ঘুরে এলাম সাত পাহাড়ের শহর রোম ও স্বপ্নের শহর ভেনিস। ভেবেছিলাম বিস্তারিত ভ্রমন বৃত্মান্ত লিখব। কিন্তু সেটি তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্যে। খুব লিখতে ইচ্ছে করছে ইটালীর সাথে বাংলাদেশের মিল এবং ইটালিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের কথা।
বাংলাদেশের কথা মনে পরে গেল রোম এর একটি ঘেটো দিয়ে ঢুকতেই। বিলডিংগুলো রংজ্বলা, বারান্দায় কাপড় শুকোতে দেয়া, রাস্তার পাশে লোহার ব্যারিকেড, গাড়ীর আইন না মানা, সবকিছুতেই ঢাকার গন্ধ পাচ্ছিলাম। আর হাইওয়ে থেকে নেমে একটি ট্রাফিক সিগন্যালে এসেই দেজাভূ! রাস্তায় দুজন বাংলাদেশী খবরের কাগজ বিলি করছে। এরা ইটালীতে অবস্থানরত ১ লাখ বাংলাদেশীরই অংশবিশেষ। বলা হয় এদের মধ্যে অধিকাংশই এসছে বৃহত্তর ফরিদপুর ও নোয়াখালী থেকে এবং অনেক পথ পায়ে হেটে, পাকিসতান-ইরান-তুরস্ক হয়ে। বিদেশে এসে এখন অনেক লোকের ভীড়ে দেশী ভাইদের আরও ভালভাবে চিনতে পারি।
ইটালীতে ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার মাত্র। কিন্তু ১৯৯০ সালের মার্ত্তেল্লী আইনের মাধ্যমে ইটালী সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বৈধ ঘোষনার সুযোগ দিলে ইটালী খুব আকর্ষনীয় যায়গা হয়ে পরে। সাধারনভাবে টুরিষ্ট হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ইটালী আসা খুব কঠিন। ঢাকায় ওদের এমব্যাসিতে ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়, যেখানে ফোনটি অধিকাংশ সময়েই কেউই ধরেনা। সম্পদের নিক্তিতে মানুষকে মাপা হয় তাই সাধারন গ্রামের লোকের ভিসা পাওয়া খুব কঠিন। বেশীর ভাগই ইটালীতে এসেছে পরিবারের কারো বদৌলতে বা দালাল ধরে অন্য দেশ ঘুরে।
ত্রেভি ফাউন্টেন দেখতে গেলাম রাত দশটার পরে। চিপা গলি দিয়ে হাটতে হাটতে শুনি এক কোনা থেকে বাংলা লোকসঙীত ভেসে আসছে। কাছে গিয়ে দেখি দেয়ালে হেলান দিয়ে দেশী ভাই। রোদে পোড়া চেহারা, হাতে গোলাপফুল, বিক্রির জন্যে। আরেকটু সামনে হঠাৎ হইচই। পুলিশ একদল হকারকে দৌড়াচ্ছে। ওরা দৌড়ে আমাদের দিকে আসল। আমাদের সাথে শাড়ী পরা মেয়ে, ছোট বাচ্চা। জিগ্গাসু চোখে আমাদেরকে পর্যবেক্ষন। অস্বস্তি লাগছিল তাই সরে এলাম। ট্রেভি ফাউন্টেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের টুরিস্টে গিজগিজ করছে। ভীড়ের মধ্যে যুবক যুবতী জড়িয়ে বসে ঝর্নার শব্দ শুনছে ও নিজস্ব ভুবনে থাকার চেষ্টা করছে। যুবতীদের অনেকের হাতে তাজা গোলাপ। বিক্রি ভাল হওয়ার কথা। হঠাৎ দেখি পুলিশের দল সরে গেল এবং গুটি গুটি পায়ে বাঙালী ভাইদের পুন:প্রবেশ। ফুলসহ হাত পেছনে রাখা। আবার ব্যবসা হবে। চলে আসলাম ওখান থেকে তাড়াতাড়ি।
ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটারস স্কোয়ার এবং বিভিন্ন মোড়ে গাড়ী থামিয়ে ছাতা, ব্যাগ ইত্যাদি বিভিন্ন পশরা বিক্রি করতে দেখলাম আরো কিছু দেশী ভাইকে। সারাদিন রোদে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে ফেরী করা নিশ্চয়ই খুব কষ্টের। এই লোকেরা হয়ত একেকজন আট দশ লাখ টাকা খরচ করে এসেছে। তাদের অনেক কষ্ট করেই দেনা শোধ করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কি কঠিন জীবন। পাশাপাশি এক আলবানিজ বুড়োকে দেখলাম ভিক্ষা করতে। জীবনের কি কন্ট্রাস্ট।
ভেনিসের একটি ছোট গ্রাম মেস্ট্রেতে প্রচুর বাঙালীর দেখা পেলাম। রাস্তায় সারি সারি বাংলাদেশী দোকান, বাংলা হরফে লেখা দোকানের নাম। ইউরোপে বিলেতের পর সবচেয়ে বেশী দেশীদের বসবাস ইটালীতে। ইটালীর পুলিশকে বলা হয় ইউরোপের সবচেয়ে ভদ্র। ওরা ক্রাইম না করলে সাধারনত অবৈধদের ধরার কষ্ট করতে চায়না। তাদের গাছাড়া ভাব অনেক অবৈধ বাঙালীকে থাকার ও কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর ৫-৬ বছর কাটাতে পারলে সুযোগ হয়ে যাচ্ছে বৈধ হয়ে যাওয়ার।
ভেনিসে যে আত্মীয়র বাড়ীতে উঠলাম সে রেস্টুরেন্টে কাজ করে শুনে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম (আমরা জানতাম অন্য চাকরি করে)। কিন্তু তার কাছেই শুনেছি ১৫-১৮ ঘন্টা একাধিক রেস্টুরেন্টে কাজ করে ৪০০০ ইউরো মাসে আয় করে সে যেখানে একজন সরকারী ইনজিনিয়ার ২০০০ ইউরোর বেশী পায় না। শিক্ষিত তিনি, ৬-৭টি ভাষা জানেন, দশ বছর ধরে আছেন এবং বাড়ী গাড়ী করেছেন। তাদের জীবন যাত্রার মানের সাথে সাধারনের চলা মুশকিল।
ইচ্ছে করেই এদের কোন ছবি তুলিনি। এদের কষ্টের কাছে নিজের জীবন খুব অলস মনে হলো। তবে অচিরেই এরা আরও প্রতিষ্ঠিত হবে, তাদের কষ্টের স্বীকৃতি পাবে এবং মাথা তুলে বিশ্বে তাদের অবস্থান জানাবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে কষ্টের বিকল্প নেই। তাদেরকে লাল সালাম।