Friday, January 26, 2007

বাংলা একাডেমীর 'স্মৃতি: ১৯৭১' সিরিজ ৪র্থ খন্ড থেকে উদ্ধৃতি

"পাকিস্তানীরা আমাদেরকে বলে, আমরা হিন্দু জারজ সন্তান, নিজেদের মুসলমান বলার কোন অধিকার নাকি আমাদের নাই। রাগ হলে আমাদের বাঙালী কুত্তা, গাদ্দার বলে ডাকে। এই রকম নানা প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে বাঙালীদের কাজ করতে হতো। বাঙালীরা ভালো কাজ করে সুনাম ও প্রমোশন পাক এটা পাকিসতানিরা সহজে চাইত না । বাঙালী অফিসারকে ডিঙিয়ে তাদের প্রমোশন হতো । এইভাবেই বাঙালী অফিসার, সেপাহীদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

মোয়াজ্জেমকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন ভারত পালিয়ে যেতে। শুনে ভীষন রেগে গিয়েছিলেন, ভারতে আমি যাব না, ভারতের কাউকে বাংলার মাটিতে আসতেও দেব না। তাছাড়া মরতেই যদি হয় নিজের দেশের মাটিতে নিজের মানুষের সাথেই মরব ।

'বোল পাকিস্তান জিন্দাবাদ' মোয়াজ্জেমের উপর পাচটি রাইফেল টার্গেট করে বলে। বীরদর্পে উনি তর্জনী উচিয়ে বলেছিলেন 'এক দফা জিন্দাবাদ' । কারন তার দফা একটাই 'বাংলাদেশ স্বাধীন করা'। গর্জে উঠল একসাথে ৫টি রাইফেল। পড়ে গেলেন মাটিতে। সেখান থেকেই আবার বললেন 'এক দফা জিন্দাবাদ'।"

- কোহিনুর হোসেন, স্বামী, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দ্বিতীয় অভিযুক্ত) প্রসঙে।

"তোমার ছেলে মুক্তি? শান্ত কন্ঠে অধ্যাপক বলেন আমার ছেলে এখন সৈনিক। দেশ স্বাধীন করতে গেছে। কথা শেষ হবার আগেই গুলি। আহত হয়ে অধ্যাপক আহমেদ বলেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। ক্রুদ্ধ সৈন্যরা তখন তার জিহ্বা কেটে দেয়, বেয়নেট দিয়ে খোচাতে খোচাতে হত্যা করে। "

- নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ, শিক্ষক ডা: শামসুদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণে

"মওলানা কসিমুদ্দিন ছিলেন অসামপ্রদায়িক । তাকে ৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সাথিয়া এলাকার জনৈক জামাত কর্মী।"

- জিয়া হায়দার, শিক্ষক মওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ প্রসঙে

"যাদের রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা গড়া, আজ পর্যন্ত তার কতটুকু মুল্যায়ন হয়েছে? কি কৈফিয়ত দেবে এই দেশবাসী শহীদদের সন্তানের কাছে? তাদের পিতার রক্তের মুল্য কি?"

- রহীমা খাতুন, স্বামী পেশাজীবি আমিনুল ইসলাম প্রসঙে।

"২৮শে এপ্রিলের রাজশাহীগামী কোচ ধরা পড়ল মিরপুরের বিহারীদের হাতে। ওটাতেই আমার মেঝভাই ছিলেন। এইটুকুই তার হারিয়ে যাওয়ার খবর। আমার ভীরু ভাইটিকে কে বা কারা, কোথায়, কি ভাবে মারে, আমরা তা জানতে পারিনি।"

- ফজলুন্নেসা নার্গিস, ভাই প্রকৌশলী আবু সালেহ মো: এরশাদুল্লাহ প্রসঙে।

"নিহত শত শত বীর সন্তানদের নাম ও ঠিকানা পাওয়া যাবে না। তাই আমার ধারনা। যুদ্ধে তো অনেকেই শহীদ হলো এখানেও রাজনীতি। যখন যে চেয়ারে বসেন শুধু সে তার পক্ষের লোক নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন এবং তার দলের লোকের নাম লিপিবদ্ধ করেন ইতিহাসের পাতায়। এইভাবেই প্রতিযোগিতা চলছে ইতিহাসের পাতা দখল নিয়ে। সেখানেও চর দখলের মত যুদ্ধ হচ্ছে অহরহ। এরই মাঝে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকরা গুছিয়ে নিয়েছে তাদের আখের ও সামাজিক স্বীকৃতি। আর আমরা দর্শক এই নাটকের মনচে দাড়িয়ে আছি।

পুর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির শহীদ বিপ্লবী প্রকৌশলী সিরাজ সিকদার এর বড় ভাই বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদ প্রকৌশলী বাদশা আলম শিকদার এর গর্বিত বাবা মাকে কোনদিনও প্রচার মাধ্যমে ডাকা হয় নাই এমনকি তার নামটাও উচ্চারন করা হয় নাই।

পাক আর্মিরা আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিগ্গেস করেছিল কোথায় তোমার সন্তানেরা। বাঙালীরাতো সবাই হিন্দু, তোমরা মুসলমান হয়ে কেন হিন্দুদের সাথে যোগ দিয়েছ? তোমরা হাত দিয়ে কেন খাও, এটাতো হিন্দুরা করে, তোমরা কাটা চামচ দিয়ে খেতে পারনা?"

- ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার, ভাই প্রকৌশলী বাদশা আলম শিকদার স্মৃতিচারণ

No comments: