কাসেলে একদিন
জার্মানি ছেড়েছি আট মাস আগে। আবার হঠাৎ করেই বার্লিন যাবার সুযোগ এসে গেল গত মাসে। আইআইজের একটি কনফারেন্সে সিটিজেন মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তাদের অনুরোধ করলাম অফিশিয়াল প্রোগ্রামের সাথে আরও চারদিন যোগ করে ফিরতি ফ্লাইট রাখতে - আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ করতে চাই। তারা বলল যেহেতু সরকারী ফান্ডে ভ্রমণের খরচ মেটানো হচ্ছে তাই কিছু বাধ্যবাধকতা আছে- বাড়তি দুদিনের বেশী তারা ফ্লাইট পেছাতে পারবে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম - কারণ আমার ইচ্ছা ছিল এবার একটু সময় নিয়ে কাসেলে যাবার। মক্কার মানুষ যেমন হজ্জ্ব পায়না তেমনি আমার জার্মান প্রবাসকালে শুধু হাসিবের সাথে একবার দেখা হলেও কোন সচল সমাবেশে যোগ দেয়া হয় নি। সুমন, হিমু, ধুসর গোধুলি, তীরন্দাজ প্রমুখের সাথে দেখা করার আকাঙ্খাটি ছিল তাই প্রবল।
সেই মোতাবেক সবাইকে ইমেইল করলাম যে একসাথে হওয়া যায় কিনা। তীরন্দাজ ভাই জানালেন ইচ্ছে থাকলেও তিনি আসতে পারছেন না। ধুসর গোধুলিকে আশা করেছিলাম কিন্তু বেচারা আসতে পারল না। হিমু বলল আপনি আসেন - সব হবে। আর আমি বার্লিন পৌঁছেই অফিসিয়াল প্রোগ্রামের পাশাপাশি ব্যক্তিগত কাজগুলো সেরে নিলাম। এবারে ইচ্ছে করেই বার্লিনে পরিচিত কয়েকজনের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে, এবং দেখা না করে অবসর সময়টুকু ব্যয় করলাম কার্য সম্পাদনে ও বার্লিন শহর ঘুরে কিছু ইচ্ছাপূরণে। কাজেই কাসেল যাবার পথে সব বাধা দুর হল।
এরমধ্যে আমি মেইল দিয়েছিলাম আমার সম্ভাব্য আগমন সময় জানাতে এবং কাসেলের ঠিকানা ও সচলদের ফোন নাম্বার জানতে চেয়ে - তার কোন জবাব নেই। অনেক খুঁজে পেতে সুমনের একটি নম্বর যোগাড় করে ফোন দিলাম। উদ্বেগের কথা জানালাম যে আমার কাছে তো ঠিকানা নেই - কিভাবে যাব? সুমন বলল আপনি কোন চিন্তা করবেন না - আপনাকে নিয়ে আশা হবে স্টেশন থেকে।
অবশেষে মার্চ মাসের তৃতীয় শনিবার বার্লিন থেকে কাসেল রওনা দিলাম রিজিওনাল ট্রেনে। আগের কয়েকদিন আবহাওয়া খারাপ থাকলেও সেদিন হঠাৎ বসন্ত - তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি উঠে গেল। ফুল ও পাতা ফোটা ছাড়া বসন্তের আমেজ পরিপূর্ণ রূপে পাওয়া যায় না। তবে রোদের প্রতিফলন থাকায় ছাইরঙা ন্যাড়া ডালপালাগুলো যেন অদ্ভুত এক দ্যুতি ছড়াতে লাগল। পথে দুবার ট্রেন বদলাতে হল।
জার্মান সময়ানুবর্তিতা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এটি কম ভাড়ার রিজিওনাল ট্রেন - দ্রতগতির আইসি বা ইসি নয় তবুও কাটায় কাটায় তার আগমন ও প্রস্থান।
কাসেল মূল স্টেশনে এসে দেখি কারও খোজ নেই। আবার দিলাম ফোন সুমনকে। সে বলল - হিমুতো আপনাকে আনতে গেল - আপনি দাঁড়ান এসে যাবে। ইতোমধ্যে আমি একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী পেয়ে গেলাম - সেটা দেখে সময় কাটাতে লাগলাম। দশ মিনিটের মধ্যে হিমু এসে হাজির - ফোনে দিক নির্দেশনা হচ্ছিল - আমি মনে হয় আপনাকে দেখতে পাচ্ছি - আপনি আমার সামনেই - এমন বলে যার অবসান - আসলে তো আমাদের আগে কখনও দেখা হয় নি!
পরে হিমুর এই রোগটির কথা জানা গেল - সুমন চৌধুরী জানালেন প্রভা নামক কোথাকার কোন নারীর বিয়ের খবর প্রকাশিত হয়ে যাবার পর হিমু সব কিছুতেই লেইট। খেয়ালিপনা ও মেজাজ মর্জি মোতাবেক এই বিলম্বের মাত্রা দশ মিনিট থেকে দেড় ঘন্টা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
তবে এই বিলম্বের কারনে কিন্তু তার সৃষ্টি ক্ষমতা থেমে থাকে নি। বরঞ্চ আরও নতুন উদ্যমে তাকে বিভিন্ন কাজে লেগে থাকতে দেখা গেছে। ওই যে কথায় বলে না বেদনা সৃষ্টিকে প্রনোদনা দেয়। আমি গিয়েই হতবাক। বিখ্যাত চৌধুরীর বিরিয়ানীর জন্যে সব এন্তেজাম করা হয়েছে। হিমু সেখানে তার সৃষ্টিশীলতা যোগ করতে দুইবার দোকানে গেল বিভিন্ন মসলা আনতে।
ছিমছাম ডর্মটিতে চৌধুরীর বিখ্যাত হেঁসেলটিকে সাজাতে বললে যে কোন গৃহিনীই ফিট হয়ে পড়ে যাবেন। হাড়ি পাতিল ইতস্ততঃ ছড়ান, আধোয়া অবস্থায় কারও মিক্সার পড়ে রয়েছে, টেবিলের উপর নানা কিছু পড়ে আছে। অতিথির সম্মানে সেগুলোর একটি গতি হল।
তার পর চৌধুরী আমি হিমু - ম্যারাথন আড্ডার সাথে চলল চৌধুরীর কারিশমা। লোকে শুধু শুধু চৌধুরীর বিখ্যাত তেহারীর প্রশংসা করে না। আমার মনে হয় এই রেসিপি পাঁচ তারা হোটেলে ভাল মানাবে। আমার মত হতভাগা যে সাত দিন ধরে ভাত খায় নি তার জন্যে সেটি ছিল অমৃত (দু:খিত পেটে ক্ষুধা থাকায় ছবি তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম)। ধারণ ক্ষমতার বেশী পরিমাণই খেলাম ফলে তা আমাদের আড্ডায় বিঘ্ন ঘটাল। উদর বলছিল যে এই অমৃত ভোজের পর সুখ নিদ্রাই শ্রেয় হবে।
পরেরদিন যাবার কথা হেরকিউলিসে। কিন্তু সকাল থেকেই বৃষ্টি বাগড়া দিল -তাই ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল। হিমুর আসার কথা ১১টায় - কিন্তু সে যথারীতি দেড় ঘন্টা লেট। ইতিমধ্যে বলাই এবং বলাইনি এসে হাজির - এসেই বদ্দার সাথে রান্নাতে হাত দিল। ওদিকে আড্ডা, পিসিতে ক্রিকেট দেখা ইত্যাদি চলল।
বলাইনি হিমুর প্রথম প্রকাশিত বই 'ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প' নিয়ে এসেছিল। হিমু এর আগে বইটি ছুঁয়ে দেখেনি। তাই মুহূর্তগুলো ছিল ধরে রাখার মত। হিমুর প্রথম মন্তব্য হল ফন্টটি একটু ছোট হলেও ছাপানোটা খুব সুন্দর হয়েছে।
এর পর বলাইনি অটোগ্রাফ চাইলে সে বলল যে এটাই আমার প্রথম ও শেষ অটোগ্রাফ হবে। তাই এই অমূল্য মুহূর্তটি আবারও ধরে রাখা হলো।
আমার ফিরতি ট্রেন ছিল বিকেল চারটায়। আড্ডার ফ্লো এবং খাবারের আয়েশ ঠিক রাখতে সেটি পেছানো হল সন্ধ্যা ছটায়। এরপর আবার একপ্রস্থ জম্পেশ মধ্যাহ্ন ভোজন। এই স্মৃতিগুলো ভোলার নয়।
ফিরতি পথে ট্রেনে ভাবছিলাম - কিসের টানে কাসেলে এসেছিলাম? যেখানেই যাওয়া হয় ব্লগ সংস্লিষ্ট বন্ধুদের এখন খুঁজে ফিরি। দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে আমাদের বারোয়ারী আড্ডা এখন ভার্চুয়াল আড্ডায় রুপ নিয়েছে। কিন্তু তবুও সাক্ষাতের আকাঙ্খাটি থেকেই যায়।
এই সম্পর্কগুলো কি আবেগঘন বা সাময়িক? মতের মিল হয় বলেই প্রাথমিক যোগাযোগ। আমার উপরি প্রাপ্তি এই যে ব্লগের কারণে বেশ কিছু বন্ধুর সাথে পরিচয় হয়েছে যারা খুবই চমৎকার মানুষ এবং পাশাপাশি একেকজন বিশেষ মেধাসম্পন্ন এবং আমি প্রতিবারই তাদের সঙ্গ উপভোগ করি। আমি মনে করি এইসব সম্পর্ককে নিত্যনতুন ও কল্যাণকর উদ্যোগে কাজে লাগাতে হবে - এবং তা হচ্ছেও স্বল্প পরিসরে।
আমি সেইদিনের অপেক্ষায় থাকব যেদিন এইসব একতাকে বিশাল কোন অফলাইন উদ্যোগে কাজে লাগানো যাবে।
No comments:
Post a Comment