছে সেগুলো হয়ত একসময় এমন মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। অন্কেল-টান্টের মত এইসব সুহৃদরা কি অনুল্লেখিতই থেকে যাবে?

তাদের নিয়ে কোন লেখা বা তাদের ডকুমেন্টারিটি নিয়ে কোন রিপোর্ট চোখে পড়েনি। কেউ যদি কখনও খুঁজে পান জানালে বাঁধিত হব।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Saturday, April 11, 2009

সেইসব বীরঙ্গণা এবং যুদ্ধশিশুর কথা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যেন এক মৃত্যুপুরী, শয়তানের লকলকে জিভে চাটা এক নড়ক। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ২ লাখেরও বেশী নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয়া হয়েছে।



সুজান ব্রাউন মিলার তার Against Our Will: Men, Women and Rape বইটিতে লিখেছেন যে ধর্ষণকৃত নারীদের সৌন্দর্য দেখে বাছা হত এমন নয়। আট বছর বয়সী মেয়েশিশু থেকে ৭৫ বছরের বুড়ী পর্যন্ত পাক বর্বর হায়েনা থেকে রেহাই পায়নি। কোন কোন নারীকে সারা রাত ধরে গণ ধর্ষণ করা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কন্টিজেন্টের চীফ জে. একে নিয়াজী দম্ভ নিয়ে বলেছিলেন "আপনারা কি ভাবে আশা করেন একজন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে যুদ্ধ করবে আর মারা যাবে এবং সেক্স করবে ঝিলমে গিয়ে?" (ইস্ট পাকিস্তান, দ্য এন্ড গেম - ব্রীগেডিয়ার এ আর সিদ্দিক )। এসব সেনাদের হাতে নারীদের তুলে দিত রাজাকার আলবদরেরা।

যুদ্ধ শেষ হবার পরে এই সব ধর্ষিতা নারী এবং তাদের গর্ভের অগণিত যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তাদের সম্মান দিয়ে বলেন তারা আমার মেয়ে। তাদের বীরঙ্গণা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। অনেকে সামাজিক গন্জনা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে।

এনবিসি নিউজ আর্কাইভে সেই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্ট আছে।


আমেরিকা থেকে ডাক্তাররা আসে গর্ভপাত করাতে।



এই রিপোর্টে বলা হয়েছে ১৫০০০০ থেকে ১৭০০০০ বীরঙ্গনাকে গর্ভপাত করানো হয়েছে সরকারী মাতৃসদনে ও সনাতনী দাই ইত্যাদি দ্বারা।

এর পরেও অনেক যুদ্ধশিশু জন্মেছে। মাদার তেরেসা ১৯৭২ সালে এসে বেশ কিছু শিশুকে দত্তকের মাধ্যমে কানাডা, ফ্রান্স, সুইডেন ইত্যাদি দেশে পাঠান। এর পেছনে সরকারী চাপও ছিল। বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছিলেন পাকিস্তানী হায়েনাদের রক্ত আছে এমন শিশুদের আমরা দেশে থাকতে দেব না।

১৯৭২ সালের ২৯শে মে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে:

Bangladesh government, at instigation of US social workers, is setting up a legal machinery for international adoption of child victims of occupation and war, including unwanted offspring of women raped by Pakistani soldiers;

কত শিশু বাইরে গেছে এভাবে তার হিসেব নেই। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের দিকে এই যুদ্ধশিশুর ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়।

মাসুদা ভাট্টি ইউরোপে অবস্থানরত এক বীরঙ্গণার কথা লিখেছেন। সেটি পড়ে অনেক মন খারাপ হয়ে রয়েছে তাই এখানে কিয়দংশ তুলে দিচ্ছি :

কথা শুরু হয়েছিল ২৫শে মার্চের রাত নিয়ে, ২৬ মার্চের সকালে চলে গেলেন আনা।ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে এলো ওরা। আমরা কয়েকজন, দু’একজন মুখ চেনা। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কোথায় এলাম বুঝিনি, ঢাকার শহরতো ভালো করে চিনি না। একটা মেয়েকে দেখলাম হাতে করে কোরআন শরীফ নিয়ে এসেছে।থর থর করে কাঁপছে। কাঁদছে অঝোরে, শব্দহীন। আসলে আমরা সবাই কাঁদছিলাম, অথচ কেউই শব্দ করে নয়, আমরা মনে হয় শব্দ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

তারপর যেখানে এলাম, সেখানে লাইন ধরে অনেকগুলো রুম।আমাদের একই রুমে রাখা হলো। তখন দুপুর হবে মনে হয়, তখন ওরা এলো, একের পর এক। কিছু বলার সুযোগ দেয়নি, একের পর এক, আমরা মাত্র ছয় কি সাতজন। আর ওরা সংখ্যায় কতো ছিল এখন আর মনে করতে পারি না, তবে চাইও না।

“জানেন, আমরা প্রতিদিন কোরআন পড়তাম। ওরা তাও মানতো না। ছুঁড়ে ফেলে দিতো। পরে শুনেছি যে, ওরা নাকি মসজিদে ঢুকেও মানুষ হত্যা করেছে। জানেন, আমার আর কোনও আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নেই। এরপর নিজেকে আমি ধর্ম থেকে সরিয়ে নিয়েছি”।

মাসুদা ভাট্টি লিখেছেন:

১৯৭১ সালে যেসব পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশে লুটতরাজ, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে তারা তো কেউই ধর্মে অবিশ্বাসী ছিল না, বরং তারা সকলেই ছিল ধর্মপ্রান মুসলিম। ১৯৭১ সালের নয়মাস ধরে চলা যুদ্ধে একটি মাস ছিল রমজান মাস। সেই মাসেও কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজ করেছে, কি করেনি? তখন কিন্তু ধর্ম তাদের এই অনাচার থেকে রুখতে পারেনি। তার মানে তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে, তারা যা করছে তা আসলে ইসলামকে রক্ষায়। সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে, ১৯৭১ আসলে আর কিছুই নয়, ধর্মের নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা আর নারী ধর্ষণের চূড়ান্ত উদাহরণ।

আনার মতো এরকম অনেক মেয়ে, একাত্তরে যাদেরকে পাকিস্তানীরা “গণিমতের মাল” হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে, স্বাধীন দেশে আমরা তাদেরকে নিয়ে বিব্রত বোধ করেছি। আমি নিশ্চিত ১৯৭১ যদি তখন না হয়ে এই ২০০৯ সালেও হতো আর একই ঘটনার শিকার হতো বাঙালি নারী, আমাদের মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আমরা দেখতে পেতাম না। আনার মতো বাংলার শেফালি, রত্না, চম্পা বা অন্য যে কাউকেই এরকম বিদেশে এসে নাম পরিবর্তন করতে হতো, নয়তো দেশেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হতো।

এইসব বীরদের এবং এই সব যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে কি আমাদের সচেতন হওয়া উচিৎ না?

আরও পড়ুন:
* একাত্তরে নারীরা
* বীরঙ্গণার গল্প
*বীরঙ্গণাদের কষ্ট
* তারা বীর, বীরঙ্গণা নয়

প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যার ইন

Friday, April 10, 2009

অর্ডনুঙ্গ - নিয়ম

বার্লিনের কাছে ওরানিয়েনবুর্গে সাক্সেনহাউজেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যে কয়েকবার গিয়েছি সে কয়বারই প্রশ্নটি মাথায় এসেছিল যে এত বড় হত্যাযজ্ঞ -হলোকস্ট সংঘটন তো সম্মিলিত কর্ম। যে লাশ বহন করেছে বা প্রহরী ছিল তারা কখনও বেঁকে বসেনি? মানুষ খুন করতে অস্বীকৃতি জানায় নি? আমরা কিন্তু কম উদাহরণের কথাই জানি যেখানে দেখা যায় যে ইহুদীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে কোন জার্মান নাগরিক। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই শিন্ডলার্স লিস্ট চলচ্চিত্র খ্যাত জার্মান ব্যবসায়ী অসকার শিন্ডলার যিনি বেশ কিছু ইহুদীকে তার কারখানায় কাজ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তিনিও বিতর্কের উর্ধে নন কারন নাজী পর্টির সদস্য হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে সস্তা শ্রম পাবার জন্যে তিনি ইহুদীদের ব্যবহার করতেন।

সাম্প্রতিকালের দ্য রিডার ছবিতে হানা স্মিৎজ (কেইট উইনস্লেট যার জন্যে অস্কার পেয়েছে) এর বিচার যখন হচ্ছিল তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে এস এস গার্ড হিসেবে তাদের কাছে ৩০০ জন বন্দী যখন বিমান থেকে ফেলা বোমার আগুণে পুড়ছিল তখন সে কেন দরজা খুলে দেয়নি। সে তখন বলেছিল যে "এরা আমার রেসপনসিবিলিটি ছিল তাই কি করে তাদের ছেড়ে দেই?"

ব্যাপারটি যতই বালখিল্য মনে হয় আসলে এটি কিন্তু জার্মান চারিত্রিক বৈশিষ্টের একটি অংশ। তারা নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে এতটাই নির্মম এবং সাধারণত: একচুলও নড়ে না।

নিকোলাস কুলিশ দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে জার্মান চরিত্রের এই অংশ তুলে ধরেছেন। উনি উদাহরন দিয়েছেন যে রাস্তা ঘাটে কত নিয়ম আছে এবং সেগুলো কঠোরভাবে পালন করা হয়। অথচ মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই বা ভিডিও ক্যামেরা নেই তা পর্যবেক্ষনের জন্যে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতাও তাই। দৈনন্দিন অনেক নিয়মকেই তাদেরকে চোখে চোখে রাখার দরকার হয় না। তারা নিজেরা তা মানে এবং অপরকে স্মরণ করিয়ে দেয় তা সঠিকভাবে পালনের জন্যে। এবং অনেকক্ষেত্রে এইটি খুব অনধিকার চর্চাও মনে হয়। এক অজপাড়াগায়ে একটি খালি পার্কিং লটে গাড়ী রেখে ম্যাপ দেখছি তখন এক বুড়ো এসে বলল এটি ইনভ্যালিড পার্কিং এখানে রাখতে পারবে না তুমি। আমি বললাম পাশে আরও যায়গা আছে ইনভ্যালিডদের জন্যে কাজেই আমি কারও সমস্যা করছি না, আমি একটু পরেই চলে যাব। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা - বলল এখানে রাখা নিষিদ্ধ তোমাকে সরাতেই হবে। নিয়মের বাইরে কোন কিছু সে মানতে রাজী নয়। এভাবেই তারা ছোটকাল থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। আমি আমল না দিয়ে ম্যাপের দিকে মনযোগ দেয়ায় বুড়ো গজগজ করতে বাড়ীর দিকে গেল। আমি অবশ্য কিছু পরেই সরে গেলাম কারন না হলে সে হয়ত পুলিশ ডাকত।

নিয়মের প্রতি বাধা থাকা এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারনে এজন্যেই জার্মানদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বেশ রবোটিক মনে হয়। এবং কারো সাথে ভালভাবে না মিশলে ভেতরের মানবিক দিকগুলো জানা যায় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তাদের নির্লিপ্ততার কারন কি নিয়ম মানার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছিল কি না সেটা বিতর্কের বিষয়। জার্মানিতে নুরেমবুর্গ আইন (১৯৩৫) করে ইহুদীদের সমাজচ্যুত করা হয় এবং ইহুদীদের বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়। ইহুদীদের নিধনের ফাইনাল সল্যুশনও লিখিতভাবে প্রণীত হয়েছিল। কাজেই অনেকের যুক্তি হতে পারে যে সাধারণ লোক নির্দেশ মেনেছে শুধু।

জার্মানদের নিয়্ম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে মানুষের ভালোর জন্যেই তা তৈরি। তবে নিয়ম মানতে গিয়ে মানুষের ক্ষতি করা কি উচিৎ কিনা এবং এ নিয়ে তারা ভাবে কি না জানার আগ্রহ আছে।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

Monday, April 06, 2009

সুনিতা পালের সুলুক সন্ধানে

বর্তমান বাংলাদেশে, বিশেষ করে ট্যাবলয়েড পত্রিকার জগৎে সেনসেশনাল নাম হচ্ছে তথাকথিত সাংবাদিক সুনিতা পাল। উনি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার একের পর এক জ্বালাময়ী লেখায় মতামতের ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি সাংবাদিকরাও বলছেন যে কোন সূত্র না উল্লেখ করেই যে উনি যেসব মনগড়া কথা লিখছেন তা কোনমতেই সাংবাদিকতার আওতায় পড়ে না।

সুপ্রিয় পাঠক, এখন আমরা জানার চেষ্টা করব আসলে তিনি কে? অ্যামেরিকান ক্রনিকল নামক অনলাইন ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত লিখে থাকেন। সেই ওয়েবসাইটে দেয়া তার প্রোফাইল অনুযায়ী ১৯৫২ সালে ভারতের কোচিনে তার জন্ম।

কিন্তু একটি যায়গায় এসেই খটকা লাগে:



"Born as a deaf and dumb, Sunita Paul decided to use pen in expressing herself. "


কেমন যেন উপন্যাসের মত শোনায় না? আমাদের উপমহাদেশে একজন নারী বোবা কালা হয়ে জন্মালেন আর কলমের সাথে তার মত প্রকাশে ব্রতী হলেন। তিনি প্রতিবন্ধী হয়ে সমস্ত পলিটিকাল সায়েন্স আর সাংবাদিকতায় তার দুটি মাস্টার্স ডিগ্রি করেছেন আর দু:খের বিষয় হচ্ছে এই বিরল কৃতিত্বের সংবাদটি আমরা কোথাও খুঁজে পাইনা। তার লেখা বিশটিরও অধিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে, অথচ তার নিজের সম্বন্ধে একটিও লেখা নেই।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ২০০৫/২০০৬ এর আগে সুনিতা পালের খবর কেউ শোনেনি।

আব্দুল বাতেন লিখেছেন:



"তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় বিশেষজ্ঞ বলা যায়। বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন অনেক। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ বিষয়ে এহেন একজন বিশেষজ্ঞের কথা কেন আমরা এতদিন জানতাম না। হোন তিনি বাংলাদেশ বিরোধী একজন লেখক কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ নিয়ে এত ধারণা যার তার বিষয়ে কিছু খোঁজখবর তো আমাদের কাছে থাকার কথা ছিল। "

বাংলাদেশ বিষয়ে এমন জানাশোনা যে ব্যক্তির বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তার কিছু না কিছু যোগাযোগ তো থাকতেই হয়। স্বাভাবিক এই প্রশ্ন থেকেই আবার অনুসন্ধান চলে। যোগাযোগের সূত্রটি কিছুটা বের হয়ে আসে। বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম উইকলি ব্লিটজ।http://www.weeklyblitz.net/ ব্লিটজ পত্রিকাটির সম্পাদক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী।

সুনীতা পাল এই শোয়েব চৌধুরীরর পত্রিকার নিয়মিত লেখেন। আরও মজার বিষয় শোয়েব চৌধুরীকে নিয়ে তিনি একাধিক লেখা লিখেছেন। আরও মজার বিষয় হলো, সুনীতা পাল যেসব পত্রিকায় লেখেন যেমন আমেরিকান ক্রনিকল বা গ্লোবাল পলিটিশিয়ান সেসব পত্রিকার নিয়মিত লেখকদের মধ্যে সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী অন্যতম। সুনীতা পাল ও সালউদ্দিন শোয়েব চৌধুরীর লেখার বিষয়, আগ্রহ প্রায় একই। সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী যেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে নরম, সেখানেই সুনীতা পাল কঠোর। সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী ও সুনীতা পাল দুজনেই চান বাংলাদেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিক এবং দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করুক।


সুনিতা পাল এও বলেছেন যে সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরীর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিৎ

এখন দেখা যাক সালাহউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী লোকটি কে।

তার বায়োডাটায় দেখা যায় ১৯৯৫-১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি এ-২১ টিভি চ্যানেলের এমডি ছিলেন। সেই টিভিটি ছিল বর্তমানে পলাতক মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। তিনি ইনকিলাব পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন ২০০১-২০০২ সালে। তিনি শাহরিয়ার কবিরকে মোসাদ এজেন্ট বলে গালিগালাজ করেন তখন। তার তখনকার আর্টিকেল গুলো পরলেই তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বোঝা যায়। উনি তারপর ইনকিলাব টেলিভিশনের শেয়ার কিনে তার ডাইরেক্টর হন। কিন্তু তার পর টাকা পয়সা নিয়ে অন্যান্য ডাইরেক্টর, যারা তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন, তাদের সাথে গোলমাল লাগে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ও গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়।

