Saturday, November 05, 2011

জাগো বাংলাদেশ নিয়ে যত কথা

গতকাল অফিসে যাবার সময়ে শেরাটন হোটেলের সামনের মোড়ে দেখলাম হলুদ টিশার্ট পরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে বিভিন্ন গাড়ির কাছে এসে কিছু জিজ্ঞেস করছে। গাড়ি সিগন্যালে থামতেই ১৪-১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী এগিয়ে এল। স্যার বলে সম্ভাষণ করে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা শুরু করতেই গাড়ি আবার নড়ল। দ্রুত পকেটে হাত দিয়ে কিছু টাকা হস্তান্তর করতেই Primary Education For All লেখা একটি স্টিকার পেলাম। অন্য গাড়িতে দেখলাম ফুল দেয়া হচ্ছে।

এরপর অফিস যেতে যেতে ভাবছিলাম যে ওইখানে প্রায়ই পথশিশুরা ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকে অথচ তাদের কাছ থেকে কালে ভদ্রে কিছু কেনা হয় না। তাহলে আমি ঐ হলুদ পোশাক পড়া কিশোরীকে কেন সাহায্য করলাম?
(ছবি: গতকাল সিলেটে ড: জাফর ইকবাল ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের হলুদ টি শার্ট পরা। সৌজন্যে জাগো বাংলাদেশ ও টিটিএল)

বিভিন্ন ব্লগে এই নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে যার বেশীরভাগেই দেখলাম তথ্যের অভাবে গালগল্প, ব্র্যান্ডিং ও কাঁদা-ছোড়াছুড়ি চলছে। এইসব কিশোর-কিশোরী বা তাদের কে পাঠিয়েছে তা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? কালকের এই আয়োজনটি কিন্তু রীতিমত পাবলিক ক্যাম্পেইন করা একটি কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতার উদ্যোগ। ডেইলি স্টারে এসেছে যে জাগো বাংলাদেশ নামক এনজিওর ভলান্টিয়ার্স ফর বাংলাদেশ শাখার প্রায় ৭০০০ স্বেচ্ছাসেবক যারা বিভিন্ন ইংরেজী ও বাংলা মাধ্যমের স্কুল এবং কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তারা দেশের দশটি শহরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাড়িয়ে জাতিসংঘের উৎসাহে প্রবর্তিত ইউনিভার্সাল চিলড্রেনস ডে সম্পর্কে জানাবে এবং পথশিশুদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করবে ৩রা নভেম্বর ২০১১ তারিখে। একই দিনে তারা ১৮০০ পথশিশুকে বিভিন্ন খেলার যায়গায় নিয়ে যাবে, তাদের খাবার এবং চিকিৎসা দেবে। এর মূল স্পন্সর আমেরিকান দুতাবাস এবং সহায়তা করেছে এয়ারটেল, পিজ্জা হাট, কেএফসি, ফারইস্ট লি: ওয়ান্ডারল্যান্ড, টিটিএল এবং অন্যান্য সংস্থা। অনেক প্রতিথযশা যেমন জাফর ইকবাল স্যারও তাদের উৎসাহিত করেছেন ( এবং তার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেবার ধৃষ্টতা পেয়েছে ছাগুরা)। জাগো বাংলাদেশ ২০০৭ সাল থেকেই ইউনিভার্সাল চিলড্রেনস ডে পালন করে আসছে।

 সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ২৫ বছর বয়সী বাংলাদেশী যুব্ক করভি রক্ষান্দ ধ্রুবের গল্প স্বপ্নের মতন, অন্তত দেশে বিদেশে সেভাবেই প্রচারিত। বিলেত থেকে ২১ বছর বয়সে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরে ধ্রুব। কথা ছিল পারিবারিক ব্যবসা সামলাবে সে, কিন্তু মাথায় ভুত চাপল পথশিশুদের জন্যে স্কুল করবে সে। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে রায়ের বাজারে বন্ধুদের সাহায্যে একটি রুম ভাড়া নেয় জাগো এবং একটি ছোট ইংরেজী স্কুল খোলে যেখানে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের এডএক্সেল কারিকুলামে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি মেলে খাবার ও চিকিৎসা। বাড়ি যাবার সময় আবার আধা কেজি চালও পায়। ধ্রুব করিৎকর্মা ছেলে, তার যোগাযোগ, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে দেশী-বিদেশী সাহায্য যোগাড় করে স্কুলটি এগিয়ে নেয়। এর জন্যে আকর্ষনীয় প্রেজেন্টেশন, ভিডিও ও নানা ক্যাম্পেইনের উদ্যোগ নেয়।

বর্তমানে এই বিল্ডিং এর দুই তলা জুড়ে ৩৬০ জন করে দুই শিফটে ৭২০ জন পথশিশু শিক্ষা নেয়। তাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য কয়েকটি শহরে আরও গুটি কয়েক ছোট স্কুল আছে। ইতিমধ্যে দেশী ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে ধ্রুব। এছাড়াও দ্যা ঢাকা প্রজেক্ট নামে আরেকটি স্কুল আছে যেখানে বিশেষ ভাবে এমিরেটস এর বিমানবালাদের অর্থায়নে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমে পড়ানো হয়।

দুবছর আগে বাড়ি থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়, বেছে নাও - পারিবারিক ব্যবসা না তোমার খামখেয়ালি। ধ্রুব বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলের একটি রুমে আশ্রয় নিয়ে বলে দিনের অধিকাংশ সময়তো এখানেই থাকি, নাহয় আরেকটু থাকলাম। জাগো বাংলাদেশে আরও বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে জড়িত - তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী

ইউনিভার্সাল চিলড্রেনস ডের ২০১০ সালের অনুষ্ঠানে প্রায় ২০০০ স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেয়। এইসব স্বেচ্ছসেবকদের আনুষ্ঠানিক কাঠামো দিতে অঙ্গসংস্থা ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ গঠিত হয় কাকরাইলে এবছর আমেরিকান দুতাবাসের সহযোগীতায়। উদ্দেশ্য আগামী ২ বছরের মধ্যে ২১টি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করা। তাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য ৬৪টি জেলায় স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করা। তাদের কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামাজিক মিডিয়ার ব্যবহার - আপনি যোগ দিতে চান? ফেসবুক লগিন ব্যবহার করে যোগ দিতে পারেন। ফেসবুকে তাদের স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৬০০০ এর উপরে। এবারের ইউনিভার্সাল চিলড্রেনস ডে উপলক্ষ্যে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ বেশ কটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করে দেশজুড়ে -চট্টগ্রাম, ঢাকার আইএসডি, সেইন্ট যোসেফ ইত্যাদি নামকরা স্কুল ছাড়াও ওয়ান্ডারল্যান্ডে ছিল এইসব আয়োজন। নয়নকাড়া ভিডিও এবং ছবি ফেইসবুক ও ইউটিউবে শেয়ার করা হয়েছে এবং আরও ছাত্রছাত্রী উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আমি কেন সেই কিশোরীকে সাহায্য করলাম সেটি এখন খোলাসা হল। এটি ছিল পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ইভেন্ট এবং এতে একটি স্টানিং ইফেক্ট ছিল। এতজনের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের পেছনে সামাজিক মিডিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। টুইটারের মাধ্যমে জানা যায় যে ঢাকার উত্তরাংশে পুলিশ গতকাল তাদের কার্যক্রমে বাধা দেয় এবং ধ্রুব গুলশান থানায় গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

আজকে অরিত্রের লেখায় জাগো বাংলাদেশের পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা এসেছে। অনেকে স্বেচ্ছাসেবকদের পোষাক নিয়ে আপত্তি করেছেন (সাবিহ ওমর ভালো জবাব দিয়েছেন তাদের)। অনেকে কত টাকা উঠেছে তার হিসেব চা্চ্ছেন। অনেক স্বেচ্ছাসেবককে টিশার্ট পরিহিত অবস্থায় শিশা বারে দেখা গেছে সেসব ছবি এসেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সবই কিন্তু বিভিন্ন ব্লগে আসার সাথে সাথে তাদের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট হয়ে যাচ্ছে এবং জবাব চাচ্ছে অনেকে। আগ্রহীরা চাইলে ধ্রুব, জাগো ফাউন্ডেশন এবং ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ ফেসবুক পেইজে এইসব নিয়ে আলোচনা দেখতে পারেন। সামাজিক মিডিয়ার সুবিধাটা এইখানে - পত্রিকার মত একপেশে রিপোর্ট না। জবাবদিহীতার আশা করা যায়।

এইসব স্বেচ্ছাসেবক দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের অন্তর্গত - কাজেই গুটিকয়েকের ব্যক্তিগত দুর্নীতিকে জেনেরালাইজ করা হয়ত ঠিক হবে না। ২০১০ সালে ৬ ঘন্টায় তোলা হয়েছিল ২৪ লাখ টাকা, এবার শোনা যাচ্ছে ৩৮ লাখ টাকার কথা - জাগো বাংলাদেশ তাদের আয় ব্যয়ের রিপোর্ট প্রদানে স্বচ্ছ হবেন এ আশা রইল - না হলে সবাই যা বোঝার বুঝে যাবেন।

ধ্রুবর ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে একটি অংশ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না:
One parent of a volunteer complained: I can't find a parking lot at JAAGO School in Karail. Can you please find me a parking lot and please do make a school with parking lot next time?

Korvi Rakshand answered: The kids who comes to the JAAGO School don't have cars. Actually, they don't have 3 meals a day. Right now, JAAGO is trying to arrange education and food for them. Once they study, become rich and can buy cars, we will definitely relocate the school which will have a parking lot and most probably a Helipad also.
এই প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়ে বোঝা যায় যে জাগোকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়েছে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এতজন স্বেচ্ছাসেবকদের একত্রিত করতে। তবে তাদের জন্যেই দামী স্কুলের এইসব উচ্চবিত্ত ঘরের স্বেচ্ছাসেবকরা যাদের অনেকে আদর করে ফার্মের মুরগি বলে ডাকে তারা এই প্রথমবার অ্যাক্টিভিজমের স্বাদ পাচ্ছে। আমেরিকান দুতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠান বলে হয়ত তাদের পিতামাতা তাদের রাস্তায় ছেড়েছে। তারা ভবিষ্যৎে দেশের সংকটময় মুহূর্তগুলোতে এইভাবে নেমে আসবে কিনা এবং কর্পোরেট বেনিয়া গন্ধ ছাড়া উদ্যোগগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ কেমন সেটা দেখার আকাঙ্খা রইল। তারাও দেশেরই অংশ এবং আমরা শ্রেণীভেদ করে তাদের যেন দুরে না ঠেলি। স্বেচ্ছাসেবকতা করা তাদেরও অধিকার এবং দেখা যাক তেল গ্যাস রক্ষার মত বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এর মত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে তাদের ভূমিকা কেমন থাকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য গতকালের আয়োজনে আলোকচিত্রে স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে সহায়তা করেছে থ্রু দ্যা লেন্স (টিটিএল) নামক অ্যামেচার ফটোগ্রাফারদের সংগঠন (আমার কয়েক বন্ধুও আছে সেখানে)। জাতীয় অন্যান্য অ্যাক্টিভিজমে তাদের সচরাচর দেখা যায় না। ভবিষ্যৎে কি তাদের পাওয়া যাবে?

জাগো বাংলাদেশ আর ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও আমেরিকান সরকারের ভূমিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। ৬৪টি জেলায় স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক হলে তাদের কি লাভ? বিষয়টা এতটা জটিল যে বলতে হয় খুব খেয়াল কৈরা।

Saturday, October 15, 2011

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়িরা কি দূরে সরে যাচ্ছে?



ছুটি এলেই মনটা পালাই পালাই করে কিন্তু আলস্যের কারনে কোথাও যাওয়া হয়না। এবার পুজোর ছুটিতে আড়মোড়া ভেঙ্গে সপরিবারে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি বেরিয়ে এলাম। আমার জন্যে ব্যাপারটি ছিল উত্তেজনাকর, কারন হিল্লি দিল্লি করার সুযোগ হলেও দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া দেশের ভেতরের এই সবুজ ও নীলের পাহাড়-হ্রদের মেলা।

এ অঞ্চলের সৌন্দর্য নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই (ছবি দ্রষ্টব্য:  রাঙ্গামাটি , খাগড়াছড়ি, বান্দরবান )। আমাদের সফরসঙ্গী পরিবারের কর্তাটি বললেন দেখুন এইরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে মানুষ অনেক পয়সা খরচ করে বিদেশে যায়। তবে বাস্তব হচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিনে দিনে তার রুপ হারাচ্ছে। পর্যটন ও বসতি বাড়ার সাথে পাহাড় কেটে বানানো হচ্ছে বাড়িঘর, হোটেল-রিসোর্ট। বাশ ও সেগুন গাছের গুড়ি ভর্তি সারি সারি ট্রাক তো নিজ চোখেই দেখলাম রাস্তায়। পাহাড় থেকে খাদ্যাভাবে জনপদে নেমে আসে হাতির পাল এমন শুনেছি, কাপ্তাই লেকে আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। হায় কে কার খবর রাখে।

সত্যিই এগুলো খবর হয় না। খবর হয় না যখন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাহাড়ি-বাঙ্গালী নির্বিশেষে চাঁদা তোলে বা অপহরণ করে, পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয়ের উপর হামলা করে। খবর হয়না যখন পাহাড়িদের জীবন, বসতি নিয়ে রাজনীতি করে জ্ঞানপাপী মানুষ আর তাদের এতটুকু মাথা গোঁজার ঠাই কেড়ে নেয়। খবর হয় না যখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী (বিশেষ করে পুলিশ) টাকার জন্যে নিপীড়িতের পাশে না এসে নির্যাতনকারীর পাশে এসে দাড়ায়। খবর হয় না যখন কল্পনা চাকমারা হারিয়ে যায়। খবর হয়না যখন খাগড়াছড়ির ১৯২টি কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের শতভাগ টাকা মেরে দেয় রাজনৈতিক নেতারা যার মধ্যে অধিকাংশই পাহাড়ি। নিজেদের রক্ত নিজেরাই খেয়ে কুমীর বনে যায় (উদাহরণ: ইউনিপের নামে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে উদ্দীপন চাকমা )।

খবর হয় যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষ রুখে দাড়ায় এবং নিজের হাতে আইন তুলে নেয়। খবর হয় যখন শান্তিরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী দুপক্ষের মধ্যে এসে দাড়ায় এবং লোক মারা যায়। খবর হয় যখন পাহাড়ি দুইপক্ষ নিজেদের রক্তে গা ভাসায় আর নিরীহ জনগনকে ত্রাসের রাজ্যে রাখে। খবর হয় যখন আদিবাসী নামকরণ নিয়ে সরকারের মনোভাব প্রতিষ্ঠায় অদ্ভুত সব যুক্তি দেখানো হয়।

এসবের মাঝে একটি জিনিষ আমরা ভুলে যাচ্ছি - তিন পার্বত্য জেলার ১৪টি উপজাতির মনে কি খেলা করছে। এই মূহুর্তে তারা আর বাঙ্গালী দের বিশ্বাস করছে না, এই মূহুর্তে তারা নিজেদের দেশের ভেতরে অবাঞ্ছিত ভাবছে। সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ডাকা বিক্ষোভে দুর্গম অঞ্চল থেকে চার ঘন্টা হেটে বর্ষীয়ান পাহাড়ি যোগ দিয়েছেন। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এরপর হয়ত শান্তিচুক্তি রদ হয়ে আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হবে। কিন্তু এমন তো কথা ছিল না।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন এবং মানবেন্দ্র লারমা স্বায়ত্তশাসন সহ বিভিন্ন উপজাতির দাবী তুলে ধরলে তিনি বলেন "তোরা সব বাঙ্গালী হইয়া যা"। ১৯৭৩ সালে সংসদের কাছে তার আহ্বানেও সাড়া দেওয়া হয় না। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালে এম এন লারমা জনসংহতি সমিতির একটি সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করেন, যা পরে শান্তিবাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে এবং পরে তারা অত্র অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ১৯৮১ সালে শান্তিবাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং ১৯৮৩ সালে বিপক্ষ দলের হাতে মানবেন্দ্র মারা যান। তবে তার অনুজ সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধ অব্যহত রাখে। জিয়া এবং এরশাদ সরকারের আমলে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী এবং আশির দশকে উপজাতিদের উপর নির্লজ্জ্ব হত্যাকান্ড চালানো হয়। কোন সরকারের আমলেই এইসব হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। এছাড়া গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্থা করা, যৌন নিপীড়ন প্রভৃতি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে নিয়মিতই। সাথে সাথে শান্তিবাহিনীরও অনুরূপ মানবাধিকার লংঘনের মূল্য দিতে হয়েছে পাহাড়ি-বাঙ্গালি উভয়কেই।

এরশাদের আমলে ১৯৮২-৮৩ সালে ২৬ হাজারের ও বেশী ছিন্নমূল ও ভাঙ্গনের ফলে উদ্বাস্তু পরিবারকে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসনের জন্যে নিয়ে আসা হয়। তাদের মধ্যে  প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের স্থান হয় খাগড়াছড়িতে।  আশির দশকের শেষের দিকে তাদের উপর ‘শান্তিবাহিনী’র হামলার ঘটনা বাড়তে থাকলে সেখান থেকে লোকজনকে সেনাক্যাম্প সংলগ্ন ৮১টি গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সম্পাদিত আওয়ামী লীগের শান্তিচুক্তি নিশ্চয়ই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এ অবস্থায় আনতে কি পরিমান রাজনৈতিক গণসংযোগ করতে হয়েছে তা অনুমেয়। শান্তিচুক্তির পর তিন পর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে অর্ধেকের কম সেনাক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে। বর্তমানে যা হচ্ছে তাতে উল্টোস্রোত দেখা যাচ্ছে আর সরকারেরও মাথা ব্যাথা নেই।

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তবে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে একটি দল চুক্তি মানতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে ১৯৯৮ সালে গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এই বিভাজন অবশ্য জেএসএসকে দমাতে পারেনি এবং তারা দাপটেই কার্যক্রম চালিয়েছে খাগড়াছড়ি অঞ্চল ছাড়া যেখানে বেশীরভাগ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউপিডিএফ এর। কিন্তু ২০০৬ সালের জরুরী সরকারের সময় সন্তু লারমার একক নেতৃত্ব থেকে দল বাঁচাতে সংস্কারের দাবীতে জনসংহতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বেশ কিছু প্রতিবাদী নেতারা। এদের মধ্যে আছেন সন্তু লারমার ঘনিষ্ট সহকর্মী রূপায়ন দেওয়ান, তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে, সুধাসিন্ধু খীসা, চন্দ্রশেখর চাকমা,শক্তিমান চাকমা প্রমূখ এবং তারা দলের নাম দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা)। এই বিভাজনে লাভ হয় ইউপিডিএফ এর যার নমুনা দেখা যাচ্ছে এবারকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে - অনেক অঞ্চলে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে।

বর্তমানে গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে। বিএনপি বরাবরই সেটেলার ভোটব্যাংক ভিত্তিক একটি দল, কাজেই ভবিষ্যতে তাদের ভোট পাবার চান্স কম। ভাড়াটে পাহাড়ী নেতা দিয়ে তারা এতদিন পার পেলেও যেহেতু তারা শান্তিচুক্তি ও সেনা প্রত্যাহারের বিরোধীতা (আওয়ামী লীগ একটি ব্রিগেড এবং ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করে ২০০৯ সালে এবং এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে পিটিশন করে তারা) করেছে সব সময়, তাদের আর গ্রহণযোগ্যতা নেই।

আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা এখন বিশ্বাস ঘাতকের পর্যায়ে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমনি আদিবাসী দিবসে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করেন। আর সেই তিনিই এবছর থেকে তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের আদিবাসী সম্বোধন করতে বারণ করেছেন এবং বলেছেন বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই; বিভিন্ন উপজাতি আছে। তার এই অবস্থান পরিবর্তন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ফলশ্রুতিতে হয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। আদিবাসী নিয়ে দেশী-বিদেশী যে বৃহত্তর রাজনীতি চলছে তা সামাল দিতেই যদি সরকারের এই পদক্ষেপ হয় তাহলে বলতে হয় এই পদক্ষেপটি চতুরতার সাথে নেয়া হয়নি। এই একটি ইস্যুকে পুজি করে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অনেককে তাদের চেতনায় সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। পার্বত্য অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা সম্পর্কে নতুন করে বলার নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সকল নেতারাই ঠিকাদারিতে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আগে উন্নয়ন কার্যক্রমের ৭০ ভাগ লোক পেত এখন পুরোটাই যায় তাদের পেটে। পাহাড়িরা তাদের কেন বিশ্বাস করবে?

পার্বত্য উপজেলাগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার হার ভাল। সরকারী স্কুল ছাড়াও ব্র্যাক ও অন্যান্য বেসরকারী স্কুল রয়েছে। আমি প্রচুর ছেলেমেয়েকে দেখেছি স্কুল ড্রেস পড়ে রাস্তায় হাটতে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার হার কম - হাতে গোনা গুটিকয়েক কলেজ এবং কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এই অঞ্চলে নেই কোন বিশ্ববিদ্যালয় - প্রধানমন্ত্রী হাসিনা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দিলেও পাহাড়িদের একপক্ষ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে সেটি এখনও পরিকল্পনা পর্যায়েই আছে। পাহাড়িদের উচ্চশিক্ষার জন্যে তাই বাইরে যেতে হয়। আর উচ্চ শিক্ষিতদের চাকুরির উপায় কি? নেই কোন কলকারখানা, উল্লেখযোগ্য বেসরকারী বাণিজ্য। তাই একমাত্র কাজ মিলে এনজিও বা সাহায্য সংস্থার অফিসে।

এরপর রয়েছে সাহায্য সংস্থা/এনজিওর দৌরাত্ম্য। এই সব সংস্থায় উচ্চশিক্ষিত ইউপিডিএফ এর কর্মীরা অনায়াসে কাজ পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইএনডিপির ২০১৩ পর্যন্ত প্রকল্প রয়েছে হাজার কোটি টাকার। তাদের স্বাস্থ্য কর্মসূচি গুলো খুবই উপযোগী (এবং অকার্যকর সরকারী স্বাস্থ্য সেবার বিকল্প) কিন্তু উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন কমিউনিটিকে তারা ৪ লাখ করে অনুদান দিচ্ছে যা রিপোর্ট মোতাবেক ইউপিডিএফ এর কর্মীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে ইউপিডিএফ সকল মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে ফলে কিছু পাহাড়ি কাজ কর্ম বাদ দিয়ে দানে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লাগানো যাচ্ছে। 

অনেক এনজিওদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। মানবাধিকারের ইস্যুকে পুঁজি করে সব দোষ সরকারের ঘাড়ে, শান্তিচুক্তির উপর অথবা সুযোগ বুঝে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে চাপিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? পাহাড়ের সমস্যার শতভাগ বহিরাগত বা সেনাদের দ্বারা উদ্ভুত নয় আর পাহাড়ের রাজনীতিতেও বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সমীকরণটা ভিন্ন- দুর্নীতিতে পাহাড়ি নেতারাও পিছিয়ে নেই আর ইউপিডিএফ-জেএসএস এর সংঘাত অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। যেখানে ভূমি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শিক্ষার দিক থেকে বহিরাগতরা পিছিয়ে, সেখানে কিছুসংখ্যক ভূমি সন্ত্রাসীদের জন্যে এসব দরিদ্র মানুষকে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। এটি হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি যা খেলছে সব পক্ষই।

এদেশ পাহাড়ি-বাঙ্গালি সবার। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ নয় - একে গড়ে তুলতে হবে পাহাড়ি-বাঙ্গালি মিলেই। পাহাড়ি-বাঙ্গালি বা জাতি-উপজাতি কেন্দ্রিক বৈষম্য থাকা চলবে না। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে, উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ইত্যাদি চালিয়ে যেতে হবে। পাহাড়িদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি শ্রদ্ধা শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে।  অথচ সেটা করার জন্যে একসাথে কাজ করার পূর্বশর্ত - পরস্পর বিশ্বাসটুকু হারিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক পরিস্থিতি। পাহাড়িরা শান্তি চুক্তিতে একটি ভুয়া প্রতিশ্রুতি ভাবছে। প্রতিনিয়তই নানা গুজব মানুষকে বিচলিত ও আতঙ্কিত করে। স্থানীয় সূত্রমতে আগামী যে কোন নির্বাচনে এলাকায় একচ্ছত্রভাবে পাহাড়িদের জয় হবে, ইতোমধ্যেই যার আলামত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পাওয়া গিয়েছে। এখানে পুরো ১৯৭১ এর ফর্মুলার সাথে মিল পাওয়া যাচ্ছে। বহিরাগতদের অত্যাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের লড়াই, আর নিজভূমে মেজরিটি (যেমন ১৯৭০ এর নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানী কোন দল জিততে পারেনি এ বঙ্গে) এই স্ক্রিপ্টটি মিলে যাচ্ছে। এর সমাধান বা তাদের আপন করার কোন পরিকল্পনা নেই সরকারের বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। তারা আদিবাসী নামকরণ ইস্যুতে তাদের দুরে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের ধারনা সেনাবাহিনীর বুলেটের নীচেই সব ঠিক থাকবে - এভাবে সেনাবাহিনীকেও সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর পরিণতি কি হবে তা আমরা জানি।

ফলে পাহাড়িরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে আমাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই দূরত্ব ঘুচাতে এবং পাহাড়িদের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা সাধারণ মানুষেরা কি করতে পারি?

সচলায়তনে প্রকাশিত

Wednesday, June 22, 2011

গুগল অনুবাদ, হাস্যকর নয় মোটেই

বিশ্বের ৬০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ২৭.৩% হচ্ছে ইংরেজী ভাষী (সূত্র) আর ২২.৬% হচ্ছে চৈনিক ভাষী। অন্যান্য ভাষাভাষীরা অনেক পিছিয়ে (স্প্যানিশ ৭.৮%, জাপানী ৫%, পর্তুগীজ ৪.৩%, জার্মান ৩.৮%, আরবী ৩.৩%) - বাংলা, হিন্দিভাষী বিশাল জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটে তাদের ভাষায় কথা বলে তুলনামূলকভাবে কম। রয়েছে আরও অসামঞ্জস্যতা - ৩১৩ বিলিয়ন ওয়েবপেইজের ৬৮.৪% ইংরেজী ভাষায় তার পরে মাত্র ৫.৯% জাপানি ভাষায় আর ৫.৮% জার্মান ভাষায় (সূত্র)। ২২.৬% চৈনিক ভাষী ব্যবহারকারী ওয়েব কন্টেন্টের মাত্র ৩.৯% তৈরি করে।



এই সব পরিসংখ্যান একটি কথা বলে - আমরা বিশ্বকে জানি বা দেখি ইংরেজী ভাষীদের দৃষ্টিতে - হবেই না কেন বিশ্বের ৬২.৫৫% সংবাদপত্র/ম্যাগাজিন, ২২% বই, ৪৫% জার্নাল, ৩৫% ছবি ও ভিডিও ইংরেজী ভাষায়। কিন্তু এটি একে অপরকে বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে নানা স্টেরিওটাইপ তৈরির মাধ্যমে। আমরা ব্রাজিলের কোন ব্লগারের বক্তব্য জানতে পারব না যদি না কেউ অনুবাদ করে দেয় তার ব্লগ। তেমনি বাংলা ব্লগারের লেখা  একজন ব্রাজিলিয় পড়তে পারে না।

বিশ্ব সমাজকে এগিয়ে নিতে গেলে তাই অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অনুবাদের কার্যকরী টুলটি সেক্ষেত্রে একটি জরুরী উদ্ভাবন। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে মেশিন ট্রান্সলেশন কি পর্যায়ে আছে? এক ক্লিকে অনুবাদের ব্যবস্থাটি এখনও নিখুঁত নয়। তার চেয়ে বড় কথা হল মেশিন সব অনুবাদ করে দেবে এই ধারনাটি কম্পিউটার কবিতা লিখবে এরই সমার্থক।

অনুবাদ একটি শিল্প। একজন অনুবাদকের দুই ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকা লাগে, পাঠকদের কথা চিন্তা করতে হয় - তবেই সে সঠিক অর্থ ফুটিয়ে তুলতে পারে। আমাদের অনেকেরই জানা নেই যে অনুবাদ একটি ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। বিশ্বাস হচ্ছে না? ছবির সাবটাইটেল একটি বড় অনুবাদের জায়গা। এরপর ধরুন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনেক প্রকাশনা নিয়ম অনুযায়ী সদস্য দেশগুলোর ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়। অনেক পেশাদারী অনুবাদের প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব ক্ষেত্রে কর্মরত। তাদের কাজের সুবিধার জন্যে নানা সফট্ওয়্যারের উদ্ভব হয়েছে - যেমন প্রোপাইটরী সিসট্রান, ট্রাডোস ইত্যাদি - বা ওপেন সোর্স - যেমন লিঙ্গোটেক, লুসি সফটওয়্যার, আপেরিটিয়াম ইত্যাদি। এইসব সফট্ওয়্যারের মূল মন্ত্র হচ্ছে একই বাক্যের অনুবাদ যাতে দুইবার না করতে হয়। সেজন্যে তারা সাহায্য নেয় ট্রান্সলেশন মেমোরির। মেশিন অনুবাদে যেই ভাষায় সবচেয়ে বেশী কন্টেন্ট পাওয়া যায় সেই ভাষায় অনুবাদ সবচেয়ে বোধগম্যভাবে হয়। কিন্তু এইসব ট্রান্সলেশন মেমোরি বিনামূল্যের নয় - বাজারে বিক্রি হয়। তবে যেই সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হোক মানুষ কর্তৃক মান নিয়ন্ত্রণই সফল বাণিজ্যিক অনুবাদের চাবিকাঠী।

অনুবাদকে তার ব্যয়বহুল ইন্ডাস্ট্রির কবল থেকে মুক্ত করে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে ওপেন ট্রান্সলেশন ধারনার উদ্ভব ঘটে। এখানে ক্রাউড সোর্সিং এবং স্বেচ্ছাসেবী অনুবাদের মাধ্যমে মেশিন ট্রান্সলেশন টুলস ব্যবহার করা হয়। গুগলের ট্রান্সলেটর টুলকিট এমন একটি ওপেন ট্রান্সলেশন টুল যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা নিত্য নতুন অনুবাদ সৃষ্টি করে চলেছে এবং সবার জন্যে উন্মুক্ত ট্রান্সলেশন মেমোরি রিপোজিটরি তৈরি করছে।

টেড তাদের ভিডিও অনুবাদের জন্যে অর্ধ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তাদের পেশাদারী সংস্থা দিয়ে করা কিছু বাংলা অনুবাদ দেখে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিলাম এবং তাদের একজনকে বলেছিলাম গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা সংস্করণে   স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা এর থেকে অনেক উঁচু মানের কাজ হয়। তাদের সমস্যা ছিল কাজটি বুঝে নিয়েছিল অবাঙ্গালী কেউ - তাই যা ইচ্ছা বুঝিয়ে দিয়েছিল অনুবাদ সংস্থা। টেড এর পরে কমিউনিটি বেইজড ওপেন ট্রান্সলেশন মডেল চালু করে যা সাফল্য পায়

বাংলা বা তামিলের মত বহু ব্যবহৃত ভাষার জন্যে কার্যকরী মেশিন ট্রান্সলেশন টুলস এতদিন তৈরি না হওয়ার পেছনে রয়েছে পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও অর্থের অভাব - অনুবাদক ও অন্কুর এর মত গুটিকয়েক প্রকল্প বেশি দুর আগাতে পারেনি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।  



এছাড়াও রয়েছে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ - অনুবাদ কিন্তু শুধু শব্দের প্রতিস্থাপন নয় - রয়েছে ব্যাকরণ, বাক্যের গঠন, রুপক, বাগধারা ইত্যাদির প্রভাব। যেমন ধরুন দক্ষিণ এশীয় ভাষাগুলোতে বাক্যগুলো (subject-object-verb * আমি-ভাত-খাই) নিয়মে গঠিত হয় যেখানে ইংরেজীতে বাক্য গঠিত হয় (subject-verb-object * I eat rice) এই নিয়মে। এছাড়াও পর্যাপ্ত উন্মুক্ত কন্টেন্টের অভাব একটি বড় কারন ছিল। বিষয়টা ব্যাখ্যা করি। একটি মেশিন ট্রান্সলেশন টুলস তিনটি নিয়ম মেনে কাজ করতে পারে:

ক) রুলস বেইজড (ব্যাকরণের নিয়ম আর অভিধান)
খ) স্ট্যাটিস্টিকাল (দ্বিভাষী ট্রান্সলেশন মেমোরি বা করপাস নিয়ে কাজ করে) আর
গ) হাইব্রিড (উপরের দুয়ের সংমিশ্রণ)

গুগল প্রথম দিকে রুলস বেইজড প্রক্রিয়ায় অনুবাদ করলেও ২০০৭ সাল থেকে স্ট্যাটিসটিক্যাল মেথড চালু করে। এই প্রক্রিয়ায় বিশালাকার টেক্সট কর্পোরা এর দরকার হয়। এটি কার্যকরী করতে ন্যুনতম ২০ লাখ শব্দ নিয়ে কাজ করতে হয় এবং অনেক কম্পিউটিং শক্তি লাগে। এই প্রক্রিয়ার সুবিধা হল যে এটি অনুবাদকারীকে সুযোগ দেয় বেশ কিছু কাছাকাছি শব্দ থেকে বেছে নিতে।

[img]http://3.bp.blogspot.com/-aeV8jF52kRI/Tai2LKwMrEI/AAAAAAAAATk/2KLnTwuFBkE/s400/image00.png[/img]
  
এই পদ্ধতিতে আরেকটি সুযোগ আছে - ক্রমাগত অনুবাদের মান বৃদ্ধি করা। গুগল ব্লগ অনুযায়ী আপনি ভুল অনুবাদকে ঠিক করতে পারবেন অনায়াসেই এবং গুগল সেটি মনে রাখবে এবং পরবর্তী বার সঠিক অনুবাদ উপস্থাপন করবে।

কাজেই আমি মনে করি গুগল ট্রান্সলেইটে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে একটি যুগান্তকারী টুল। এটি এযাবৎকালে পাওয়া যাওয়া একমাত্র টুল অনুবাদক অনলাইনের চেয়ে বহুগুণে সমৃদ্ধ। আর এখন বাংলা ভাষা থেকে বিশ্বের ৬২টি ভাষায় (ভুল হলেও) অনুবাদ সম্ভব - এর শক্তি নিশ্চয়ই অনুমেয়। আসুন ওপেন ট্রান্সলেশন ধারনা আপন করে গুগল ট্রান্সলেট এর ভুলগুলো নিজেরা শুদ্ধ করে দেই ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্যে অথবা  গুগল ট্রান্সলেটর টুলকিট ব্যবহার করে গুগলের ট্রান্সলেশন মেমরিকে সমৃদ্ধ করি।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা: অনুবাদক, ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটস, গুগল ট্রান্সলেট।

বিবিধ রেফারেন্স:

ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস ম্যানুয়াল
গুগল ট্রান্সলেট পাঁচটি উপমহাদেশীয় ভাষা যোগ করেছে
*  ওপেন ট্রান্সলেশন দিয়ে বিশ্বে পরিবর্তন আনা
*  Development of A Morphological analyser for Bengali
*  Bootstrapping of a rule based English-Bangla machine translation system using work done for a sister language - BRAC University Institutional Repository

সচলায়তনে প্রকাশিত

Tuesday, May 24, 2011

স্বাস্থ্যই সকল ব্যবসার মূল

ঢাকায় সচলায়তনের প্রাণভোমরা নজরুল দম্পতির সৌজন্যেই বেশীর ভাগ সচলাড্ডা হয়। এই প্রথা ভাঙ্গতেই সিদ্ধান্ত নিলাম ৯ই মে আমার বাসায় একটি ছোটখাট আড্ডা জমাব সচলদের নিয়ে। সব প্রস্তুতি শেষ করতে করতে পারিবারিক এক অসুস্থতা বাগড়া বসাল। আমার শাশুড়ি সপ্তাহ দুই ধরে খাবারে রুচি হচ্ছিল না বলে খুব দুর্বল হয়ে পড়ায় বিভিন্ন ডাক্তার দেখানোর পর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল যে ওনাকে স্কয়্যার হাসপাতালে এক পাকস্থলীর চিকিৎসকের তত্বাবধানে ভর্তি করা হবে। সেই মোতাবেক ৮ই মে সকালে তাকে ভর্তি করানোর জন্যে উদ্যোগ নিলে বলা হল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সিটের জন্যে। সেদিন সকালে ভর্তি হলে হয়ত গল্পটি অন্যরকম হত।

কিন্তু বিধাতা আমাদের জন্যে অনেক অভিজ্ঞতা জমা করে রেখেছিলেন।

সেদিনই তিনি গোসল করতে গিয়ে বাথরুমে পড়ে যান এবং তার পা ভাঙ্গে ও মাথা ফেটে যায়। এর পর গত দুই সপ্তাহেরও বেশী ধরে তিনটি হাসপাতাল ও গণ্ডা দুয়েক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে বোঝাপড়া করে যে অভিজ্ঞতা হল তাতে বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন স্বাস্থ্য সেবার চিত্র সম্পর্কে একটি ধারনা পাওয়া যায়।

অ্যাম্বুলেন্স পর্ব:

আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি যে ওনার পা ভেঙ্গেছে - কিন্তু প্রচণ্ড ব্যাথায় উনি দাড়াতে পারছিলেন না বা পা ভাঁজ করতে পারছিলেন না। তাই অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সিদ্ধান্ত হয়। স্কয়্যারের ইমার্জেন্সির নাম্বারটিতে অনেক চেষ্টা করেও না পাওয়ায় কয়েকশ গজ দুরের হোটেল থেকে রুপান্তরিত হাসপাতালটিতে গেলাম। সামনে গোটা চারেক অ্যাম্বুলেন্স দাড়িয়ে থাকতে দেখে উদ্বেগ কমল। অ্যাম্বুলেন্স চাইতেই বলল কোথা থেকে আসবেন।

: কাছেই বাসা - তবে আমরা স্কয়্যারে নিয়ে যাব।
: না আমাদের হাসপাতালে না আনলে আমরা অ্যাম্বুলেন্স দেব না।
: আমি তো ভাড়া দেব।
: এই অ্যাম্বুলেন্স আমাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্যে।

সময় চলে যাচ্ছে দেখে বাড়ি ফিরে একটি গাড়ির পেছনের সিটে লম্বা করে শুইয়ে ওনাকে নিয়ে গেলাম।

কেবিন পর্ব:

ওনাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবার পর জানা গেল যে কোমরের নীচ থেকে তার পা ভেঙ্গেছে - তবে মাথার আঘাতটি গুরুতর নয়। মাথায় চারটে সেলাই আর পায়ে ট্র্যাকশন ব্যান্ডেজ দিয়ে ছেড়ে দেবার আগে ইমার্জেন্সীর ডাক্তাররা বুদ্ধি দিলেন দ্রুত একটি সিট যোগাড় করতে - কারন ওনার পায়ের অপারেশন লাগবে আর অনেকদিন থাকতে হবে। তদবির কালচারে গা ভাসিয়ে ততক্ষণে আমরা বরাদ্দ পেলাম উচ্চমূল্যের একটি ডিলাক্স কেবিন। আমাদের সৌভাগ্য যে মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছিলাম কারন পরবর্তী কয়েক দিন অবস্থানের সময়ও আমাদের কাঙ্খিত সাধারণ কেবিনের দেখা মেলে নি।

নার্স পর্ব:

স্কয়্যার হাসপাতাল প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত ও প্রফেশনাল একটি হাসপাতাল। কিন্তু বাঙ্গালীরা সেবা ক্ষেত্রে অতটা প্রফেশনাল না এটা প্রমাণ করতে সেরকম কিছু নার্স জুটল আমাদের কপালে।

১) : একটি বাটি দিন রুগী বমি করবে

: (রুগীর জন্যে আনা খাবারের ঢাকনা উপুর করে) এটাতেই করুন এখন - বমির বোল এই ফ্লোরে আর নাই।

২) :  রুগীর শরীর খারাপ লাগছে - একটু মাথাটা মুছিয়ে দিন না কাইন্ডলি।

:  আপনারাই মুছিয়ে দেন - আমার ডিউটি শেষ এখন।

৩) ইমার্জেন্সী বাটন টেপার পাঁচ মিনিট পরেও নার্সের দেখা না পেয়ে তাকে ডাকতে গেলে

: আপনারা এত দেরী করছেন কেন? রুগীর শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে।

: এইটাতো কার্ডিয়াক ফ্লোর আর আমি শুধু একা আছি। আপনাদের অর্থপেডিক্সের ডিউটি ডাক্তারতো বারো তলায় আছে - ডেকে আনছি - অপেক্ষা করেন একটু।

ডাক্তারদের রোগ নির্ধারণ পর্ব:

মাকে ভর্তি করা হল এক বিশেষজ্ঞ হাড়ের ডাক্তারের তত্বাবধানে (যাকে আমরা চিনি না)। রুগীর অবস্থা সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা দিলেন একজন ডিউটি ডাক্তার। তবে অনেক প্রশ্নের উত্তরই ছিল স্যার রাতে আসবেন উনিই বিস্তারিত জানাবেন। সেইদিন রাতে তিনি আসেননি। রাতে মার কাশি ও অনেক শ্বাস কষ্ট হয় কিন্তু সঠিক চিকিৎসা তিনি পান নি।

পরের দিন সকালে আমি এদের অফিসে গিয়ে খুব রাগারাগি করলাম। বললাম ডাক্তার না থাকলে বলেন আমরা অন্য হাসপাতালে যাই। দশটার দিকে জানানো হলো স্যার স্কয়্যারেই আউটডোরের রুগী দেখেন। সেখানে গিয়ে অনুরোধ করেন। সেখানে যেতেই জানলাম উনি রাউন্ডে বেরিয়েছেন। বো টাই লাগানো ফিটফাট ডাক্তারটি বললেন যে তার অপারেশন লাগবে হাড়ের - জটিল কিছু না তবে ইলেকট্রোলাইট ইম্ব্যালেন্স আছে শরীরে সেটা ঠিক করতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। আর শরীরে রক্ত কম (মাথা কেটে অনেক রক্ত ঝড়েছিল) তাই রক্ত দেয়া লাগবে।

তিনি কিডনি, মেডিসিন ইত্যাদি বেশ কিছু কনসালট্যান্টকে রেফার করে বললেন ওনারা রুগীকে তৈরি করে দিলেই আমি অপারেশন করব। এরপর শুরু হল বিভিন্ন ডাক্তারের আগমন এবং আমাদের রোগের ইতিহাস বারংবার বর্ণনা করার নাটক।

১) : ওনার ডায়বেটিস কবে থেকে?
: ওনার তো ডায়াবেটিস নেই।
: কিন্তু ফাস্টিং গ্লুকোজ ১৪ কেন? শেষ কবে করিয়েছেন টেস্ট?
: এইতো মাস দুয়েক আগে। কেন বেশি সেতো আপনি ভাল বলতে পারবেন (ওনাকে গ্লুকোজ স্যালাইন দেয়া হয়েছিল)।

২) : ওনার কিডনির সমস্যার জন্যে কোন ঔষধ খাচ্ছেন কি?
: কিডনির সমস্যা?
: হ্যা জানেন না? ক্রিটেনিন লেভেল খুব হাই। কিডনির টেস্ট শেষ কবে করিয়েছিলেন?
: ওনার হাইপার টেনশন ছাড়া আর কোন বড় অসুখ নেই।

লক্ষ্য করা হল যে বেশীরভাগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই নির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা দেয় না - মূল অর্থপেডিক্স এর ডাক্তারের কাছে উপদেশ হিসেবে পেশ করে। এরপর সেটার প্রতিফলন হয় উনি যখন পরদিন তার রাউন্ডে আসে তখন। ইতিমধ্যে ওনার শ্বাস নিতে অসুবিধাটি বাড়ে এবং অক্সিজেন দেয়া হয়। আমাদের ক্রনিক অর্গান ফেইলিউর ইত্যাদি গালভরা শব্দ দিয়ে ভয় ও দেখানো হয়। আমরা তখন এক চেনা অর্থোপেডিক্সের ডাক্তারের শরণাপন্ন হই যার পরামর্শে পপুলার হাসপাতালে ওনাকে স্থানান্তর করি।

রক্তদান পর্ব:

রক্তের জন্যে ফেসবুকে আবেদন করেছিলাম। কিছু সাড়াও পেয়েছি। পরে আত্মীয়ের মধ্যে থেকে দুইজন এগিয়ে আসেন। স্কয়্যার আবার দাতাদের (উচ্চমূল্যের) ১৮টি টেস্ট করে ম্যাচিং করিয়েই রক্ত দেয়া অনুমোদন করে - নাহলে তাদের ব্লাড ব্যাংক থেকে বিক্রি করে। আমাদের প্রথম রক্তদাতা ত্রিশ বছরের একজন যুবক - রক্তদানের পরের দিন তার হাতে লম্বা করে কালশিরা পরে গেল। আমরা যারপরনাই বিব্রত হলাম এবং জানলাম যে রক্ত ওরা নেয় একটি মেশিনের মাধ্যমে - যেটিতে অ্যালার্ম বাজার পরও কোন অ্যাটেন্ডেন্ট ছিল না বলে রক্ত ব্যাগ থেকে উপচে পুনরায় শরীরে গিয়ে এমন হতে পারে।

 আইসিইউ পর্ব:

পপুলারে আসার পর দিন যানা যায় যে ওনার নিউমোনিয়া হয়েছে এবং খুব সম্ভবত এটি হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া - অর্থ্যাৎ স্কয়্যার থেকেই হয়েছে রুগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিপর্যস্ত থাকার কারনে (অথচ সেখানকার ডাক্তাররা সেটা ধরতে পারে নি)। ওনার শ্বাস কষ্ট বাড়লে তাকে ১৩ তারিখ আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে আবার একগাদা টেস্ট করা হয় এবং বলা হয় ওনার হয়েছে প্রাণঘাতি এআরডিএস (অ্যাকোয়ার্ড রেস্পিটরী ডিসট্রেস সিনড্রোম) যেটি বেশ কিছু কারনেই হতে পারে। রুগীর ইলেক্ট্রোলাইটের সমস্যা কেটে গিয়ে শরীরের অবস্থা কিছুটা ভাল হলেও ফুসফুসের অবস্থা ও অক্সিজেন ডিপেন্ডেন্সি অপরিবর্তিত থাকে। এই অবস্থায় অ্যানেস্থেসিস্ট অস্ত্রোপচারে রাজী না হলে ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসা আরও অনিশ্চিত হয়ে যায়।

১৫ তারিখে তার সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট আসে এবং বলা হয় যে টিউমার জাতীয় কিছু দেখা গেছে তার ফুসফুসে এবং ক্যান্সার কিনা নিশ্চিত করার জন্যে বায়োপসী আর ব্রন্কোস্কপি করা লাগবে।

আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়ি - এবং মনে হয় নির্দিষ্টভাবে রোগ নির্ধারণের আগে এরকম বলাটা মূল শোষক সিস্টেমেরই একটি অংশ। আমরা বিদেশে অবস্থানরত এক আত্মীয় ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হই। তিনি বলেন যে যদি তার ক্যান্সার হয়েও থাকে এখন এই শারীরিক অবস্থায় কোন চিকিৎসা দেয়া যাবে না। ডাক্তারদের উচিৎ তার ফুসফুসের সমস্যা নির্মূল করে আইসিইউ থেকে বের করে আনা এবং পরে ক্যান্সার নির্ধারনের পদক্ষেপ নেয়া।

 জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম পর্ব:

ইতিমধ্যে এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মতামত দেন যে রুগীর সচেতনতা আছে বলে আইসিইউতে রাখা ঠিক হচ্ছে না - তাকে হাই কেয়ার বা সেরকম ইউনিটে রাখা উচিৎ। কারন আইসিউতে ঢোকা রুগীদের মধ্যে বাঁচার চান্স ৫০:৫০ এবং প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। এটি রুগীর উপর প্রভাব ফেলে এবং সত্যিকার অর্থেই মাও হাল ছেড়ে দেয় এই সময়। তবুও তাকে ব্যয়বহুল আইসিইউতেই রাখা হয় এবং অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে এবং শরীর থেকে পর্যাপ্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বের করতে পারছিলেন না তিনি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তখন লাইফ সাপোর্টের কথা বললেও পপুলারের ডিউটি ডাক্তাররা উপদেশ দেন যে বাইপ্যাপ মেশিন নামে একটি মেশিন আছে যেটির মাধ্যমে নল না ঢুকিয়ে এই অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। সেটি ভাড়ায় যোগাড় করা হত নাকি আগে। তবে আমাদের এই দরকারের সময়ে সেটি পাওয়া সম্ভব হয় না।

তখন আমাদের কাছে হাসপাতালের প্রশাসন থেকে অদ্ভুত এক উপদেশ আসে। যেহেতু হাসপাতাল যোগাড় করতে পারছে না - আমরা মেশিনটি কিনে দিতে পারি। মেশিনটির মূল্য ২লাখ থেকে আড়াই লাখের মধ্যে। আমার আর কোন অনুভূতি তখন কাজ করে না। আমাদের আত্মীয় ডাক্তারটি সুদুর বিদেশ থেকে চিৎকার করে বলে তোরা কোথায় গেছিস? বের হ ওখান থেকে - জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি নেই আবার কোন মুখে রুগীকে কিনতে বলে। আমরা লজ্জা - আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে হাসপাতালকে পুনরায় অনুরোধ করি কোথাও থেকে যোগাড় করতে -কারন রুগীকে এই অবস্থায় নড়াতে চাচ্ছিলাম না। পরদিন সন্ধ্যায় অবশেষে মেশিনটি আসে কিন্তু ততক্ষণে মার অবস্থা আরও অবনতির দিকে - তাকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে দিয়ে দেয়া হয়।

 ডাক্তারদের নৈতিকতা পর্ব:

ওনাকে লাইফ সাপোর্টে দেবার আগেই আমরা একটি মেডিকেল বোর্ড বসানোর কথা বলেছিলাম। আমরা দুজনের নাম প্রস্তাব করি এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও কয়েকজনের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে তাদের অধিকাংশই বোর্ডে আসতে রাজী হয় না। এদের একজনকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করলে তিনি জানান যে তিনি বোর্ডে আসতে না পারলেও একবার এসে রোগী দেখে যাবেন। নিশ্চয়ই ৫ মিনিটে এক হাজার টাকা উপার্জন আর আধা ঘন্টায় দুই হাজার টাকা আয়ের মধ্যে ফারাক আছে।

অবশেষে মাকে ল্যাব এইডে নেয়া হয় - মূলত উন্নত যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসার আশায়। সেখানে অবশেষে মেডিক্যাল বোর্ড আজ বসে এবং আমি ডাক্তার প্রতি ২ হাজার টাকা করে হাতে নিয়ে বাইরে দাড়িয়ে থাকি। এটা নাকি হাসপাতালের নিয়ম যে বাইরে থেকে ডাক্তার আসলে সেই বিল হাসপাতালের মূল বিলের সাথে যোগ হবে না - রুগী ক্যাশে আলাদা দেবে। এর সাথে আয়কর ফাঁকি বা অন্য কিছুর সম্পর্ক আছে কিনা জানি না তবে আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না। আমি এই সিস্টেমের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। এনারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সিটি গা্ইডেড বায়োপসী আর ব্রন্কোস্কপী করা হবে কারন তারা বুঝতে পারছেন না রুগীর নিউমোনিয়া, যক্ষা না ক্যান্সার। সেই অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা হবে।

না মাসে পাঁচ লাখ টাকা বেতনের এইসব ডাক্তারের কাছে বাস্তব জগৎটি ধরা পরে না। চোখের সামনে দেখা অ্যাক্সিডেন্টের পর আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা সিটি কর্পোরেশনের এক ময়লার ট্রাক ড্রাইভারের আত্মীয়দের কথোপকথন:

: রুগীর অবস্থা কিরকম?
: ভাল না, বাঁচার চান্স খুবই কম।
: ওনার গলার থিকা নল কবে খুলবেন?
: এটা খুললেতো উনি নিজে শ্বাস নিতে পারবেন না মারা যাবেন। রাখতে হবে।
: শুনছি যে অনেক খরচ।
: হ্যা লাইফ সাপোর্টে থাকলে ৪০০০০-৫০০০০ টাকা খরচ হয় প্রতিদিন।
: তাইলে তো পারুম না।
: এইটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।

কয়েক ঘন্টা পরে:
: আমাদের রুগীকে ছাড়বেন কবে।
: এরকম করেন কেন? রুগী মরতেও তো সময় লাগে।

 প্রতিকার কোথায়:

সময় এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ভাববার। জীবনের, স্বজনের প্রতি আমাদের ভালবাসা, দায়িত্ববোধ ও অনুরাগের সুযোগ নিয়ে মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্যে এক শ্রেণীর স্বাস্থ্য বেনিয়া তৎপর। সরকারী স্বাস্থ্য সেবা সেই শূন্যস্থান পুরণের মত অবস্থায় নেই। প্রতিবেশী ভারতে হেল্থ ইনস্যুরেন্সের চল বাড়ছে বিজ্ঞাপনে দেখলাম। আমাদের দেশে হেল্থ ইন্স্যুরেন্স কই?

আমার শাশুড়ীকে লাইফ সাপোর্টে দেবার পর উনি কথা বলতে পারেন না আর। কিন্তু ইশারায় অনেক বলেন। যেমন ল্যাব এইডে স্থানান্তর করার আগে উনি হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করছিলেন ওনাকে বাসায় নিয়ে যেতে। হাত গালে দিয়ে দেখালেন যে উনি একটু শুতে চান। ওনাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম ওখান থেকে নিয়ে যাব। কিন্তু নিয়ে তুললাম মুদ্রার ওপিঠ আরেকটি হাসপাতালে। এখন তিনি অভিমানে ফ্যালফ্যাল করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর অনুভুতি শুন্য আমরা আমাদের মাকে এইসব বেনিয়াদের হাতে ফেলে রেখে দায়িত্ব পালন করি। খাই দাই অফিস করি। ভেবেও দেখি না - ওই বেডে আমিও একদিন হয়ত থাকব এমনই ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

সচলায়তনে প্রকাশিত