আমস্টার্ডামের পথে
সকালে রওনা হয়েছি বার্লিন হপ্টবানহফের (প্রধান রেল স্টেশন) দিকে। গাড়ীতে যাব তাই সেইভাবে সময় হিসেব করেই বেরিয়েছি। কিন্তু পথিমধ্যে দেখলাম শার্লোটেনবার্গের চারিদিকে ব্যারিকেড দিয়ে অনেক রাস্তা বন্ধ, একটি সাইকেলের রেস হবে। পুলিশকে অনুরোধ করলাম সাইকেলের বহর আসতে তো মনে হয় সময় লাগবে, মোড়ের পথটুকু ছেড়ে দিলেই আমি গন্তব্যস্থলে যেতে পারি, নতুবা আমি ট্রেন মিস করব। কিন্তু বুঝলাম বৃথা চেষ্টা, রোবটের মত নিয়মের বাইরে আর কোন কিছু বিবেচনা করাটা তাদের রক্তে নেই। আমাকে বলে কিনা এটি তো আমরা আগেই জানিয়েছি তুমি দেখোনি তাই তোমার দোষ। গাড়ীতে ঘুরে যেতে অনেক সময় লাগবে, আর কোথায় কোথায় রাস্তা বন্ধ আছে তাও জানা নেই। কি করে দ্রুত স্টেশনে পৌছানো যায় তাই ভাবছি। হঠাৎ করে মনে হলো সিটি ট্রেন (এস বান) তো আর আটকাতে পারবেনা। তাই দ্রুত নিকটস্থ এস বান স্টেশনে গিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত হপ্টবানহফে সময় মত পৌঁছুতে পারলাম।
আমস্টারডাম এর আগেও গিয়েছি, তবে স্বল্প সময়ের জন্যে। এবারের যাত্রাটি ভিন্ন -ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস ২০০৯ কনফারেন্সে যোগদান করতে যাচ্ছি। সাথে গ্লোবাল ভয়েসেসের কিছু বন্ধুরও দেখা হবে ভেবেই পুলকিত হচ্ছি।
ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের দুটি ট্রেন একসাথে লাগানো। কাধে হাত দিয়ে ঝমাঝম করে গিয়ে মাঝপথে দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। না রুপকটা ঠিক হলো না। ঝমাঝম করবে কি, ট্রেনের লাইনে কোন কাটা নেই কাজেই ঝমাঝম বা ঝক্করঝক বলুন কোন শব্দই হয় না। এত বোরিং!!
স্টেশনের প্লাটফর্মের নোটিশ বোর্ডে ট্রেনের একটি ড্রয়িং আছে যেখান থেকে বোঝায় কোন বগী প্লাটফর্মের কোন জোনে থামবে। সেটি আগে থেকে দেখে রাখায় সঠিক ট্রেনে ও সঠিক বগীতেই উঠলাম। সাধারণত: ট্রেন থামে দুই মিনিটের জন্যে কাজেই ভুল হবার অবকাশ নেই। আইসিইতে ভ্রমণের একটি আরাম আছে, অনেক লেগ স্পেস, বিমানের চেয়েও আরামদায়ক সীট, কয়েক চ্যানেলে গান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, মোবাইল জোন আর চলে সর্বোচ্চ ২৫০ মাইল গতিতে। আমার বুকিং নির্দেশ করা জানালার পাশের সীটে বসলাম। কামরায় অনেক সিট বুকিং না করা যাত্রীও আছে তারা ফাঁকা সীটে বসতে পারে। তবে আমার পাশের সীট ফাঁকা রইল অনেকক্ষণ। আমি এটি মাঝে মাঝে খুব এনজয় করি। আমি এক কালো ভিনদেশী বলে মাঝে মধ্যে কিছু শেতাঙ্গ আমাকে সম্মান করে পাশের সীট ছেড়ে দিয়ে দুরে কোথাও বসে। এই বাড়তি স্পেসটুকুর সুযোগ মুফতে কোথায় পাওয়া যায় বলুন!
আমি পাসকাল মার্সিয়েরের বেস্টসেলার বই নাইট ট্রেন টু লিসাবন খুলে বসলাম, তবে কতক্ষণ পড়েই হোঁচট খেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কেন পড়া দ্রুত আগাচ্ছে না। আসলে এটি বার্বারা হারসভ কর্তৃক মূল জার্মান থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ। ভাবতে লাগলাম অনুবাদক কি ইচ্ছে করেই কিছু অংশ দুর্বোধ্য করেছেন না মূল সংস্করণের দিকে বেশী নজর রেখেছেন লেখার মসৃণতার দিকে খেয়াল না রেখে। এ বিষয় নিয়েও আলাপ হবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সে।
এবার কানে হেডফোন দিয়ে সঙ্গীতে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ করে মনোযোগে ছেদ হলো। হানোভার থেকে উঠা এক তরুণী আমার পাশে এসে বসল। তার স্যুটকেসটি পায়ের সামনে রাখলো, তাই লেগস্পেস অনেক কমে যাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আমি ইংরেজীতে বললাম যে মাথার উপরে স্যুটকেসটি রাখতে পারেন। সে বলল আমি তো তুলতে পারব না এটা। আমি বললাম নো প্রবলেম আমি তুলে দিচ্ছি। এরপর আবার সঙ্গীতে ডুবে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম কোন দেশী হতে পারে মেয়েটি। টার্কিশ? নাকী ভারতীয় উপমহাদেশের? একসময় আলাপ হলো মেয়েটির সাথে। নিউ দিল্লী থেকে এসেছে ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটে ভাইভা দিতে। মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স করেছে, এখন পিএইচডি করার ইচ্ছা। জিজ্ঞেস করলাম যে ভাইভা দিতে এতদুর এসেছে কেন। বলল যে শর্ট লিস্টে থাকা অ্যাপ্লিকান্টদের আসা যাওয়া থাকার খরচ ম্যাক্স প্লান্ক ইন্সটিটিউটই দিচ্ছে চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত হোক বা না হোক। ভাল ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে তাদের এই পরিমাণ উদ্যোগ দেখে অবাক হওয়ারই কথা। ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্টে সে নামবে দিল্লির প্লেন ধরবে তাই। আমি নেমে গেলাম ডুইসবুর্গে, ট্রেন চেন্জ করতে। আধা ঘন্টা সময় ছিল তার মধ্যেই পিজ্জা দিয়ে লান্চ সাড়া হলো।
এর পরে আবার যাত্রা শুরু হলো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম কখন বর্ডার পার হব সেটি খেয়াল করার জন্যে। নাহ, এবারও ব্যর্থ হলাম। কখন নেদারল্যান্ডে ঢুকে গিয়েছি টের পাইনি। একটি শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার সাইন দেখে টের পেলাম। শেনঘেন চুক্তির আওতায় যে সমস্ত ইউরোপীয় দেশ আছে তাদের বিপুল পরিমান কর্মঘন্টা প্রতিদিন বেচে যায় এই ভিসা/ইমিগ্রেশন উঠিয়ে দেবার কারনে। আর লোকজনেরও কত আরাম! অথচ ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে কি হ্যাপা পোহাতে হয় আর কত ঘন্টা নষ্ট হয় ভিসি/ইমিগ্রেশনের কারনে সেটা ভাবলে কষ্ট হয়।
ওপেন ট্রান্সলেশন:
এই বিষয়ে বলতে গেলে ওপেন সোর্স আন্দোলনের কথা বলতে হয়। এটি আসলে ব্যাপক আলোচনার বিষয়, আমি শুধু সংক্ষেপে বলব। এখানে ওপেন মানে হচ্ছে রয়্যাল্টি বিহীন এবং সোর্স মানে হচ্ছে সোর্স কোড, অর্থাৎ যেই সোর্স কোড সবাই অ্যাক্সেস করতে পারে। এই টার্মটি প্রথম অফিশিয়ালি ব্যবহার করা হয় ১৯৯৮ সালে আয়োজিত "ফ্রিওয়্যার সামিটে"। পরবর্তীতে এই সামিটের নামকরণ করা হয় ওপেন সোর্স সামিট। সে বছরই ওপেন সোর্স ইনিশিয়েটিভ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে যা বিশ্বব্যাপী ওপেন সোর্স আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাজ শুরু করে।
এসপায়ারেশনটেক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি এনজিও যারা বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার তৈরী, কমিউনিটি এবং নেটওয়ার্কিং সুবিধা দেয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচী আয়োজন করে। তারা এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫টি বিভিন্ন ইভেন্টের আয়েোজন করেছে নানা ডোনরের সহযোগীতায়। তাদের আরেকটি সাফল্য বিভিন্ন এনজিওর জন্যে ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার টুলসের একটি পোর্টাল তৈরী করা যার নাম সোশ্যাল সোর্সেস কমন্স।
২০০৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার জাগরেবে তারা প্রথম ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কনফারেন্সের আয়োজন করে। সেখানে ওপেন সোর্স ট্রান্সলেশন টুলস এবং ওপেন কন্টেন্ট অনুবাদের ব্যাপারটি নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়।
আসলে ট্রান্সলেশন বা অনুবাদ সারা বিশ্বে একটি বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। অনুবাদের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে এবং এর জন্যে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়। উদাহরণস্বরুপ ইইউর প্রতিটি কার্যাবলী বা স্টেটমেন্ট যা প্রকাশিত হয় তা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর ২৫টিরও বেশী সদস্যদেশের ভাষায় অনুদিত হতে হয়। মার্কিন সরকারের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষা (আরবী, ফার্সী) ইত্যাদিতে প্রকাশিত সংবাদ, ব্লগ, ওয়েবসাইট ইত্যাদি অনুবাদ করে মনিটর করার জন্যে। এইসব সংগঠনের প্রচেষ্টা মেশিন ট্রান্সলেশন সফ্টওয়্যার তৈরী যা তাদেরকে কম খরচে অনুবাদের সুবিধা দেবে। ওপেন সোর্সেও কিছু মেশিন ট্রান্সলেশন সুবিধা আছে যেমন গুগল ট্রান্সলেট। কিন্তু কোন মেশিন ট্রান্সলেশনই এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে নি। ভাল অনুবাদের জন্যে মানুষের দ্বারা অনুবাদের বিকল্প নেই। কিন্ত পেশাজীবি অনুবাদকের দ্বারা সেই কাজ করতে অনেক খরচ।
ওদিকে পাশাপাশি আরেক ধরনের কমিউনিটি বেইজড অনুবাদ আন্দোলন কিন্তু আমাদের অগোচরে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক সফ্টওয়্যার এখন বাংলাতে পাই। যেমন ওপেন অফিস, গুগল, ওয়ার্ডপ্রেস। এইসব লোকালাইজেশন কিন্তু সম্ভব হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি ট্রান্সলেশন দ্বারা। অনেকেই অনুবাদ করে নিজের চর্চার জন্যে বা শখের বসে। এতে টাকা পাওয়া যায়না বটে, কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়া যায় এবং হয়ত নানামুখী অনেক সুযোগ গুগল ইন ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ সেরকম একটি বড় প্রকল্প। সে তো হলো সফ্টওয়্যার। স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি দ্বারা কন্টেন্ট অনুবাদের কয়েকটি উদাহরন হলো ডটসাব (বিভিন্ন ভাষায় ভিডিও সাবটাইটেল করা), গ্লোবাল ভয়েসেস লিঙ্গুয়া প্রকল্প (ব্লগ কন্টেন্ট বিশটির মত ভাষায় অনুবাদ), টেড ওপেন ট্রান্সলেশন প্রকল্প ইত্যাদি। এসবই ওপেন ট্রান্সলেশনের উদাহরণ।
(আগামী পর্বে থাকবে ওপেন ট্রান্সলেশন টুলস কন্ফারেন্স ২০০৯ এবং আমস্টার্ডামের গল্প)
প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন
No comments:
Post a Comment