Friday, October 05, 2007

বাখ বে'থোফেনের দেশে



১.

পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সঙীত শোনায় আমার হাতেখড়ি নব্বুই দশকের প্রথম দিকে জার্মান কাল্চারাল সেন্টার লাইব্রেরী থেকে। ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডের সেই সুন্দর বাড়ীটির (পরে বেক্সিমকো এন আইআইটি) নীচতলায় ছিল লাইব্রেরীটি। লাইব্ররিয়ান খান ভাইয়ের গম্ভীর ব্যবহারে তখন বেশ ভয়ই পেতাম। কিন্তু সেখান থেকে অডিও ক্যাসেট আর ম্যাগাজিন ধার করার জন্যে বার বার সেই ভয় ঠেলে যেতাম। পরে ওনার সাথে আমার খুবই ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়।

অডিও লাইব্ররীটিতে আমার পছন্দের ইংরেজী পপ সঙীত তেমন ছিল না। স্করপিওনস বা নিনার দুএকটি গান সহ সংকলন পেলে হাভাতের মত বাসায় নিয়ে আসতাম। আবিস্কার করলাম সেখানে পাশ্চাত্য সঙীতের এক বিশাল কালেকশন। আস্তে আস্তে বাসায় আনা শুরু করলাম বে'থোফেন, মোজার্ট ইত্যাদি কম্পোজারের মিউজিক। নিজের অজান্তেই এগুলো ভাল লাগতে শুরু করল। পরবর্তীকালে সেই উৎসাহে ভাটা পরে না শোনার কারনে কিন্তু ভাল লাগাগুলো থেকেই যায়। নব্বই দশকের শেষ দিকে একবার এক সহকর্মী কিছু ব্যবহার করা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সিডি বিক্রি করেছিলেন সেখান থেকে কিছু কিনেছিলাম। সেগুলো শুনলাম প্রান ভরে। এছাড়া বেশ কিছু লাইভ কনসার্ট দেখার সুযোগ হয়েছিল জার্মান কালচারাল সেন্টার ও ওসমানী মিলনায়তনে (গুটিকয়েক অতিথি শিল্পীদের দ্বারা) কিন্তু সেগুলো যে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো তা বুঝলাম অনেক পরে।

২.
জার্মানীতে আসার পর একটি জিনিসের স্বপ্ন ছিল, সত্যিকারের ক্লাসিকাল কনসার্ট শোনা। প্রথম যে শোতে গেলাম - বার্লিনের চারুকলা ইউনিভার্সিটি অডিটরিয়ামে, বুঝলাম সম্পুর্ণ অর্কেস্ট্রা কাকে বলে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসিকাল মিউজিক অধ্যয়নরত ২৭ দেশের প্রায় শতাধিক ছাত্রছাত্রীর মেলা মন্চে। একসাথে ৪০টির অধিক ভায়োলিন -ভায়োলা, হার্প, ডাবল বেজ, বাঁশী, ইংলিশ হর্ণ, ফ্রেন্চ হর্ণ, টম্বোন, ট্রাম্পেট এবং বিচিত্র রকম পার্কাশন সাজিয়ে বসেছে তারা। সবার পড়নে মার্জিত আনুষ্ঠানিক পোষাক কালো- সাদায়। কন্ডাক্টর আসলেন, করতালি পরল। উনি হাতে ছড়ি (ব্যাটন) নিয়ে নির্দেশ দিলেন সঙীত শুরু করতে।

যদিও শিল্পীরা নামকরা কেউ নয় কিন্তু আমি সত্যিই বিভোর হয়ে ছিলাম তাদের বাজানো সঙীতের মুর্ছনায়। ছয়-সাতশো লোকের সামনে ১০০ জন পারফর্ম করছে ভেবে দেখুন। ক্যাসেটে শুনে এই আবেদন পাওয়া যায় না।

বার্লিনের অন্যতম নাম করা অর্কেস্ট্রা হচ্ছে বার্লিন ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রা যারা প্রতিবছর আয়েজন করে বার্লিন মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। অস্ট্রিয়ান কন্ডাক্টর হার্বার্ট ফন কারায়ান (যার নির্দেশিত সঙীত আমি ক্যাসেটে অনেক শুনেছি) ১৯৮৯ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ৩৫ বছর ধরে বার্লিন ফিলহার্মোনিকের মিউজিক ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সম্মানে ফিলহারমোনির সামনের রাস্তাটির নাম করন করা হয় 'হার্বার্ট ফন কারায়ান স্ট্রাসে'।

এবার মিউজিক ফেস্টিভ্যালে একটি কনসার্ট দেখার ইচ্ছে ছিল। সাধারনত কনসার্টের মুল্য বেশ চড়া হয় এবং ভাল যায়গা পেতে হলে আগে থেকে বুক করতে হয়। আমার যেদিন সুযোগ হলো সেদিন প্রথম ভাগে ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত আমেরিকান কম্পোজার চার্লস ঈভস (১৮৭৪-১৯৫৪) এর সঙীত এবং বাজিয়েছে কনসার্টহাউজ অর্কেস্ট্রা বার্লিন। দ্বিতীয় ভাগে ছিল রোমান্টিক সময়কার চেক কম্পোজার আন্তোনিন দোভোরাক এর সঙীত। চার্লস ঈভসকে বেশ উচ্চকিত ও সিরিমোনিয়াল মনে হল অবশ্য তার পিসগুলোর নাম ছিল ডেকোরেশন ডে, দ্যা ফোর্থ অফ জুলাই, ওয়াশিঙটন'স বার্থডে এমন।

৩.
আমার দেখা কিছু কনসার্ট সংস্কৃতি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। জার্মান সমাজে ক্লাসিকাল সঙীতকে খুবই উচ্চমার্গের ধরা হয় এবং এগুলোতে সমাজের উচু স্তরের লোকজনের আনাগোনা বেশী। প্রথমবার সাধারন পোষাকে গিয়ে ধরা খেয়েছিলাম। তাই ফেস্টিভ্যালে কোটটি চাপিয়ে গেলাম। কিন্তু দেখি পুরুষরা প্রায় সবাই টাই পরে আরও কেতাদুরস্ত, কিছু উচ্চবর্গীয় নারীর ডিজাইনার পোষাক পড়ে আগমন দেখলাম। অনুষ্ঠান শুরুর সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। যারা দেরী করে আসবে তাদের জন্যে বাইরে বসার ও টিভি মনিটরের ব্যবস্থা আছে। মোবাইল ফোন বন্ধ করার কোন ঘোষনা দেয়ার দরকার নেই কারন ভেতরে বিশেষ ব্যবস্থায় নেটওয়ার্ক নেই। ফলে পিন পতন নিস্তব্ধতায় কনসার্টটি চলল।

দুই ঘন্টার সঙীতে (মাঝখানে ১৫ মিনিটের বিরতি) ৮০-১০০ জনের মুল অর্কেস্ট্রার পাশাপাশি প্রায় চল্লিশ জনের একটি কয়ার গ্রুপ বসে ছিল সারাক্ষন মাঝের ২-৩ মিনিটের জন্যে কন্ঠ দেয়ার জন্যে এবং তাদের জন্যে ছিল আলাদা কন্ডাক্টর। সঙীতের কোন অংশ সম্পুর্ণ শেষ না হলে তালি দেয়ার নিয়ম নেই। ভুলে কেউ তালি দিলে আশেপাশের বেশ কয়েকটি চোখ আপনার দিকে ঘুরে যাবে। কনসার্ট শেষ হওয়ার পর তালির বহর শুরু হবে। এই তালি দেয়াটাও একটি আর্ট। প্রথমবার শিল্পীরা সবাই দাড়িয়ে বো করে কন্ডাক্টর চলে গেলেন। শিল্পীরা বসে গেলেন কিন্তু তালি থামছেনা। উনি আবার আসলেন মন্চে , এসে আবার বো করলেন। তাকে ফুল দেয়া হলো তিনি বো করে চলে গেলেন। তালি পড়তে লাগলো এবং তিনি যেন আবার আসতে বাধ্য হলেন। তারপর তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে ভাল পারফর্মারের দিকে অঙুলী নির্দেশ করলেন সে উঠে দাড়ালো। তারপর তিনি চলে গেলেন। ওইদিকে তালি চলছে অবিরাম। প্রায় ৫-৬ মিনিট ধরে ছবার তিনি আসলেন গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত শিল্পীরা মন্চ থেকে নেমে গিয়ে দর্শকদের উদ্ধার করল।

৪.
বাখ ও বে'থোফেনের দেশে ইচ্ছে করলেই সঙীতে ডুবে থাকা যায়। গাড়ীতে চলতে চলতে হাত বাড়ালেই 'ক্লাসিক রাডিও' আর বাড়ীতে টিভিতে 'ক্লাসিকাল এফ এম'। এছাড়া নানা কনসার্ট অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচারতো রয়েছেই। খালি শোনার আগ্রহ দরকার। আর এখানকার জনগনকে তৈরি করা হয় সেভাবেই। তিন বছরের মেয়ে প্রি স্কুলে যাচ্ছে তো দেখলাম তাদের স্বরবর্ণ শেখার আগেই মিউজিক ক্লাস হচ্ছে। মিউজিক টিচারকে জিজ্ঞেস করলাম এরা তো কথাই ঠিকমত বোঝে না, এদের তুমি সঙীত বোঝাতে পারবে? সে বলল আমাদের প্রচেষ্টা ধ্বনির পার্থক্যগুলো সম্পর্কে তাদের ধারনা তৈরি করা। কাজেই তোমার মেয়েকে কানে হাত দিয়ে কোন কিছু মনযোগ দিয়ে শুনতে দেখলে বকা দিওনা। ওটা আমরাই শেখাচ্ছি।

আমার ছেলেবেলাটি যদি এমন হতো!

৫.
আপনাদের সবার জন্যে পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সঙীতের কিছুটা আমেজ রেখে যাচ্ছি এখানে। আমার পছন্দের কিছু সঙীতের লিন্ক:

# লুডভিগ ফান বে'থোফেন - ৫ম সিম্ফোনি৯ম সিম্ফোনি
# ইওহান সেবাস্তিয়ান বাখ - ব্রান্ডেনবুর্গ কনসার্ট
# ভোল্ফগাঙ আমাদেউস মোৎসার্ট- আইনে ক্লাইনে নাখটমুজিকসিম্ফোনি নং ৪০
# শুমান - পিয়ানো কনসার্টো নং ১
# ইগর স্ট্রাভিন্সকি - দ্যা রাইট অফ স্প্রিং
# মরিস রেভেল- বলেরো
# চায়কোভস্কি - সোয়ান লেক
# হেন্ডেল -ওয়াটার মিউজিক
# আন্তোনিন দোভোরাক - ফ্রম দ্যা নিউ ওয়ার্লড (৯ম সিম্ফোনি)

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তন

No comments: