Sunday, May 02, 2010

যোগজাকার্তার পথে পথে (২)

পূর্বের পর্ব - বড়বুদুর বৌদ্ধমন্দির

সমগ্র ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় ১৫০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার মধ্যে ১৩০টি সুপ্ত এবং প্যাসিফিক রিংস অফ ফায়ারের উপরে অবস্থিত। কাজেই যে কোন পর্যটন স্থানে অবধারিতভাবে একটি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া যায়। বড়বুদুর দেখা হয়ে গেল সকাল এগারটার মধ্যে এবং আমাদের পরবর্তী গন্তব্য প্রামবানান মন্দির। ড্রাইভার বেশ ভাল ইংরেজী বলে - সেটি এক বিস্ময় ছিল, কারন জাকার্তাতেও অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভারই ইংরেজী বলতে পারে না। তো তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে প্রামবানান যাবার পথে কি কি দেখা যায়। সেই মেরাপি পাহাড়ের আগ্নেয়গিরির কথা বলল। অত:পর আমাদের পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু হল।

২০০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট খাল২০০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট খাল

গুনুঙ মেরাপি মানে হচ্ছে আগুনের পাহাড় - নামকরণ এমন কেন হয়েছে বুঝতেই পারছেন। ১৫৪৮ সাল থেকে এটি নিয়মিত লাভা উদগিরণ করে আসছে। স্থানীয় জাভানীজরা পাহাড়কে শান্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের পুজো/ভেট দিয়ে থাকে সুলতানের রাজত্ব গ্রহণের বার্ষিকীতে। বছরে প্রায় ৩০০ দিনই এর চূড়ায় ধোঁয়া দেখা যায়। তাদের সর্বশেষ এখানে উদগিরণ হয়েছে ২০০৬ সালে যোগজাকার্তার ভূমিকম্পের পূর্বে। সে সময় ২ জন মারা গিয়েছিল। আমাদের ড্রাইভারই গাইডের কাজ করল - সে গিয়ে দেখাল পাহাড়ের কাছে একটি শেল্টার আছে - সেখানে অনেক লোক আশ্রয় নিলেও দুজন পর্যটক ছাত্র পৌঁছুতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। তবে আমাদের কপাল খারাপ। মেঘে ঢাকা চূড়ার কারনে উপরে কিছুই দেখা গেল না। মূল পাহাড়টিতে ওঠা নিষিদ্ধ - পথও নেই। আমাদের সামনে ছিল শুধু লাভা উদগিরণে তৈরি হওয়া একটি খালের মত যায়গা। এটি দেখেই দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হল। অথচ কয়েক মাস আগে বান্দুং এর কাছে তাংকুবান পেরাহু আগ্নেয়গিরিতে গিয়েছিলাম যেখানে বিশাল এক জ্বালামুখ ছিল - দেখার মত জিনিষ।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্সপ্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্স

এরপর আমরা দুপুরের খাবার সেরে প্রামবানান মন্দিরে পৌঁছালাম। এটি ত্রিমূর্তিকে (শিব, ব্রহ্মা, আর বিষ্ণু) উৎসর্গকৃত নবম শতাব্দীতে নির্মিত একটি মন্দির কমপ্লেক্স যেখানে আদিকালে ২৩৭টি মন্দিরের স্থাপনা ছিল। ইন্দোনেশিয়ার এই সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দিরকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়েছে।

২৩৭টি মন্দির স্থাপনার একটি২৩৭টি মন্দির স্থাপনার একটি

শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের প্রভাবে পদানত হিন্দু সন্জয় সাম্রাজ্য আবার ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং বড়বুদুরের জবাবে তারা প্রামবানান মন্দির তৈরি করে। এটি মাতারাম রাজ্যের রাজকীয় মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মন্দিরের অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য সেই সাম্রাজ্যের অর্থবল ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।

চান্দি মানে বাহাসায় মন্দিরচান্দি মানে বাহাসায় মন্দির

তবে ৯২৯ সালে মাতারাম সাম্রাজ্যের শেষ রাজা মপু সিন্দক সাম্রাজ্যটিকে পূর্ব জাভার দিকে সরিয়ে নেন (মেরাপি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে)। তবে সেটাই মন্দিরটির পতনের কারণ হয়ে দাড়ায় - এটি পরিত্যক্ত হয়। ১৬ শতাব্দীতে মেরাপি পাহাড়ের অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্পে মন্দিরটির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্সপ্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্স

১৮ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসনের সময় কলিন ম্যাকেন্জি নামক একজন সার্ভেয়ার মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। ১৮৮০ সালে ডাচ নৃতত্ত্ববিদদের দ্বারা খননের সময় বেশ অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি যায় মন্দির থেকে। এরপর ১৯৩০ সাল থেকে আবার এটি পুনর্নিমাণ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে প্রধান মন্দিরটি পূর্বাবস্থায় আসে।

চমৎকার সব টাওয়ারগুলো - প্রতিটি আলাদা মন্দিরচমৎকার সব টাওয়ারগুলো - প্রতিটি আলাদা মন্দির

এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে এটির উপর আরও কাজ হলেও চুরি যাওয়া পাথরের অংশগুলির অভাবে অনেক অংশেরই পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় নি।

নান্দি মোষ - শিব ঠাকুরের বাহননান্দি মোষ - শিব ঠাকুরের বাহন

মন্দিরের ভেতরে দেবতা মূর্তিমন্দিরের ভেতরে দেবতা মূর্তি

মন্দিরের চারিদিকে কারুকার্যখচিত পথমন্দিরের চারিদিকে কারুকার্যখচিত পথ

তবুও যা দেখলাম তাতে আমরা অভিভূত। ২০০৬ সালের ভূমিকম্পে এর বেশ ক্ষতি সাধন হলেও পাথরের গাঁথুনি কত মজবুত চিন্তা করেন - যে বড় কোন কাঠামোগত ক্ষতি হয় নি ২৩৭টির মধ্যে যে কয়টি চুড়া দাড়িয়ে আছে সেগুলোর।

মন্দিরের দেয়ালের কারুকার্যমন্দিরের দেয়ালের কারুকার্য

পাথরের কারুকার্যপাথরের কারুকার্য

চুড়া পর্যন্ত কারুকার্যখচিতচুড়া পর্যন্ত কারুকার্যখচিত

মাঝখানের বড় শিব মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্যে বন্ধ ছিল সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগল যে আমরা দেখতে চাই কি না। অর্থাৎ ঘুষ দিলে সেখানে যাওয়া যাবে। অন্ধকার নির্জন যায়গায় গেলে নিরাপত্তাজনিত কি সমস্যা হতে পারে চিন্তা করে আর গেলাম না।

মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ - এককালে এগুলো দাড়িয়ে ছিল।মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ - এককালে এগুলো দাড়িয়ে ছিল।

তবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেবার ব্যাপারটি ভাল লাগল না। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য।

আমরা আছি গুটি কয় দাড়িয়ে - বাকি সব ঝরে গেছে।আমরা আছি গুটি কয় দাড়িয়ে - বাকি সব ঝরে গেছে।

কমপ্লেক্সের অনেক যায়গা জুড়ে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ, সেগুলো হয়ত কোনদিন পশ্চিমা অর্থসাহায্যে মাথা তুলে দাড়াবে দুর্নীতিগ্রস্তদের উদর পুরে বা হয়ত এভাবেই থাকবে। তবে বিদেশীদের কাছ থেকে টিকেট নেয়া হয় জনপ্রতি ১৩ ডলার করে - যে পরিমাণ অর্থ আসে সেটা দিয়ে নিশ্চয়ই রক্ষণাবেক্ষণ ভালভাবেই করার কথা।

যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সাযোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সা

এর পরদিন আমরা যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সায় চড়ে তামান সারি ওয়াটার ক্যাসল দেখতে গেলাম। এটি রাজপ্রাসাদ বা ক্রাতোন এর দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। ১৮ শতাব্দীতে সুলতানের জন্যে তৈরি এই স্থাপনাটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি বিশ্রামাগার, একটি অস্ত্রাগার, লুকানোর জায়গা ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে এর মধ্যে একটি ঝর্ণার জলে পূর্ণ পুকুর আছে যাকে সুলতান তার স্নানঘর বা হারেম হিসেবে ব্যবহার করত। মূল কম্পাউন্ডে অনেক সঙ্গীতশিল্পী সুর তুলত এবং নর্তকীরা নাচত। এরপর তারা বড় পুকুরে স্নান করে তাদের বিশ্রামাগারে চলে যেত এবং রাজা সেখান থেকে তার রাতের সঙ্গিনীদেরকে পছন্দ করতেন। এরপর তারা একটি ছোট পুকুরে সুলতানকে গোসল করাত এবং সেখানে বিশ্রামাগারে রাজার শয্যসঙ্গিনী হত।

মূল কম্পাউন্ডের বাইরে এই এলাকাটিতে এখন সুলতানদের চাকরবাকরদের পরিবারদের বিশাল একটি সমাজ থাকে। তারা বিভিন্ন বাটিকের কাপড় তৈরি করে ও পর্যটকদের কাছে বেচে।

যোগজাকার্তা হস্তশিল্প ও বাটিকের জিনিষপত্রের জন্যে খুব প্রসিদ্ধ। সেটি নিয়ে লিখতে গেলে আরেকটি পোস্ট হবে। তাই এখানেই শেষ করছি।

* প্রথম ছবিটি মেরাপি পাহাড়ের - উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে। বাকিগুলো আমার তোলা।

1 comment:

Lastest Mobile info said...
This comment has been removed by a blog administrator.