Saturday, September 16, 2006

জীবন উপন্যাস: সভ্যতার পাপ

তখন আমি ঢাকায়, কলেজে পড়ি। নির্মিয়মান বাড়ীর একটি রুমে আমার ঠাই হয়েছে। এই বয়সে একা থাকার ব্যাপারই কেমন রোমানচকর। অভিভাবক থেকে দুরে থাকার অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করছি বন্ধুদের সাথে সারাদিন তাস খেলে আর আড্ডা মেরে ।

একদিন সকালে খবর এল শাহীন আপা খুন হয়েছে, সাথে পিচ্চিটাও। পুকুরে লাশ পাওয়া গেছে। আমি বলছি তাই নাকি, হাতে কার্ড, অনক কষছি, এরপর কোন কার্ড দেব? বন্ধু দিল এক ধমক, "এই তুই হাসছিস কেন?" সম্বিত ফিরে আসলো। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম সংবাদদাতাকে "কি হয়েছে আবার বল"।

ট্রেনে যাচ্ছি ময়মনসিংহ, আব্বার সাথে। মন খুব খারাপ। সত্যি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না সংবাদটা। ফ্লাশব্যাকে চলে গেল মন।শাহীন আপা আমার বড় চাচার মেয়ে। অনেক ভাইবোনের সাথে মানুষ। পড়াশোনা শেষ করে তখন ত্রিশালের থানা এডুকেশন অফিসার। আমাদের ফ্যমিলিতে মোটামুটি একটি রেভলু্যশন ঘটিয়ে দিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। এক হিন্দু কলেজ প্রফেসরকে বিয়ে করেছেন। ধর্মের ভিন্নতার জন্যে পরিবারের অমত ছিল কিন্তু ভালবাসারই জয় হল। দুলাভাইয়ের সঙে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, বেশ ফ্রেন্ডলি। শেষ দেখা কয়েক মাস আগেই আমার ময়মনসিংহ ভ্রমনের সময়। ওনাদের মেয়ের নাম কচি, বছর আড়াই বয়স। বেশ টরটরে কথা বলে। বেচারা পরে গিয়ে সামনের দাতে কালশিরা পরে গেছে। আমি শাহীন আপাকে বকলাম "দেখে রাখতে পারেননা?"। মেয়েটা মামা মামা বলে অস্থির, ছাড়তেই চায়না।

তারপর এক দু:স্বপ্ন অতিক্রম করলাম । চাচার বাসায় প্রচুর লোক, ক্রন্দনরোল। চারিদিকে ফিসফাস, কানাঘুষো। বিস্তারিত শুনলাম, অনেক ভার্সনে। মোদ্দাকথা দাম্পত্য কলহ ইদানিংকালের সঙী ছিল তাদের। সকালবেলা বাড়ীর পাশের পুকুরে ভেসে উঠেছে দুইজনের লাশ। গলায় শ্বাষরোধের িচহ্ন। স্বামী পলাতক। কি অনুভব ছিল তখন আমার মনে? শোক, অবিশ্বাস নাকি ক্রোধ? অথবা সবগুলোই?

লাশ আসলো পোস্ট মর্টেমের পর । সাদা কাপড়ে মোড়া কচি এবং তার মা শুয়ে আছে কাঠের বাক্সে। বিধ্বস্ত মামারা এবং ক্রন্দনরত খালারা দৌড়ে বেরাচ্ছে। আমার রাগ হচ্ছে কিছু লোকের উপর যারা লাশ দেখতে চাচ্ছে। এক ভাই বললেন লাশের যে অবস্থা না দেখাটাই ভালো।"আল্লাহু আকবার , আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"। আমার কাধে কচির লাশ, কবরস্থানে যাচ্ছি। খুব ভারী লাগছে কফিনটি, মনে হচ্ছে ধরনী দ্বিধা হয়ে যাক। আমি কাঁদছি, কাঁদছে আকাশ। মুখ ও জামা ভেজা, বৃস্টি না চোখের জলে কেউ জিজ্ঞেস করো না। সভ্যতার পাপ বইছি আমরা অনন্তকাল ধরে।

কি হলো তারপর? লোকটির হদিশ পাওয়া গেল না। মাসের পর মাস কেসের তারিখ পরে। চাচাত ভাইরা বহু চেষ্টা করল। চাচী শোকে পাথর। বহুদিন পরে খবর এল সে ইন্ডিয়ায় পলাতক। তার বাবা মা ছিল এদেশের কোন গ্রামে। তারাও বাড়ী ছেড়ে চলে গেছেন। একজন শিক্ষিত মানুষ বা তার পরিবার এমন করতে পারে তা যেন মেলানো যায়না। অথবা শিক্ষার ভিতরেই হয়ত পাপ ঢাকা থাকে ভালমানুষের খোলসে।

আমি আজ বিশ্বাস করি যে মানুষের জীবন উপন্যাসের চেয়েও ঘটনা বহুল। মানুষকে বিশ্বাস করা কি পাপ? আমাদের শত্রু যে অনেক সময়ই কাছের মানুষ।

No comments: