কপিরাইট, কপিলেফ্ট এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে কিছু মেধাস্বত্ব চৌর্যবৃত্তির ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্লগারদের আশংকার কারনে কপিরাইট সংক্রান্ত আলোচনা জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে।
ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আইন প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপটি ছিল ১২২ বছর আগে (১৮৮৬ সালে) সুইজারল্যান্ডের বের্নে ফরাসী কথাসাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর প্ররোচনায় প্রটেকশন অফ লিটেরারী এন্ড আর্টিস্টিক ওয়ার্কস ট্রিটির মাধ্যমে। এর পরে আরও এমন কপিরাইট ট্রিটি হয়েছে যেমন ইউসিসি (ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশন) জেনেভা -১৯৫২ সালে এবং প্যারিস - ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ এই তিনটি ট্রিটিতেই সই করেছে। এই ট্রিটিতে সই করার মাহাত্ম্য হচ্ছে যেসব দেশ এর আওতায় আছে তাদের জনগণের কপিরাইট আপনা-আপনি বলবৎ হবে। কোন সরকারী অফিসে গিয়ে তার নিবন্ধন করা লাগবে না।
কিন্তু সেটা গেল কপিরাইট নির্ধারন। কিন্তু যে বিধিবিধানের মাধ্যমে কপিরাইট লঙ্ঘনের প্রতিকার হবে সেটি কিন্তু সংস্লিষ্ট দেশগুলোর নিজস্ব আইন মোতাবেক হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বলবৎ আছে কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) । এই আইন অনুযায়ী ব্লগের কন্টেন্ট "কপিরাইট" এর আওতায় পরে:
এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোন কর্ম বা কর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশের বিষয়ে নিম্নবর্ণিত কোন কিছু করা বা করার ক্ষমতা অর্পণ, যথা:-(১) কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যতীত, সাহিত্য, নাট্য বা সংগীত কর্মের ক্ষেত্রে,-
(ক) যে কোন উপায়ে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কর্মটি সংরক্ষণ করাসহ যে কোন বস্তুগত আংগিকে কর্মটির পুনরুৎপাদন করা;
(খ) সার্কুলেশনে রহিয়াছে এমন অনুলিপি ব্যতিরেকে, কর্মটির অনুলিপি জনগণের জন্য ইস্যু করা;
(গ) জনসমক্ষে কর্মটি সম্পাদন করা অথবা উহা জনগণের মধ্যে প্রচার করা;
(ঘ) কর্মটির কোন অনুবাদ উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, সম্পাদন বা প্রকাশ করা;
১৫। (১) এই ধারার বিধান এবং এই আইনের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে, নিম্নলিখিত শ্রেণীর কর্মের কপিরাইট বিদ্যমান, যথা:- (ক) সাহিত্য, নাট্য, সংগীত ও শিল্পসুলভ আদি কর্ম;
২৩। (১) কোন চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য বা রেখাচিত্রের মূল কপির বা কোন সাহিত্য কর্মের মূল ৩৫[ পাণ্ডুলিপি] বা কোন নাট্য বা সংগীত কর্মের মূল অনুলিপির পুনঃবিক্রয়ের ক্ষেত্রে, অনুরূপ কর্মের প্রণেতা যদি ধারা ১৭ এর অধীন প্রথম অধিকারের মালিক বা তাহার বৈধ উত্তরাধিকারী হন, তাহা হইলে, উক্ত কর্মের কপিরাইটের স্বত্বনিয়োগ সত্ত্বেও, এই ধারার বিধান অনুসারে অনুরূপ মূল অনুলিপি বা ৩৬[ পাণ্ডুলিপির] পুনঃবিক্রয় মূল্যের অংশ পাইবার অধিকারী হইবেন:
কপিরাইটের মেয়াদ হচ্ছে ৬০ বছর এবং বেনামী বা ছদ্মনামে লেখার কপিরাইটও করা যায়। আইন বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন এটিতে কতটুকু নিরাপত্তা পাওয়া যায় মেধাসত্ব সংরক্ষণে। কারন আপাতদৃষ্টিতে এটি বেশ পোক্ত মনে হলেও আইনের ফাঁক ফোকর সবসময়ই থাকে।৮২। (১) যে ব্যক্তি, চলচ্চিত্র ব্যতিরেকে, কোন কর্মের কপিরাইট বা এই আইনের ধারা ২৩ এর অধীন অর্পিত অধিকার ব্যতীত অন্য কোন অধিকার ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তিনি অনুর্ধ্ব চার বৎসর কিন্তু অন্যুন ছয়মাস মেয়াদের কারাদণ্ড এবং অনুর্ধ্ব দুই লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যুন পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডণীয় হইবেন:
বাংলাদেশের আইনে ব্লগের কন্টেন্ট এর জন্যে কপিরাইট নিবন্ধন করতে হবে কিনা সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমি পাইনি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত জরুরী।
আমাদের একটি শংকার বিষয় যে ১৯৯৬ সালে ঘোষিত দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (উইপো) কপিরাইট ট্রিটি, যাতে ইন্টারনেট এবং আইটি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশ এখনও সই করেনি। উইপোর সাইটে কপিরাইট সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানুন।
ইন্টারনেট এবং অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে ওপেন সোর্স নামক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় কারন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন নতুন শৈল্পিক উদ্ভাবনের জন্যে বিভিন্ন মৌলিক কপিরাইট করা প্রযুক্তি বা কন্টেন্টের প্রয়োজন হয় এবং অনুমতি সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগত জটিলতা পার করে সেগুলো হস্তগত করা (যদিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেগুলো সহজলভ্য) কঠিন হয়ে যায়।
এই আন্দোলন জন্ম দেয় কপিলেফ্ট লাইসেন্সের। কপিলেফ্ট লাইসেন্সের বৈশিষ্ট হচ্ছে এতে লাইসেন্সের মালিক তার কিছু রাইট বা অধিকার উন্মুক্ত করে দেয়। তাদের কাজগুলো তারা পাবলিক ডোমেইনে (কপিরাইটবিহীন) না দিয়ে একে সীমিত ব্যবহারের অধিকার দেয়। উদাহরণস্বরুপ স্রষ্টার নাম উল্লেখপূর্বক একে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যাবে এবং অবাণিজ্যিক বা গবেষণামূলক ব্যবহার করা যাবে। যে কোন শিল্পই যেহেতু অটোমেটিক কপিরাইটেড হয় তাই কপিলেফ্ট লাইসেন্স তাদেরকে বেশী ব্যবহারউপযোগী করে এবং প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করে। উন্নীত ও জনপ্রিয় শিল্পগুলি কোন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলে অবশ্যই মূল স্রষ্টারা তাদের মূল্য পায়।
কপিলেফ্ট লাইসেন্সের কিছু জনপ্রিয় রুপ হচ্ছে সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে জিএনইউ জেনারেল পাবলিক লাইসেন্স (জিপিএল) এবং ছবি এবং ওয়েবসাইট কন্টেন্ট (ও ব্লগ) এর ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভ কমন্স (এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব পরে)।
এই লাইসেন্সগুলোর সুবিধা হচ্ছে আপনিই নির্ধারণ করতে পারবেন যে কতটুকু ছাড় দেয়া হচ্ছে। যেমন ক্রিয়েটিভ কমন্সে আপনি আপনার নিজস্ব লাইসেন্স তৈরি করতে পারবেন যেখানে বলা থাকবে অবাণিজ্যিক ব্যবহার, মডিফিকেশন ইত্যাদি করা যাবে কি না এবং কিভাবে শিল্পীর নাম উল্লেখিত থাকতে হবে।
অনেকে মনে করেন যে অধিকার ছেড়ে দেয়া মানে হচ্ছে চুরি হয়ে যাবার ভয়। আসলে মূল ব্যাপারটিই কিন্তু এই নীতির উপর তৈরি "It is always important to give credit where credit is due" (নুন খান যার গুণ গাইতেই হবে)। যতভাবেই এই কপিরাইট লাইসেন্সগুলো বিবর্তিত হোক না কেন মূল স্রষ্টা তার ক্রেডিট ঠিকই পান।
বুদাপেস্টে ক্রিয়েটিভ কমন্সের সিইও নামকরা ব্লগার জোই ইতোর একটি ছোট ওয়ার্কশপ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি বোঝালেন মানুষ কেন ইন্টারনেট কন্টেন্ট চুরি করে। ধরুন একটি ছবি ফ্লিকারে দেখে খুব পছন্দ হলো। সেটি তার ব্লগে চাই। কিন্তু ছবি তো অল রাইটস রিজার্ভ লাইসেন্সে প্রকাশ করা। সেটার সূত্র প্রকাশ করলে তাই মামলার ভয় আছে। তাই ক্রপ করে কপি-পেস্ট করে সে ব্যবহার করল। কিন্তু যদি ছবিটি ক্রিয়েটিভ কমন্স নো কমার্শিয়াল -এট্রিবিউশন এই ক্যাটেগরীতে প্রকাশিত থাকত তাহলে সহজেই সেটি ব্লগে দেয়া যেত লিন্কটি উল্লেখ করে। কারন তার ব্লগটি অবাণিজ্যিক। এতে ছবিটির প্রচার হলো ও ব্লগে ব্লগে জনপ্রিয় হল এবং পরবর্তীতে একটি পত্রিকা সেই ছবিটি প্রকাশ করল মূল ফটোগ্রাফারকে সম্মানী দিয়ে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের ফলেই তার ছবিটি জনপ্রিয় হল ও মূল্য পেল। ফলে তার মূল অধিকার কিন্তু হারালো না।
কপিরাইট বিষয়ে সুনর্দিষ্ট ব্যখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ক্রিয়েটিভ কমন্সের লাইসেন্স আমাদের ব্লগে যোগ করতে পারি। কারন এই লাইসেন্সে শর্তগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যায়। উদাহরণস্বরুপ ভারতের একটি ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের স্বরুপ দেখুন। আরেকটি সুবিধা হচ্ছে ক্রিয়েটিভ কমন্স আন্তর্জাতিকভাবে আইনি লড়াইয়ের ব্যাপারে সাহায্য করে (বিশ্বব্যাপী ওদের অনেক স্বেচ্ছাসেবী আইনজীবি আছে)।
এখন কিছু গতানুগতিক ভ্রান্তধারণাকে খন্ডানো জরুরী হয়ে পরেছে। আমার কাছে অবাক লেগেছে যে সাংবাদিক পলাশ উল্লেখ করেছে যে সরকার যেহেতু মুজিব-রোকেয়ার প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে তাই সেই কর্মের মালিক এবং যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু শিল্পকর্মের স্রষ্টা ও স্বত্ব দুটি ভিন্ন জিনিষ। আপনি ভ্যানগগের শিল্পকর্ম কোটি টাকা দিয়ে কিনে মালিক হয়ে ড্রয়িংরুমে টাঙ্গালেন। সেটি কিন্তু আপনি কখনও আপনার নামে চালাবেন না কারন ওটি ভ্যানগগেরই। কাজেই মুজিব-রোকেয়ার কাজ সরকার আবার প্রকাশ করতে পারে, ধরে নিচ্ছি বিক্রিলদ্ধ টাকাও হয়ত পুরোটাই নিতে পারে (যদিও কপিরাইট আইন অন্যরকম বলে) কিন্তু লেখক হিসেবে নাম মুজিব-রোকেয়ারই থাকতে হবে। এটিই হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টী নীতির মৌলিক ব্যাপার।
আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো ইন্টারনেট থেকে পাওয়া কন্টেন্ট এর সূত্র প্রকাশ করতে চায়না কারন একটাই, আইন অনুযায়ী তাদের বাণিজ্যিক ব্যবহার করতে স্রষ্টার সম্মতি কিনতে হবে। অন্যদিকে সচলায়তনের মত ব্লগে লিন্ক উল্লেখ করে কন্টেন্ট ব্যবহার করা সহজ, কারন এটি অবাণিজ্যিক। কাজেই ব্লগের লেখকরা অনেক বেশী স্বাধীন। আপনি ব্লগে কন্টেন্ট ব্যবহারের জন্যে কিভাবে ঋণ স্বীকার করতে পারেন তা এখানে পাবেন।
ইমরুল কায়েসের এই লেখার মন্তব্য অংশে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমার মনে হয় এখন আইন বিশেষজ্ঞের কিছু মতামত প্রয়োজনীয় হয়ে পরেছে। বাংলাদেশে ক্রিয়েটিভ কমন্স এখনও চালু হয়নি (তবে এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রযোজ্য)। ভারতে এটি এসেছে ২০০৭ সালে। এই লাইসেন্সকে এদেশের সরকার কর্তৃক অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন
No comments:
Post a Comment