এর পর ২০০৩ সালের নভেম্বরে তাকে বিমান বন্দরে গ্রেফতার করা হয় ইজরায়েলে যাওয়ার প্রাক্কালে । তার কাছে কাগজপত্র ছিল যে তিনি ওখানে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। আপনার যদি বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকে তাহলে দেখবেন যে সীল মারা আছে যে একটি দেশে শুধু আপনি যেতে পারবেন না তা হলো ইজরায়েল। অর্থাৎ তাকে ওই ক্লজে গ্রেফতার করা হয়। যদিও আগেই প্রভাবশালী একটি মহল উপরোক্ত কারনে তার উপর ক্ষেপে ছিল। তাকে এরপর জরুরী ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখানো হয় ও রাষ্টদ্রোহীতার মামলা করা হয়।

এরপর আন্তর্জাতিক এক চক্র তার মু্ক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় যার অগ্রভাগে ছিলেন ড: রিচার্ড বেনকিন । এই আমেরিকান ইহুদী লবিইস্ট শোয়েবের মুক্তির ই্স্যুতে বিভিন্ন খানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেখা শুরু করেন। মজার ব্যাপার হলো ২০০৬ সালে তাকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার লবিইস্ট হিসেবে নিয়োগ দান করে

সালাউদ্দিন শোয়েব বর্তমানে বিচারাধীন তবে মুক্ত। তার বিচারের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশী সংবাদপত্রগুলো মৌণ থাকলেও ইজরায়েলী সংবাদপত্রগুলোকে সরব দেখা যায়।

সাজ্জাদ জহির যুক্তি দেখিয়েছেন যে সুনিতা পাল সালাউদ্দিন শোয়েবেরই ছদ্মনাম । আবার অন্যেরা বলেন যে তিনি বেনকিনেরই একটি সৃষ্টি এবং সুনীল নামের এক ভারতীয় নিউইয়র্ক থেকে এই ছদ্মনামে লিখে যাচ্ছেন।

এখন আমরা আবার আসি সুনিতা পালের লেখা প্রসঙ্গে। তিনি তার লেখায় যুক্তি ছাড়াই অনেক মতামত (কোন উৎস উল্লেখপূর্বক) দিয়ে থাকেন যা সবাইকে বিস্মিত করে। একজন বোবা কালা মহিলা কিভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে এত তথ্য পাচ্ছেন দেশের বাইরে থেকে এবং নিয়মিত (প্রায় প্রতিদিন) তা নিয়ে লিখেছেন সেটি বিস্ময়ের ব্যাপার। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশী আমেরিকান ব্লগার ম্যাশ প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন যে সুনিতা পাল তার ব্লগের লেখা থেকে কিছু অংশ বেমালুম মেরে তার আর্টিকেলে তুলে দিয়েছেন ম্যাশের কোন উল্লেখ ছাড়া। এরকম কত যায়গা থেকে তার চৌর্যবৃত্তি চলেছে তা এখন গবেষণার বিষয়। ম্যাশ জানিয়েছেন যে এই নকল লেখা প্রায় ডজনখানেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

সুনিতা পাল আরাফাত রহমানের অসুস্থাবস্থা নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছেন, তারেক রহমান ও তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন সম্পর্কে অনেক মন গড়া কথা বলেছেন, জেনারেল মইনকে ছেড়ে কথা বলেননি এবং হাসিনা পূত্র জয়ের বিরুদ্ধে কোনরুপ প্রমাণ না দেখিয়ে মনগড়া সব অভিযোগ করে যাচ্ছেন

তার লেখায় রয়েছে সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়া যাতে তারা সাম্প্রতিক সরকারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করা ও কাল্পনিক সব গল্প বানানো তার বৈশিষ্ট।

সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই (২৯ ডিসেম্বর ২০০৮) তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পেছনে লাগেন এবং এখনও তার সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

একটি বিষয় নিশ্চিত যে তার সব কর্মকান্ড প্রমাণ করে যে সে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা ও শান্তির বিপক্ষে।

একজন বোবা কালা মহিলার পক্ষে এতটুকু করা মনে হয়না সম্ভব। কাজেই তিনি সত্যিকারের হলেও তার নাম ভাঙ্গিয়ে একটি মহল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে আর তাকে তুলে ধরছে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ট্যাবলয়েড পত্রিকা। সাধু সাবধান।
 প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যার ইন