Sunday, October 07, 2007

কিছু পড়ো না, কিছু শুনো না, কিছু লিখো না....

রাজাঃ আজ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ
পারিষদঃ জী আজ্ঞা খোদা বন্দ
রাজাঃ কি নাম যেন পন্ডিতের,
তারে বলবে সে পড়িয়েছে ঢের।
পারিষদঃ ইন্টার নেট!
রাজাঃ তুমি কি গবেট?
রাজাঃ আজ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ।
পারিষদঃ জী আজ্ঞে
রাজাঃ এরা যত বেশী পড়ে
তত বেশী জানে
তত কম মানে।
ঠিক কিনা?
পারিষদঃ ঠিক। ঠিক। ঠিক।

'হীরক রাজার দেশ' শিরোনাম দিয়ে এই কমেন্টখানি করেছেন লাল দরজা

বাকস্বাধীনতা মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার। কথা বলার এবং কথা শোনার অধিকার এবং যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশচ্য়তা দিয়েছে বাংলাদেশ সংবিধান তার ৪৩ ধারার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনে যোগাযোগ ও কথোপকথনের নতুন নতুন টুলগুলোর উদ্ভব হয়েছে যা বাকস্বাধীনতাকে আন্তর্জাতিক মহলে প্রসারিত করেছে।

ইন্টারনেট এমন একটি প্রযুক্তি যা অনেক নতুন মাধ্যম (new media) ও টুল আবিস্কার করেছে যার ফলে তথ্য ও কথোপকথন আর সেইসব লোকের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নেই যারা প্রকাশনা ও বিতরনের মাধ্যমগুলোর মালিক বা দখলদার; সেইসব সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেই যারা চিন্তা ও কথোপকথনে বাধা আরোপ করে। এখন যে কেউ প্রেস এর শক্তিকে ব্যবহার করতে পারে (যেমন নিজস্ব ব্লগে সংবাদ, ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা যায়)। যে কেউ তাদের গল্প পৃথিবী জুড়ে লোকের কাছে বলতে পারে ইমেইল বা অন্য কোন টুল দিয়ে। মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এসব টুলগুলো ব্যবহারের সার্বজনীন বাধাহীন অধিকার প্রয়োজন।

ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল) হচ্ছে সেধরনের একটি প্রযুক্তি যার ফলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম খরচে ফোনে কথা বলা যায়। এর সুবিধা হচ্ছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর দামী সলিউশনগুলোর উপর না নির্ভর করে ছোট উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সহজলভ্য এই প্রযুক্তির সুবিধা জনগনের কাছে পৌছে দেয়া যায়। আমরা বিগত দশকে যে কলিং কার্ডের উদ্ভব দেখেছি যার মাধ্যমে বিপুল সংখক প্রবাসী বাংলাদেশী দেশের সাথে কম খরচে যোগাযোগ রাখতে পারছেন তা এই ভিওআইপির কল্যানেই। বিশ্বের অনেক দেশে এর আইনগত বৈধতা দেয়া হয়েছে এবং সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে যে কেউ এটি করতে পারে। বাংলাদেশও এ প্রযুক্তির সেবা দিতে পিছিয়ে নেই। কিন্তু এতদিন সময়োপযোগী সরকারী বিধিমালার অনুপস্থিতিতে ছোটখাট অনেক ভিওআইপি অপারেটর গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী এইসব ব্যবসার বাংলাদেশের ব্যাকবোন হিসেবে। এগুলোর বেশীরভাগই প্রযুক্তি বিষয়ে জানা যুবক এবং কিছু পূঁজি লগ্নিকারীর ছোটোখাট উদ্যোগ। এই বাজার সৃষ্টি করেছে আন্তর্জাতিক ব্যবসার চাহিদা, কোন অবৈধ উদ্দেশ্য নয়। সুস্পস্ট নিয়ম নীতিমালা না থাকায়ই এরা অনেক সময় বাধ্য হয়েছে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যবসায়িক লেনদেন করতে। কিন্তু এই ব্যবসার পরিসর এত বড় হয়ে গেছে যে অনেকেরই শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে এর উপরে।

