Wednesday, September 08, 2010

ফ্রি মানে মাগনা নয় - পর্ব এক

নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশে ইন্টারনেট যখন এল তখন এটি ছিল খুবই একটি খরুচে প্রযুক্তি। মাইক্রোসফ্ট অফিস/উইন্ডোজ সহ দামী কম্পিউটারের সাথে আট হাজার টাকা দিয়ে মডেম কেন, ইমেইলের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আইএসপির ডায়ালআপ অ্যাকাউন্ট খোল - ইত্যাদি - এর সাথে সাথে ফোন বিল ও আইএসপির মিনিট প্রতি চার্জের ব্যাপারটি তো ছিলই। কিন্তু আজকের কথা চিন্তা করুন, ফোনেই থাকে মডেম আর বাংলাদেশে ৩০০ টাকা দিলে মোবাইল ইন্টারনেটের বেসিক প্যাকেজ পাওয়া যায়। ইমেইলের জন্যে তো কোন টাকা দিতে হয় না, জিমেইল হটমেইল ইত্যাদি প্রচুর স্টোরেজসহ ব্যবহার করা যায় মাগনা। লিনাক্স তো আছেই, সফ্টওয়্যারের মধ্যে ওপেন সোর্সের কল্যাণে অভ্র, ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশীট ইত্যাদি মায় অ্যান্টিভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যে - এবং পাইরেটেড সফ্টওয়্যার ব্যবহার করার গ্লানিটুকু নেই মনে।

শুধু তাই নয় আজকাল ফেসবুক, অর্কুট ইত্যাদি সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট, মাইক্রোব্লগিং এবং ব্লগিং সাইট সবই বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। অনেক বাংলা প্লাটফর্ম বের হয়েছে যার তৈরির জন্যে বেশ অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয় বা হচ্ছে কিন্তু তাদের অনেকেই কোন বিজ্ঞাপন বা অন্য কোন ভাবে আয়ের উপায় রাখেনি।


আমাদের মনে তাই মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয় যে এই নতুন মাগনা সংস্কৃতি, মাগনা অর্থনীতির স্বরূপটি কি? কিভাবে সম্ভব হচ্ছে বিনেপয়সায় এত সব সেবা পাওয়া যেখানে পূর্বে এত খরচ করতে হত?

এই বিষয়টি নিয়ে প্রথম পড়ি ওয়াইয়ার্ড ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ক্রিস অ্যান্ডারসনের একটি সম্পাদকীয়তে। তিনি এ নিয়ে 'ফ্রি' নামে একটি বইও প্রকাশ করেন গত বছর। সেটির অডিওবুকটি ডাউনলোড করে এবং এ বিষয়ে আরও কিছু পড়াশোনা করার পর মনে হল এ নিয়ে কিছু লিখলে মন্দ হয় না। পড়ার সুবিধার্থে এ সিরিজটি বেশ কয়েক পর্ব নেবে।

ফ্রির একাল এবং সেকাল

ফ্রি বা বিনেপয়সায় কথাটির মানে আমরা সবাই জানি কিন্তু এই শব্দটির যথেচ্ছা ব্যবহার মাঝে মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা রহস্যেরও সৃষ্টি করে। আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে কোন কিছু বিনেপয়সায় পাওয়ার মানে একরকম ছিল আর বর্তমান কালে ফ্রির মানে আরেক রকম। এই ব্যাপারটি অনেকেই খেয়াল করে না। আজকালকার দিনে কেউ কোন কিছু বিনেপয়সায় দিয়ে দিলে দেখতে হবে এর সাথে কি কি শর্ত জড়িয়ে থাকতে পারে, আবার হয়ত নাও পারে। ফ্রি লাঞ্চ বলে এমন কিছু নেই এই কথাটির মর্ম পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন ফ্রি লাঞ্চ খাওয়ালে হয়ত আপনি দ্বিগুণ ভাবে আপনার টাকা ফেরত পেতে পারেন, এবং অবশ্যই যাকে খাওয়াচ্ছেন তার থেকে না, অন্য কারও কাছ থেকে, অন্য কোনো ভাবে।

এই ফ্রি পণ্য বিপণন জগতের অংশ হবার পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দিতে শুরুর দিকে কিং জিলেট ডিসপোজেবল দাড়ি কামানোর ব্লেড উদ্ভাবন করলেন এবং তা বাজারজাত করা শুরু করলেন। ১৯০৩ সালে প্রথম বছর তার বিক্রি হল ৫১টি রেজর এবং ১৬৮টি ব্লেড। এতে দমে না গিয়ে কিন্তু পরের দুই দশকে তিনি লক্ষ লক্ষ রেজর এবং ব্লেড বিক্রি করলেন তার নতুন ধারণা কাজে পরিণত করে। কি সেই যুগান্তকারী ধারণা? তিনি নামমাত্র মূল্যে লক্ষ লক্ষ রেজর বিক্রি করলেন –- রেজর বিনামূল্যে দেয়া হতে লাগল অন্যান্য পণ্যের সাথে - যেমন কফি, মশলা ইত্যাদি। ফলে তিনি কয়েকগুণ পরিমাণ ব্লেডের চাহিদা উৎপন্ন করতে পারলেন যা তার কোম্পানিকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেল।
এই মডেলটি এখনও সারা বিশ্বে প্রযোজ্য - ফোন ১ ইউরোতে দেয়া হয় দুই বছরের নির্দিষ্ট পরিমাণ ন্যূনতম ব্যবহারের শর্তে যার মাধ্যমে ফোনের দাম উঠে যায়। ভিডিওগেমের কন্সোলের মূল্য কম রাখা হয় এবং পরে ভিডিও গেমের উচ্চ মূল্য তা পুষিয়ে নেয়।

জিলেটের কল্যাণে এই ধরণের ফ্রি পণ্যের ধারণা মানুষের কাছে আর নতুন নয়। আপনি একটি কিনলে একটি ফ্রি পাবেন - অর্থাৎ শর্ত একটি থাকছেই। কারণ ওই বিনামূল্যের জিনিষটি আরেকটি নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে। ফ্রি শব্দটির অনেক প্রভাব আছে ভোক্তার মনস্তত্বের উপরে, এটি নতুন বাজার সৃষ্টি করতে, পুরোনো বাজার সম্প্রসারণে এবং পণ্যের প্রচারে সাহায্য করে। অর্থাৎ আদতে ফ্রি মানে লাভহীন নয়।

তবে গত দশকে আর এক ধরণের ফ্রি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতির মূল ধারনা বেড়ে উঠেছে একাধিক মূল্যসহ ও মূল্যহীন পণ্যের মধ্যে সম্পৃক্তির ধারনা ছাপিয়ে - অর্থাৎ পণ্যের মূল্য এত কমে গেছে যে সেগুলো সত্যিই বিনেপয়সায় দিয়ে দেওয়া যায় এবং হয়তোবা একটি নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা যায়। কী, গোলমেলে লাগছে?


চার্ট: স্টিভেন লেকার্ট আর নিকোলাস ফেলটন

এই গুগল সংস্কৃতির কথাই চিন্তা করুন, ডিজিটাল জগৎে আমরা এখন অনেক কিছুই ফ্রি পেতে অভ্যস্ত। মনে আছে বছর তের আগে আইএসএনের ডায়ালআপ কানেকশন নেবার সময় প্রথম ইমেইল অ্যাকাউন্ট হয়েছিল আমার। উচ্চ সংযোগ মূল্য তো ছিলই তখন ফোনের বিল ইন্টারনেট মিলিয়ে প্রচুর খরচ হত সেটি ব্যবহার করতে। এখন বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে হয়ত ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায় যেটা ব্যবহার করে আমার জিমেইল আর হটমেইলের মেইল চেক করে নেই। দুটোর কোনটির জন্যেই টাকা দিতে হয়নি এখন পর্যন্ত, আবার জিমেইলের জিটক আমেরিকা আর কানাডার ফোন নম্বরে বিনে পয়সায় কথা বলার সুযোগও করে দিল বিনেপয়সায় -– কোথায় রাখি এ আনন্দ! সবই ফ্রি।

তবে আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে যে গুগল কীভাবে চলে? তার আয়ের উৎস অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং আরও নানা কিছু - সে বিষয়ে পরে আসছি - কিন্তু জেনে রাখুন গুগল কিন্তু সরাসরি আপনার কাছে এই বিনেপয়সার সেবার জন্যে অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করছে না (তাদের পণ্য আছে ঠিকই – - গুগল প্রিমিয়াম ভার্সন ইত্যাদি)।

এ অবস্থায় আসতে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্যে যেতে হয়েছে এই অনলাইন ইন্ডাস্ট্রিকে। অনেকদিন মূল্য প্রদান সাপেক্ষে সাবস্ক্রিপশনের ব্যবস্থা রাখলেও ২০০৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তার অনলাইন ভার্সন উন্মুক্ত করে দেয় এবং পাঠকরা এখন বিনে পয়সায় পড়তে পারে। এটাই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।

ক্রিস এন্ডারসন তার ফ্রি নামক বইতে বলেছেন যে একবিংশ শতাব্দীর ফ্রি হচ্ছে নতুন ধরনের ফ্রি, এবং এই ধারণাটি আমাদের ভবিষ্যৎকে বদলে দেবে। বর্তমানের বিনে পয়সার ধারণাটি কোন লুকানো পণ্য বিক্রি করার ধারণা নয় বরং এক পকেট থেকে আরেক পকেটে টাকা স্থানান্তরের একটি উপায় আপনার কাছ থেকে সরাসরি কোন সুবিধা না নিয়ে। এটি একটি পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক মডেল।

পরবর্তী পর্বে থাকছে ফ্রির অর্থনৈতিক মডেল।

ছবি: মার্কো মলিনারির সৌজন্যে, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত।

No comments: