Wednesday, July 29, 2009

জাকার্তা বার্তা

সাড়ে তিন বছর ইউরোপে বসবাসের পর আমার নতুন বসতি এখন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। দোহাতে উড়োজাহাজ পরিবর্তন করে সিঙাপুরের ফ্লাইটে উঠতে যাব তখন দেখি মাথায় কাপড় দেয়া বিশাল একদল ইন্দোনেশীয় নারী লাইন ভেঙ্গে বোর্ডিং এর জন্যে দাড়াতে তৎপর। এরা মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের বাড়ীর গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করে বাড়ী ফিরছে। এছাড়া লাইনের বেশ কিছু লোকজনের পোষাকে বোঝা গেল তারা ওমরাহ করে দেশে ফিরছে। সিঙাপুরে যাত্রাবিরতিটা হলো খুব মজার। একই বিমান জাকার্তা যাবে, ফুয়েলিং এর জন্যে থেমেছে। কিন্তু আমাদের সবাইকে নামানো হল এবং আবার নতুন করে চেকইন ও বোর্ডিং করানো হল। জিজ্ঞেস করায় বলা হলো যে সিঙাপুরের আইন নাকি কড়া। দোহা থেকে বিমানে সাথে তরল পদার্থ নেয়ার অনুমতি ছিল কিন্তু সিঙাপুরে বিমানে নেয়া যাবে না।

সেখান থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের ফ্লাইট জাকার্তা পর্যন্ত। প্লেন নামার সময় নীচে বেশ সবুজ দেখলাম। এয়ারপোর্টটি বেশ বড় মনে হলো না। আমাদের 'জিয়া' এর থেকে বেশ বড়। তবে বেশ একটি গোছানো ভাব আছে। নীচে গ্রাউন্ড স্টাফের ছড়াছড়ি, একটু পরপর মোছা হচ্ছে মেঝে। শোয়াইন ফ্লুর জন্যে আমাদের একটি ডিক্লারেশন দিতে হলো (জ্বর আছে কিনা, কোথা থেকে এসেছি) ইত্যাদি। একজায়গায় দেখলাম জটলা। স্ক্রীনিং করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সবার কাছ থেকে ডিক্লারেশনটি নিয়ে পড়ে না দেখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বুঝলাম সেই ব্যুরোক্রেসী - আমরা নিজেও জানিনা এসব কেন করছি - ফলাফল শুন্য।

ইমিগ্রেশনে অনেক সময় লাগল। উল্টে পাল্টে পাসপোর্ট ভিসা দেখল অফিসার, কিছু টাইপ করল, একবার কাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল। তারপর মুক্তি। নিতে লোক এসেছিল, তাই মালপত্র গাড়ীতে উঠিয়ে চললাম জাকার্তা শহরের উদ্দেশ্যে (এয়ারপোর্টটি মূল শহরের একটু বাইরে)। আমরা যাচ্ছি একটি টোল রোডে এবং আমাদের যাত্রাপথের উল্টোদিকে প্রচুর জ্যাম।

কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য 
কাচ ও কংক্রীটের চকচকে রাজ্য

সত্যিই শহরে ঢুকে প্রথমেই মনে হল ঢাকার কথা। মেগাসিটির অন্যতম চিহ্ন হচ্ছে স্মগ (কুয়াশা), হাইরাইজ এবং অগুণতি শপিং মল। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জাকার্তাকে একটু একটু করে আরও চিনলাম। উচু বিল্ডিঙ এর ধারেই ভাঙ্গা বাড়ী - যদিও আমাদের বস্তির মত জীর্ণ নয়। অনেক এলাকায়ই চিপা গলি, রাস্তা ভাঙ্গা।

বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র 
বিত্তবৈভবের অপর পীঠেই দারিদ্র

ওদের রিক্সা নেই কিন্তু রাস্তায় গিজগিজ করে মোটরসাইকেল, ওরা বলে ওজেক। ছোট রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওজেকের স্টল, ভাড়ায় খাটে। জ্যামের কারনে দ্রুত চলাচলের জন্যে বেশ জনপ্রিয়।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্যে আছে তাদের মিনিবাস। যেখান সেখান থেকে লোক উঠাচ্ছে। আর ট্রান্স জাকার্তা এসি বাস যার জন্যে রয়েছে আলাদা লাইন। রাস্তায় গাড়ী চলাচলে কেউ নিয়ম মানে না। তবে বিশৃংখলাও নেই।

জাকার্তার লোকেরা এমনিতে খুব ভদ্র। তবে নৈতিকতার অভাব রয়েছে বড্ড, আমাদের মতই। ট্যাক্সি ড্রাইভার এমন ভাব করবে যে তার কাছে কোন ভাংতি নেই, অর্থাৎ চেন্জটুকু রেখে দিতে চাচ্ছে। তাই ভাষা না জানলে রাস্তায় চলা খুব অসুবিধা। এখানে টুরিস্ট বা বানিজ্যিক এলাকা ছাড়া দোকানে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ইংরেজী জানা লোক খুব কম।
আমার প্রথমে অসুবিধা হলো ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে। এক ইন্টারনেট কাফেতে গেলাম সেখানে স্পীড অনেক স্লো। বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করলেও অনেক চেষ্টা করেও ইন্সটল করতে পারলাম না। ভাষার সমস্যা সত্বেও ক্যাফের লোকটিকে বোঝালাম যে আমার ফন্টটি ইন্সটল করা জরুরী। সে এসে কিছুক্ষণ গুঁতাগুতি করে বলল আমি পারব না। আমাদের ইন্জিনিয়ারকে লাগবে। আমি বললাম তাহলে অনুগ্রহ করে কালকে করিয়ে নিও। বলল সে তো সব সময় আসে না।

এরপর অনেক খুঁজে পেতে গেলাম মোবাইল ইন্টারনেটের জন্যে সিম কিনতে। আমাকে একগাদা লিস্ট ধরিয়ে দিল - যে এই কাগজপত্র লাগবে। দেখলাম আমার এসব বের করতে মাস তিনেকের ধাক্কা। এই কদিন আমি ইন্টারনেট ছাড়া থাকব! পরবর্তীতে এক স্থানীয় আমাকে সাহায্য করে তার নামে পোস্ট পেইড সিমটি কিনতে। আমি কানেকটেড হতে পারলেও সার্ভিসের অবস্থা চরম খারাপ, কখনই তাদের উদ্ধৃত স্পীড পাওয়া যায়না। আর সন্ধ্যার পরে তো একেবারে স্লো হয়ে যায়। এর চেয়ে আমাদের দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের সার্ভিস অনেক ভাল।

চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম 
চার লেনের চওড়া রাস্তা - তারপরেও জ্যাম

শ্রমের মূল্য কম বলেই বোধহয় এখানে কর্মদক্ষতাও কম। আর রয়েছে দুর্নীতি। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। কর্মচারী সংসদ থেকে রিসিট পর্যন্ত দেবে আপনাকে ঘুষের জন্যে। তাই সেবার মানও সেইরকম - কড়ি ঢালবেন তো সবকিছু এসে হাজির, না হলে কিছুই নড়বে না।

তবে দুর্নীতির মূলে মনে হয় ধনী গরীবের চরম বৈষম্য। এখানে আছে কারওয়ান বাজারের মত কাঁচা বাজার আবার নন্দন আগোরার মত শপিং মল (কারফুর, জায়ান্ট)। কারফুরে মাছের দাম কাঁচা বাজারের তুলনায় ২-৪গুণ। এমনিতে জাকার্তা খুব এক্সপেনসিভ জায়গা, একবার কারফুরে বাজার কররেই ৪০-৫০ ডলার নেমে যায়। এখানে সবই পাওয়া যায় কিন্তু তার মূল্য আছে - অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপের চেয়ে বেশী লাগল। রাস্তায় দেখা যায় মার্সিডিজ, বিএমডাব্লু। আবার এই দেশেই ১০০ ডলারে কাজের লোক পাওয়া যায়। ঠিক আমাদের দেশের মত। তারা কিভাবে এই শহরে বেঁচে থাকে জানার ইচ্ছে খুব।

সেদিন বৃষ্টি হলো। ঘন্টাখানেকের বৃষ্টিতেই শহরের কিছু অংশের রাস্তায় দেখা গেল একফুট পানি। জানা গেল নালা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে এই অবস্থা। সরকার ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে - কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

এদেশের তরুণদের মধ্যে ব্যান্ডপ্রীতি প্রচুর। সেদিন গেলাম আনচোল বীচে। সেখানে দেখি ব্যান্ড সংগীত হবে তাই নিয়ে লোকজনের উৎসাহের কমতি নেই। টিভিতে একেকজন শিল্পীর পোষাক দেখি আর মেলাই আমাদের পরিচিত শিল্পীর সাথে -এই যে জেমসের মতো চুল, আবার ওড়না পরেছে; এর গলার স্বরে হাসানের মত টান , আবার চুলও লম্বা।
আনচোল বীচ 
আনচোল বীচ

এই কদিনে আমাদের বিনোদন ছিল ইন্দোনেশিয়ার ভাষার চ্যানেলের টিভি দেখা। এদের কিছু জটিল সোপ আছে - যাতে ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর মত প্যাচ। কিছু সিরিয়ালের মূল লেখকও নাকি ভারতীয়। এখানে বেশীরভাগ সিরিয়ালেই মেয়েরা হয় ভিলেইন আর পুরুষরা হয় গোবেচারা টাইপের। পরে জানলাম আসলেই অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েশাষিত সমাজ এখানে।

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম এশিয়ার সর্ববৃহত মসজিদ - বিশাল পাঁচ তলা কম্পলেক্স এবং সামনে ঈদগাহের বিশাল খোলা মাঠ। তার অতি নিকটেই একটি ক্যাথেড্রাল। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ মুসলিম দেশে ধর্মীয় পোষাক কিন্তু দেখেছি কম। গরম বলে রাস্তা ঘাটে মেয়েরা পরে টি শার্ট এবং স্কার্ট বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, বিশেষ করে গৃহপরিচারিকারা। ছেলেরা সাধারণ শার্ট, প্যান্ট। কিছু ধনী মহিলাদের মাথায় হিজাব পড়তে দেখেছি, তবে তাদের অনেকেই ড্রাইভ করে। এটি মুসলিম দেশ বোঝানোর জন্যে আজান শোনা যায় পাড়ায় পাড়ায়। আমাদের দেশের মতই নামাজীর সংখ্যাও বেশী আর ঘুষখোরের সংখ্যাও।

এতসব মিলেই জাকার্তাকে আমার ঢাকার খুব কাছাকাছি লেগেছে। হয়ত ঢাকা আগামী পাঁচ কিংবা দশ বছরে এখানে পৌছাবে। দেশের অনেক কিছুই যেহেতু আমরা সহ্য করে নেই তাই মনে হচ্ছে এখানে থাকাও বেশ ইন্টারেস্টিং হবে।
জাকার্তার কিছু ছবি ফ্লিকারে -

× পোস্টকার্ডের জাকার্তা
× মেক আপ ছাড়া একই শহর
× ট্রেন যাত্রা
× বৃষ্টিবরণ

পোস্টের টাইটেলের জন্যে কৃতজ্ঞতা: হিমু

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

2 comments:

Unknown said...

আমাদের সাইটটি আপনারদের এই সাইটের "বাংলায় সংবাদ ও বিষয়ভিত্তিক সাইট" বিভাগে যোগ করে নিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
http://www.bdfish.info

MYSTERIES UNSOLVED said...
This comment has been removed by a blog administrator.