মদিরার দেশ চিলি
দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে আমার ধারণা কম থাকায় চিলিতে এসে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। প্রথমত: ভেবেছিলাম যে এখানে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের পাশাপাশি নেটিভ বা আদিবাসীদের দেখা পাব (যেমন বলিভিয়ায় আদিবাসী ৬০%)। কিন্তু দেখলাম যে বেশীর ভাগ মানুষই আর্য এবং কিছু আদিবাসীদের শংকর দেখা যায়। আর্জেন্টিনার পাশাপাশি চিলি এমন এক দক্ষিণ আমেরিকার দেশ যেখানে ১৬শ শতাব্দী থেকে আসতে শুরু করা ইউরোপীয় অভিবাসীরা (আইরিশ, স্কটিশ, জার্মান, স্প্যানিশ ইত্যাদি) ইনকা আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে দিয়েছে। মূল আদিবাসীদের দেখতে গেলে নাকি উত্তর বা দক্ষিণ কোনে রিজার্ভে যেতে হবে। চিলির কেউ কেউ তার পূর্বপুরুষ স্প্যানিয়ার্ড বা জার্মান বলে বড়াই করে আলাপের মধ্যে। অবকাঠামোর দিক দিয়ে চিলি যে কোন ইউরোপীয় শহরের মতই এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। ওদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ বলিভিয়া বা পেরু এখনও পিছিয়ে আছে। বলিভিয়ার বন্ধু এডিকে তাদের দেশের সাথে পার্থক্য কি জিজ্ঞেস করতে সে বলল চিলি তো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড।
পাবলো নেরুদা, সালভাদর আলেন্দে, পিনোশের দেশ চিলি। সেখানে যেতে ২০০০০ কি.মি. এর বেশী ভ্রমণ করতে হল প্রায় দুদিন ধরে। ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমে দুবাই। তারপর লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার উপর দিয়ে উড়ে পার হতে হল অতলান্তিক মহাসাগর। বিমান নামল ব্রাজিলের রিও দি জেনেইরোর উপর দিয়ে গিয়ে সাও পাওলো শহরে। সেখান থেকে ল্যাটিন আমেরিকার বিমান ল্যান বয়ে নিয়ে গেল চিলির সান্টিয়াগো।
আমরা রওনা হয়েছি একটি মদিরা বাগান পর্যটনে। চিলির মদ বিশ্বখ্যাত এবং তাদের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস (বিশ্বের পঞ্চম মদ রপ্তানিকারী দেশ)। রাজধানী সান্তিয়াগো শহর থেকে ৩৪ কি.মি. দুরে মাইপো উপত্যকা চিলির অন্যতম আঙ্গুর বাগান ও মদিরা প্রস্তুতকারী অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। আমাদের গাইড ফ্রান্সেসকা - ছোটখাট গড়নের স্বর্ণকেশী - প্রথমেই জেনে নিল আমাদের নামধাম – আমরা কোন ধরনের পানীয় পছন্দ করি ইত্যাদি। সান্তিয়াগোতে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ মলের ট্যুর অফিস প্রাঙ্গণ থেকে বাস চলা শুরু করলে নিরলসভাবে সে ইংরেজী ও স্প্যানিশ উভয় ভাষায় বলে গেল চিলির মদের ইন্ডাষ্ট্রির ইতিহাস।
১৬শ শতাব্দীর আগে দেশটিতে মদ উৎপাদিত হত না। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকরা প্রথম আঙ্গুরের বীজ নিয়ে আসে। তখন ধনীরা বাসার বাগানে আঙ্গুরের গাছ লাগাত। ১৮ শতাব্দীর দিকে ফরাসী মদের প্রকারভেদ – যেমন কাবার্নে সভিনিওঁ এবং মার্লট এদেশে প্রস্তুত হওয়া শুরু করে। এই শতাব্দীতেই সারা বিশ্বজুড়ে আঙ্গুরের ফলনে একটি মড়ক লাগে এবং মদের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। সেটি কিন্তু চিলিকে স্পর্শ করে না। ফলে চিলির মদের চাহিদা সারা বিশ্বে বেড়ে যায়। চিলি সেই মড়ক থেকে কিভাবে বাঁচল সে নিয়ে ফ্রান্সেসকা একটি লম্বা গল্প বলল।
দেশটির দৈর্ঘ ৪২০০ কি.মি. কিন্তু প্রস্থ খুবই কম – - গড়ে মাত্র ১৫০ কি.মি.। এত বিশাল দেশে বৈচিত্রও কম না। উত্তরে আতাকামা মরুভূমি, পূর্বে বলিভিয়ার সীমানা ঘেষে আন্দেজ পর্বতমালা, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, ও দক্ষিণে হিমবাহ দেশটিকে ঘিরে রেখেছে। ফ্রান্সেসকার ভাষায় চারিদিকে এই সুরক্ষা বলয়ই চিলিকে বাঁচিয়েছে। এছাড়াও ভাল মদ উৎপাদনের জন্যে তিনটি বিষয় দরকার হয়। মাটি, আবহাওয়া ও ভাল জাতের আঙ্গুরের ফলন। প্রকৃতি এদেশকে এই উপাদানগুলো উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে।
তারপর সে গল্প করল কার্মিনেরে মদের কথা যা একটি বিশেষ আঙ্গুর দিয়ে তৈরি হয়। একমাত্র চিলিতেই এই মদের সেরা সংস্করণ (১০০% খাঁটি) উৎপন্ন হয়। তার কাছ থেকে জানলাম মদের প্রকারভেদ সম্পর্কে এবং ফার্মেন্টেশন ও ডিস্টিলেশন পদ্ধতি সম্পর্কে। লাল আর সাদা মদের পার্থক্য, কোন ধরণের আঙ্গুর দিয়ে সেগুলো তৈরি হয়, বিভিন্ন স্বাদ – ড্রাই, সেমি ড্রাই, মিষ্টি, টক ইত্যাদি কিভাবে বানানো হয়...
চিলির উত্তরের দিকে একটি বিশেষ মদ তৈরি হয় যার নাম পিসকো। পিসকো সাওয়ার বা টক পিসকো ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে তৈরি হয় (যেমন হুইস্কি) এবং এতে লেবুর রস মেশানো হয়। এই পানীয়টি অনেকটা ককটেলের মত সুস্বাদু কিন্তু খুব কড়া। এই মদের উৎপত্তি নিয়ে পেরুর সাথে তাদের মতভেদ আছে।
আরেকটি ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি যে দক্ষিণ আমেরিকার লোকজন কোকা কোলা জাতীয় কোমল পানীয় খুব পান করে। এবং মদের সাথে কোক মিশিয়ে সেই পানীয়র নতুন নামকরণ করা হয়। যেমন পিসকো আর কোলা - পিসকোলা অথবা রণ (এক ধরণের মদ) এবং কোলা - রনকোলা।
সান্টিয়াগো শহরটির অদুরেই আন্দেজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা মাপুই নদী দেখলাম। নদী কি বলব, পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়ার মত। নদী থেকে জেগে ওঠা চরের মত যায়গায় দেখলাম গাড়ি পার্ক করা আছে। এবারের শীতে (এখন ওখানে শীত) অন্য সময়কার মত বৃষ্টি হচ্ছে না। বৃষ্টি আসলেই নাকি এইসব নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে।
আমাদের গন্তব্য কন্চা ই টোরো নামে একটি ভাইনইয়ার্ড যা একটি পরিবারের নাম এবং তারা এই মদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করে ১৮৮৩ সালে। এককালে এইসব পরিবারই মদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। এখন এই প্রতিষ্ঠানটি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেন্জ এ নিবন্ধিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (বিশ্বের সেরা দশটি মদ উৎপাদনকারীর মধ্যে পরে)।
সারা চিলি জুড়ে এর মোট আঙ্গুর বাগানের পরিমাণ ৮০০০ হেক্টরের ও বেশী। মাপুই উপত্যকায় কন্চা ই টোরোর ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখলাম সেখানে আরও পর্যটক রয়েছে। আমাদের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি ভিডিও দেখান হল কন্চা ই টোরোর ইতিহাস সম্পর্কে - এটিকে বেশী পরিমাণে বিজ্ঞাপনই মনে হল। তার পর বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম পরবর্তী গাইডের জন্যে। ততক্ষণে ফ্রান্সেসকার সাথে অন্যান্য বিষয়ে আলাপ হল। সে নাট্যকলার পড়াশোনা করেছে – কিন্তু আক্ষেপের সাথে জানালো এই বিষয় শিখে চাকুরী পাওয়া বেশ কঠিন। যদিও সে নাটক ভালবাসে তবুও সে আবার পর্যটন কলা শেখা শুরু করেছে - কারণ এর চাহিদা বেশ।
প্রচুর স্প্যানিশ ভাষার পর্যটকের ভিড়ে আমি এবং মরোক্কোর হিশাম এর জন্যে এরপর আসল পরবর্তী ইংরেজী ভাষার গাইড মাক্সিমিলিয়ানো। তরুণ এই গাইড ইতিহাসের গ্রাজুয়েট এবং পেশায় সাংবাদিক - একটি জনপ্রিয় দৈনিকে সে স্পোর্টস রিপোর্টার। আমরা এগোলাম সেই মালিক পরিবারটির বাগান বাড়ির দিকে। গত ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে পুরোনো এই বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে - তাই বন্ধ ছিল। মাক্সিমিলিয়ানো বলছিল - ৫ জন লোকের জন্যে ২৮টি রুম - ভেবে দেখতে পারো? সামনের উঠোনটি অনেকটা ইংরেজ স্থাপত্যের ধাঁচে করা। এর পাশেই ভাইনইয়ার্ড বা মদের ক্ষেত - ফলন তোলা হয়ে গেছে - তাই আঙ্গুর বিহীন গাছগুলো দাড়িয়ে আছে। মাক্সিমিলিয়ানো মজার মানুষ - আমাদের সম্পর্কে তার উৎসাহের কমতি নেই। আমরা জানালাম নিজের দেশ সম্পর্কে আর সে আলাপ করল চিলির ইতিহাস নিয়ে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলে (কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদি) এবং কিউবার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে যুক্তরাষ্ট্রীয় জোট তাদের বয়কট করা শুরু করে। ফলস্বরূপ বিদেশী বিনিয়োগ কমে যায় ও দেশে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ১৯৭৩ সালে পিনোশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং পরবর্তীতে স্বৈরাচার হিসেবে দেশকে শাসন করেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। তার শাসনামলে প্রচুর বিরোধী দলীয় কর্মীদের মেরে ফেলা হয়েছে - অনেকের কোন হদিস পাওয়া যায় নি।
তবে মাক্সিমিলিয়ানো বলল মজার কথা - পিনোশের আমলে অর্থনীতি মুক্ত হয়, মুদ্রাস্ফীতি কমে, যার ফল এখন চিলি ভোগ করছে। মাক্সিমিলিয়ানোর ও দেখলাম খুব গর্ব তাদের ইউরোপীয় বংশ নিয়ে - বলল যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে চিলির সুসম্পর্ক নেই। হয়ত তাদের ইউরোপীয় ঐতিহ্যই তাদের অন্যরকম করে ভাবতে সাহায্য করে।
আমাদের খেয়াল হল তখন যে আমরা মদিরা নিয়ে আলোচনা ভুলে গিয়ে এইসব আলোচনা করছি। সে এরপর আমাদের ওয়াইন সেলারে নিয়ে গেল। বিভিন্ন রুমে সারি সারি মদের ব্যারেল রাখা তাপমাত্রা, আলো ও আদ্রতা নিয়ন্ত্রিত মাটির নীচের কক্ষে। একটু পরপর পানির ছিটা দেয়া হচ্ছে ছাদে লাগানো পাইপ থেকে। জানলাম একেকটি ওক কাঠের ওয়াইন ব্যারেলের দাম ১০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয় কারণ - সেগুলোর কাঠ বিশেষ ঘ্রাণযুক্ত হয় যার প্রভাব কিছু পরিমাণে হলেও মদের উপরে পরে। প্রতিটি ব্যারেল মাত্র ৪-৫ মৌসুম ব্যবহার করা যায় - এরপর বিক্রি করা হয় স্কটল্যান্ডে - যেখানে সেগুলোতে হুইস্কি বানানো হয়। ব্যারেল কমদামি এমনকি লৌহজাতীয় পদার্থেরও হয় এবং বলাই বাহুল্য - মদ এর দামও নির্ভর করে কোন ব্যারেলে এটি রাখা হয়েছে তার উপরে।
তারপর ছিল ওয়াইন টেস্টিং পর্ব - এবং স্মৃতি হিসেবে কাচের গ্লাসটি রইল সাথে। ফেরার পথে ভাবছিলাম কিভাবে তারা তাদের মদের ইণ্ডাস্ট্রিকেও পর্যটনের অংশ করে নিয়েছে। মাক্সিমিলিয়ানো ও ফ্রান্সেসকা আমার দেখা সবচেয়ে শিক্ষিত গাইড। তাদের প্রজন্মের কঠোর পরিশ্রমই হয়ত জাতিটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
১) প্রথম ছবিটি ফ্লিকার থেকে
২) বাকি ছবিগুলো আমার এবং হিশামের তোলা।
No comments:
Post a Comment