Monday, July 13, 2009

স্টে ওকে এবং স্পীড জিকিং


(পূর্ববর্তী পর্বগুলো , )

'স্টে ওকে' হচ্ছে আমস্টার্ডামে আমাদের থাকার জায়গার নাম। বিকেলে ট্রেন থেকে সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে ট্রামে করে ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম এটি একটি ব্যাগপ্যাকার্স হোটেল। এটি অনেকটা ইয়থ হোস্টেলের মত তবে এখানে পুরুষ- নারী, যুবা ও বয়স্করা সবাই থাকতে পারে। কনফারেন্স এর লজিস্টিক্স এর দায়িত্বে রয়েছে আমেরিকান বিশালদেহী মাইক যার মুখে একটি চিরন্তন হাসি ঝুলে আছে, খুবই মাইডিয়ার টাইপের। তার কাছ থেকে (ইলেক্ট্রনিক) চাবি বুঝে নেবার সময় আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বলল পড়। পড়ে দেখলাম একগাদা নিয়মকানুন। সে বলল, কিছু মনে করো না, এরা বড্ড কড়া। দয়া করে এগুলো মেনো না হলে ফাইন ২৫০ ইউরো। নিয়মগুলোর মধ্যে ছিল কোন রকম খাওয়াদাওয়া, ধুমপান, মদ্যপান, মাদক নেয়া ইত্যাদি করা যাবে না। আমি হেসে বললাম এমন ভাবে লিখেছে যেন মাদক ছেলে হাতের মোয়া। সে বলল জানো না এখানে হাশিস পাওয়া যায় কফি শপে; তাই বলে এখনই আবার তুমি কফি শপের উদ্দেশ্যে রওনা দিও না। ডিনার খেয়ে বের হয়ো।

আমার রুমে তিনটি বান্কার বেড, সাকুল্যে ছয়জন থাকা যায়। আমি নীচের এক বেড বেছে তার নীচে উঁকি দিলাম দেখি আরেকটি বেড রয়েছে বিছানা পাতার জন্যে। তার মানে কোন কিছুই চুড়ান্ত এমন ধারণা করা যাবে না। একটি টয়লেট, আলাদা বেসিন ও শাওয়ারের রুম। এক কোনায় স্যুটকেস রেখে ল্যাপটপের ব্যাগ সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমাদের ডিনারের সময় দেয়া হলো বিকেল ৬:৩০ এ। হোস্টেলের কিচেনের পাশে ডাইনিং এ লাইন দিলাম। বেশ মজাই লাগছিল, পাশের হট্টগোল করা ভেনেজুয়েলার একদল টিনএজারদের মত যেন বয়স অনেক কমে গেছে। আসলে পরিবেশ আমাদের চিন্তা চেতনার উপর ভালই প্রভাব রাখে।

সূর্য ডুবতে অনেক দেরী তাই নেপালের বসন্তের সাথে বেরিয়ে পরলাম খাওয়ার পরে। সে চালু ছেলে, রায়ান এয়ারের কিছু সস্তা প্লেন টিকেট কিনে ইউরোপ ভ্রমণের ব্যবস্থা পাকা করেছে। শুধু আমস্টারডাম-বার্লিনের টিকেট পায়নি। আমি ট্রেনে এসেছি শুনে ঠিক হলো তাকে বার্লিনের ট্রেনের টিকেট কিনে দিয়ে একটু বেড়াতে বের হব আমরা।

সেন্ট্রাল স্টেশনে যাওয়ার পর ট্রেনের টিকেট পাওয়া গেল। এরপর একটু ঘোরাঘুরি করে দাম স্কোয়্যারে আসলাম। বসন্ত সকালে এসেছে বলে ইতিমধ্যে একটি গাইডেড টুর দিয়ে ফেলেছে এই সব অঞ্চলে। সেখানে রাণীর প্রাসাদ দেখার পর হাটতে হাটতে বসন্ত আমাকে বলল আমার সাথে চল একটি জিনিষ দেখাব। আমি বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সে আমাকে নামকরা টুরিস্ট এট্রাকশন রেড লাইট এরিয়ার দিকে নিয়ে গেল। আমি তাকে বললাম তুমি এই যায়গা কেমনে চিনলা? সে বলে এতো গাইডেড ট্যুরের অংশ ছিল। সে আরও এলাকার ইতিহাস বলতে লাগল -দশ বছর আগে থেকে এখনকার কাচের বুথের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিকিনি পরা কড়া মেকাপসহ পতিতাদের কাচের দেয়ালের ভেতর থেকে শরীর প্রদর্শন আমার কাছে মোটেই রুচিকর কিছু মনে হলনা। আমি দেখতে লাগলাম মানুষকে, কারন খালের দুধারের সরু রাস্তায় পুরো গিজ গিজ করছে ট্যুরিস্ট। টিন এজার থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়ি সবাই অবাক বিষ্ময়ে হেটে হেটে দেখছে। এ যেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য, আর তার উইন্ডো শপিং। ক্যানেলে স্পেশাল বোট রাইড - রেড লাইট ট্যুর। হল্যান্ডের সেরা ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ।

পরের দিন কনফারেন্সে আলাপ হলো মধ্যবয়সী ডাচ অ্যাক্টিভিস্ট পেট্রার সাথে যিনি পতিতাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। তার ল্যাপটপে স্টীকার লাগানো 'হোরস রক' এবং এ নিয়ে ভারতে এক কনফারেন্সে তাকে কি রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে সে নিয়েও গল্প করলেন তিনি। তার বক্তব্য হচ্ছে এই রেড লাইট এরিয়ার জন্যে আমস্টারডামে অনেক ট্যুরিস্ট আসে তাই তাদের রক্ষার জন্যে আরও সুযোগ সুবিধা দিতে হবে সরকারকে। সেখানে নাপিত দেয় ৬% ভ্যাট (নিত্য প্রয়োজনীয়) আর পতিতারা দেয় ‌১৯% (লাক্সারী) ভ্যাট। কাজেই এই হার কমাতে হবে। আমি ভাবলাম কোথায় এসে পরলাম বাবা!

ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯

অবশেষে কনফারেন্স শুরু হলো। মডারেটর অ্যালেন গান (ডাক নাম গানার) বেশ মজার মানুষ। প্রথমে ছিল প্রায় ৭০ জন লোকের পরিচয়পর্ব। নাম ও ধামের সাথে তিনি জুড়ে দিলেন 'আজ আপনি কেমন বোধ করছেন' প্রশ্নটি। বেশ মজার মজার উত্তর বেড়িয়ে আসল এবং জড়তা ভাঙ্গল অনেকের। এর পরে ছিল ওপিনিয়ন স্পেক্টোগ্রাম - একটি খালি জায়গায় কাল্পনিক বিভক্তি ধরে দুটি বিপরীত মতামতের ক্ষেত্রে কার কি অবস্থান (দুই প্রান্তে, না মাঝামাঝি) তা বের করা হলো। সেগুলো ছবিতে তুলে রাখা হলো রেকর্ডের জন্যে। এরপর গানার গিয়ে কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে বা তারা তাদের অবস্থান নিয়েছে।

বর্তমান অনেক কনফারেন্সেই যেভাবে এজেন্ডা তৈরি করা হয়, সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো এখানেও। সবাই স্টিকি নোটে কি জানতে চায় ও জানাতে চায় তা লেখা শুরু করল। তারপর সবগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করা হলো। উইকিতে তোলার পর সেগুলো এরকম দাড়ালো

এই বিষয়গুলো নিয়েই কনফারেন্সের এজেন্ডাকে ঢেলে সাজানো হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে মূলত: দুটি ভাবে কার্যক্রম সাজানো হয়েছিল। ৮-১০টি বিষয় বাছা হতো একেক সেশনে এবং ইচ্ছে অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় যোগ দেয়ার সুযোগ ছিল। ফলে সবাই তার সবচেয়ে আগ্রহের আলোচনায় যোগ দিয়েছে এবং আরও আলোচনায় যোগ না দিতে পারায় আক্ষেপ করেছে। ফলে অন্যান্য কনফারেন্সের মত নিজের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক বা বোরিং জিনিষ শুনতে হয়নি। শুধু শেষে সব কটি আলোচনার সামারী একেকটি দল পড়ে শুনিয়েছে যাতে অন্যেরা বুঝতে পারে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।


আরেকটি মজার জিনিষ ছিল - স্পিড-জিকিং - অনেকটা স্পিড ডেটিংয়ের মত। দৈবচয়নের মাধ্যমে নাম্বার দিয়ে পুরো গ্রুপকে ৮টি আলাদা দলে ভাগ করা হল। আটজন জিক (বা প্রযুক্তিবিদ) তাদের কোম্পানী বা কার্যক্রম সম্পর্কে বর্ণনা করতে লাগল ৪ মিনিটের মধ্যে এককটি গ্রুপের কাছে। ৪ মিনিট শেষ হতেই এক টেবিল থেকে আরেকট টেবিলে চলে গেল দলটি। এতে সুবিধা হলো কারও কোন কিছু শুনতে পছন্দ না হলে সেই টেবিল থেকে সরে গেলেই হলো বা ৪ মিনিটের বেশী বোরড হওয়া লাগল না। এভাবেই সারা দিন শেষেও সবাই ছিল পুরোপুরি ইনভল্ভড।

কনফারেন্সের আলোচনার যে অংশগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা নিয়ে আলাপ করব পরবর্তী পর্বে।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

No comments: