Sunday, March 14, 2010

বার্ধক্য



বার্ধক্য

আমার ইদানিং হয়েছে শনির দশা। পেটের ব্যামো ছিল অনেকদিন ধরেই। সময় মত খাওয়া দাওয়া করে তাকে বাগে এনেছিলাম একরকম। জানুয়ারি মাসে পরিবারের একজনকে ব্যাংকক নিয়ে যেতে হল চিকিৎসার জন্যে। তারই অনুরোধে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ঢেকি গেলার কাজটি ঠিক হয় নি এখন বুঝি। ডাক্তার একগাদা স্বাস্থ্য পরীক্ষা লিখে দিল, আল্ট্রা-সোনো, এন্ডোসকপি আর কত কি! একে একে সব যজ্ঞ সমাধা করে এন্ডোসকপির জন্যে এগুলাম। আমার ধারণা ছিল না যে এটির জন্যে রীতিমত বন্ড সই করে অনুভূতি বিলোপ ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে অজ্ঞান করে মুখের ভিতর নল ঢুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় ও পাকস্থলীর অংশ কেটে পরীক্ষার জন্যে নেয়া হয়। টেবিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চৈতন্য নাশ হল। জ্ঞান ফিরেই শুনি ডাক্তার বলছেন আমার পাকস্থলীর বৃত্তান্ত। অনেক কথাই ধরতে পারিনি - তবে বুঝলাম মারাত্মক কিছু নয় - কিঞ্চিত আলসার আছে এবং এইচ পাইলোরি নামক একটি মন্দ ব্যাক্টেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে টিস্যু স্যাম্পলে। শেষে তিনি বললেন আমার লিভারের উপর সাদা সাদা কিছু দেখা গেছে এবং তার মতামত হচ্ছে এর জন্যে লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখান দরকার। আমি চাইলে এক্ষুণি সেখানে নিয়ে যেতে পারে সে। আমার মাথা তখনও ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমি বললাম রোসো, পরে দেখাব - আমি এখন পরিবারের কাছে যেতে চাই।

আমাকে দেয়া হল দুটি অ্যান্টিবায়োটিকসহ চারটি ঔষধের কম্বিনেশনে ১০ দিনের ডোজ যা শুরু করলাম সেদিনই। জাকার্তায় ফিরতি ফ্লাইট ছিল একদিন পরে। প্লেনেই শুরু হলো ডায়রিয়া এবং ঘরে ফিরেও তা চলতে লাগল - মনে হয় ঔষধের প্রতিক্রিয়া। সে এক কলিকাল - তার দুদিন পরে আমি পুরো বিছানায়। ডায়রিয়া কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না - সাথে অরুচি, বমি, কাশি - অনেকদিন আমার এমন অসুখ হয়নি। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শে ওরস্যালাইন ইত্যাদি পথ্যে হাসপাতালে যাওয়া রোধ করা গেল আপাতত। ব্যাংককের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের উপায় পাওয়া গেল না। মনে হল অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ না করলে মারা যাব। তবে ঔষধ বন্ধ করার পরেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটল না। তারপর অবধারিতভাবে স্থানীয় হাসপাতাল, ডাক্তার - অবশেষে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটল। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হইনি এখনও - অরুচি, ওজন হ্রাস ইত্যাদি বিদ্যমান।

আমি এখন ভাবি - সামান্য এক পেটের অসুখের জন্যে আমি এতটা ভেঙ্গে পরেছিলাম। আর এই বোধটি আরও জাগ্রত হয় বাবাকে দেখার পর। বাবা এসেছিলেন জাকার্তাতে, ছেলে-বউয়ের সংসার দেখতে; নাতনীর সাথে সময় কাটাতে - যে নাতনী তার কাছে জীবনের প্রথম এক বছর ছিল। উনি তাকে কতটুকু মিস করেন তা তাদের ফোনালাপে বোঝা যায়। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর এই কয়েক বছরে বাবা-মা যেন অনেক বুড়িয়ে গেছেন। ৭২ বছর বয়সী বাবার গালে এখন সাদা দাড়ি। আমার মেয়ে গতবছর দেশে গিয়ে বলে (ছবির স্মৃতিতে) আমার না আরেকটা দাদা আছে যার দাড়ি নেই!

এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ - প্লেন আসতে দেরী করছে। অবশেষে তিনি এলেন - পড়নে স্যুট। কিন্তু একি? বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ - হাতে ভারি এক ঝোলা। সাথে ফুফাতো ভাই ছিল। বলল - শরীরটা ভাল নেই - মালয়েশিয়ায় লম্বা ট্রানজিটে কষ্ট হয়েছে অনেক। তারপরও মনের জোরে এসেছেন - হাতে ছেলের বউয়ের আবদারের বইয়ের ঝোলাটি বোনপোকে দেননি পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে ঘোষণা দিলেন দুদিন বিশ্রাম নেবেন।

এরপর তাকে ঘুরিয়ে দেখানোর আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল। নাতনী সাফারি দেখাবে বলে এতদিন প্রলোভন দেখিয়েছে। সেই সাফারিতে যেতে তার কষ্ট হল। বুড়ো বয়সে অনেক কষ্ট - টয়লেটের চাপ ধরে রাখা - বেশিক্ষণ হাঁটতে না পারা। মনে হল নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই। অথচ তার এই অক্ষমতার কথা স্বীকারও করছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন - না ঠিক আছি। ফলস্বরূপ কষ্টও পেয়েছেন।

এরপর সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া হল যোগজাকার্তা। বিমানে ওঠার আগে হুইল চেয়ারে উঠতে বলাতে তার ভয়ানক আপত্তি। তবে আমাদের পাল্লায় পড়ে তাকে সেটাতে উঠতেই হল। সেখানে হোটেলে উঠে তার জন্যে বরাদ্দ রইল বিশ্রাম। পরদিন বরবুদুর বৌদ্ধমঠ দেখতে পারলেও পারামবালান মন্দিরে ঢুকে তার শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমরা দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে এর পরদিন তাকে আবার জাকার্তা নিয়ে এলাম।

এখন চিন্তা হল তিনি কিভাবে দেশে ফেরত যাবেন। যাবার পথে মালয়েশিয়ায় কয়েকদিন স্টপওভার আছে - তার বিশাল পরিকল্পনা ছিল পেনাঙ্গ যাবেন ইত্যাদি। আমরা বললাম সেই পরিকল্পনা বাদ দিন আর টিকেট করে দিচ্ছি - দ্রুত ঢাকা চলে যান। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, সেই শরীর নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া গেলেন এবং সীমিত পর্যটনের পর এখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন। তবে এই কয়েকদিন আমাদের বেশ উদ্বিগ্ন করে রেখেছিলেন।
আমি এখনও বাবার ক্ষীণকায় শরীর, সেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ, সিঁড়িতে কষ্ট করে ওঠা ইত্যাদি ভুলতে পারিনা। অথচ এই বাবাই এই কয়েক বছর আগেও নিজেই অনেক পরিশ্রমের কাজ করতেন।

আর যখনই ভাবি এই বার্ধক্যকে জয় করার তার প্রচণ্ড মনোবলের কথা তখন নিজের ছোটখাট অসুখের জন্যে চিন্তাকে খেলো মনে হয়। আর মনে হয় আমাদের ও একসময় সেই দিন আসবে। তার জন্যে কি আমরা তৈরি?

ফ্লিকার থেকে নেয়া উপরের ছবিটি জন্যে শহরবন্দীর কাছে রইল কৃতজ্ঞতা।

1 comment:

Sumit Das said...

Bonglive.com . bengali video sharing site... bengli ranna, music, video