প্রথম খোঁড়া যুক্তি হচ্ছে যে এই ভিওআইপির জন্যে বিটিটিবির রেভেনিউ কমেছে। এই কারন দেখিয়ে তারা এইসব ছোটখাটো ভিওআইপি উদ্যোগগুলোকে দমন করতে সচেষ্ট হয়েছে। বিটিটিবির রেভেনিউ হয়তো এর ফলে বেশ কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মানে হচ্ছে সাধারন ভোক্তাদের কলিং কার্ড বাদ দিয়ে সাধারন চ্যানেল ব্যবহার করে কয়েকগুন বেশী মূল্য দিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কলিংকার্ডে বাংলাদেশে আগে যে মূল্যে কথা বলা যেত এখন তার থেকে প্রায় দ্বিগুন দিতে হচ্ছে। আর এইসব ছোটখাট উদ্যোক্তাগুলো যারা পুঁজিসহ সর্বশান্ত হয়েছেন কারন তাদের পূনর্বাসনের চিন্তাতো করা হয়নি তাদের বরং তাদের অপরাধী হিসেবেই চিন্হিত করা হয়েছে।

আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে যে প্রযুক্তি/ব্যবসা কম মূল্যে সেবা দেবে সেটাই তো মানুষ গ্রহন করবে। অন্যান্য দেশের লোকেরা যেখানে এই সুবিধা পাচ্ছে সেখানে এদেশের মানুষকে এ থেকে বন্চিত রাখা হচ্ছে। সরকারের উচিৎ নিজের ব্যবসায়ীক লাভের কথা শুধু না ভেবে সবাইকে প্রযুক্তির সুবিধা এবং আইনগত ব্যবসার সুযোগ সম্প্রসারিত করে দেয়া যেখানে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকবে এবং যাতে আইনগতভাবে সরকারকে কর দিয়েই এসব ব্যবসা হয়। ফলে লোকসানের প্রশ্ন আসছেনা।

প্রযুক্তিকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। বাংলাদেশে ফ্যাক্স মেশিন যখন প্রথম আসে তখন বিটিটিবি নাকি দুই বছর ফ্যাক্স মেশিনের ব্যাবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছিল কারণ ফ্যাক্সের কারনে নাকি তাদের টেলিগ্রাফের ব্যাবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ৮০’র দশকের শেষের দিকে এবং ৯০এর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ দুবার কম খরচে সাবমেরিন কেবল কন্সোর্টিয়ামের সাথে যোগ দিতে পারেনি কারন সেসময় সংশ্লিষ্ট নিয়ম নির্ধারকরা যাদের প্রযুক্তিগত ধারনা ছিলনা সরকারকে বুঝিয়েছিল যে এর ফলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাইরে পাঁচার হয়ে যাবে। ফলে বিপুল টাকা খরচ করতে হয়েছে গত বছরে পাওয়া সাবমেরিন কেবলের সংযোগের জন্যে। মাঝখান থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত গত প্রায় দেড় দশকে এই সাবমেরিন কেবল ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এর কাজগুলো দেশ থেকে করে বিপুল এক জনগোস্ঠীর চাকুরীর সুযোগ করে দিয়েছে ও বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। তাই প্রযুক্তিকে জনগনের কাছে সহজলভ্য না করার ফলাফল কখনই লাভজনক হয়না।


বিটিআরসির এইসব হঠকারী নিয়ন্ত্রনকারী পদক্ষেপ বাংলাদেশে প্রযুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করেবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাদের এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার সময় এতে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এই ব্যপারটিও বিবেচনায় রাখা হয়নি। কিন্তু তারা এই সুযোগটি নিতে পারছে কারন আমরা কি আমাদের নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন?

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

No comments: