মিউনিখের ট্রেন স্টেশনে সংঘটিত সাম্প্রতিক এক ঘটনা জার্মানীতে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এক গ্রীক এবং এক তুর্কী যুবক স্টেশনে এক পেনশন ভোগী বৃদ্ধকে লাথি মেরে আহত করে যা সিসিটিভির ভিডিওতে ধারন করা হয় এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখানো হয়। এই চিত্র সারা ক্রিসমাস জুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে বার বার প্রচারিত হতে আমি দেখেছি। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে কারাগারে থাকা এই বিদেশীদের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক এবং সব বিদেশী অপরাধীদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হোক।
ব্যাপারটি এখানেই শেষ নয়। পশ্চিমের হেসে স্টেটের গভর্নর রোলান্ড কখ সম্প্রতি বলেছেন যে জার্মানীতে বিদেশী অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বিশেষ করে জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে। তার মতে জার্মানীতে বসবাসকারী বিদেশীদের ভদ্র আচরণ করা উচিৎ এবং মারামারির সংস্কৃতি পালন করা উচিৎ নয়। এভাবেই একটি সভ্য দেশের লোকেরা আচরণ করে।
তবে উনি হয়ত ভুলে গিয়েছেন যে গত আগষ্টে জার্মানীর পূবের মুগেলন গ্রামে আট ভারতীয়কে ৫০ জন জার্মানের একদল হাঙামাকারী নির্মমভাবে পিটিয়েছিল। তারা কিন্তু কোন নিও নাৎসী দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, গ্রামের সাধারণ মানুষ ছিল, যারা এই বর্ণবাদী হামলা চালিয়েছিল।
যারা বিদেশী অপরাধীদের তাড়ানোর ব্যাপারে সোচ্চার তারা কিন্তু কখনও এ ব্যাপারে মুখ খুলবেন না যে ঐ ৫০ জন লোক কিভাবে বিনা বিচারে পার পেয়ে গিয়েছিল। তাদের গ্রেফতার করার পর তাদের নেতা বাদে সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয় এক ঘন্টার মধ্যে। এই নেতাকে পরে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ৬০০ ইউরো ফাইন করা হয়। যেহেতু সেই নেতা সোশ্যাল সিকিউরিটির ছাতায় আছে সে ঘোষণা করল এই ফাইন দিতে সে অক্ষম এবং ফলে স্টেট এক বছর ধরে তার ফাইন পরিশোধ করবে।
দক্ষিনপন্থী সাইট স্টোর্টেবেকার নেটজ এই আট ভারতীয় দের দেখে নেয়ার ব্যাপারটিকে একটি ছোটখাট বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেছে এবং বলেছে যে মুগেলনের মত গ্রাম মাল্টিকালচারিজম থেকে অনেকাংশে মুক্ত তাই এই উপযুক্ত কাজ করতে পেরেছে (উৎস)
তবে সব চেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে কট্টর দক্ষীণপন্থী রাজনৈতিক দল এনপিডি যাদের মতে "আফ্রিকান, এশিয়ান ও ওরিয়েন্টাল" কেউই কখনো জার্মান হতে পারবে না ঘোষনা দিয়েছে:
উদ্ধৃতি
"জার্মানী জার্মানদেরই থাকা উচিৎ যাতে আমাদের সন্তানদের আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের মত ভাগ্য বরন করা উচিৎ নয় যারা অভিবাসীদের ব্যপক অনুপ্রবেশের ফলে সংখ্যালঘু হয়ে যায়।"
মোটামুটি এই হচ্ছে জার্মানীতে বিদেশীদের প্রতি সাধারণ জনমত। এখন সমস্যা হচ্ছে বিদেশীদের গায়ে তো লেখা থাকে না কে এখানে পর্যটক, বা ক্ষন সময়ের জন্যে এসেছে বা অভিবাসী। ফলে টুরিস্ট এলাকার বাইরে গেলেই আসল পরিস্থিতি বোঝা যায়। যারা পশ্চিমের দিকে থাকেন তাদের খবর জানি না কিন্তু পূবের দিকে অনেক বিদেশী কেই অদৃশ্য বর্ণবাদের ব্যাপারে কথা বলতে দেখা গেছে। আমি নিজেও বার কয়েক খারাপ ব্যবহার পেয়েছি মাল্টিকালচারাল বার্লিনে যার কোন ব্যাখ্যা সহজে পাই নি। তবে অবশ্যই এটি কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ - এর সরলীকরন উচিৎ হবে না।
বার্লিনের প্রান্তে অবস্থিত একটি মিউজিয়ামে (House of the Wannsee Conference) গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। ইহুদিদের গণ হারে দেশ থেকে উৎখাত করা এবং পরবর্তীতে মারার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ১৯৪১ সালে অনুষ্ঠিত এখানকারই এক কনফারেন্সে।
এই মিউজিয়ামে রয়েছে জাতিগত প্রোফাইলিংয়ের সেই ইতিহাস। নাৎসিজম বৈজ্ঞানিকভাবে মানুষকে জাতিগত কিছু হায়ারার্কীতে ফেলে দেয়। যার উপরের দিকে রয়েছে জার্মানিক/নর্ডিক এবং আর্যরা (কোন কোন ক্ষেত্র সমার্থক) এবং নীচের দিকে ছিল পরজীবি জাতিরা (Untermenschen)
জার্মানরা খুবই গর্বিত জাতি। তারা তাদের পার্ফেকশন নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট। এই ধারনাকেই পুঁজি করে কখের মত লোক নতুন করে বিদেশীদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করছেন। ইতিহাস থেকে লোকে শিক্ষা গ্রহণ করে না এটি সবাই বলে। ফলে ভবিষ্যতে নাৎসীজমের পূনরাবির্ভাব (যদিও এটিকে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা আছে) হতেও পারে।
জার্মানীর প্রায় ১৮% জনসংখ্যা বিদেশী (দেড় কোটি) যার অধিকাংশই তুর্কী বংশোদ্ভূত। জার্মান নাগরিক হওয়া খুবই দুরুহ ব্যাপার এবং এজন্য তাদের অনেকেরই ভোটিং রাইট নেই (যদিও স্থায়ী বসবাস যোগ্যতা আছে)। তারা এই দক্ষিনপন্থীদের জাগরণকে কিভাবে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করবেন এটাই দেখার বিষয়।