Thursday, March 25, 2010

মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিতর্ক

একটি বিষয় নিয়ে আমাদের সবারই স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী, বিশেষ করে যারা প্রবাসে আছেন বা অচিরেই যাদের ভিনদেশে ভ্রমণ করতে হবে তাদের। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য এই বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করা এবং এ নিয়ে সমস্ত গুজবকে উড়িয়ে দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা।

আমরা এরকম শুনে আসছিলাম আগে থেকেই যে আগামী পহেলা এপ্রিল থেকে কারও কাছে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট না থাকলে তাকে বিদেশ ভ্রমণ করতে দেয়া হবে না। এ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাংলাদেশ এই ডেডলাইন মিস করতে যাচ্ছে এ কথা আমরা সবাই জানি। ২০০৭ সালেই ভোটার রেজিস্ট্রেশন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের সাথে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট হবার কথা ছিল, কিন্তু আমরা যে কারণে জাতিগতভাবে অনেক ট্রেনই মিস করি, এ ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি।

সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে সরকারের মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট প্রকল্প অবশেষে চালু হচ্ছে (প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার বিতর্কে যাব না) এবং এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে এই নতুন পাসপোর্টের জন্যে আবেদন তারা গ্রহণ করবে। তবে দু:সংবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের মোট পাসপোর্ট সংখ্যা ৬৬ লাখ এবং এই পরিমাণ পাসপোর্ট প্রতিস্থাপন করতে প্রায় তিন বছর লাগবে। কিন্তু এখন যেই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ যে পহেলা এপ্রিলের পর আসলে কি হবে।

আমি এ নিয়ে বেশ কিছু খোঁজ খবর করেছি। তাতে দেখেছি যে ভুল তথ্যে ভরা বিভিন্ন রিপোর্ট এবং এক শ্রেণীর লোক এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। বিতর্কিত হিটখোর সাংবাদিক সালাউদ্দিন শোয়েব চৌধুরী তার অনলাইন ব্লিটজ পত্রিকায় সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দিয়ে বসলেন যে "কোন বাংলাদেশী এপ্রিলের পর ভ্রমণ করতে পারবেন না"। জন্ডিস সাংবাদিকতার চুড়ান্ত উদাহরণ এটি - কারণ উনি অনেক গল্প ফেঁদেছেন।

এ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক রিপোর্ট হয়েছে কিন্তু প্রকৃত সত্য কম স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে (আমাকে কেউ কি এ সংক্রান্ত কোন সঠিক রিপোর্টের লিন্ক দিতে পারেন?)। সত্যটি হচ্ছে এই ডেডলাইনটির প্রণেতা দ্যা ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (বাংলাদেশ যার সদস্য)। এটি বলেছে যে এর সদস্য দেশগুলোকে ২০১০ সালের ১ এপ্রিলের মধ্যে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যু করা শুরু করতে হবে।

মেশিন রিডেবল নয় এমন পাসপোর্ট কিন্তু তামাদি হয়ে যাচ্ছে না যতদিন না পর্যন্ত এর বৈধতা আছে। তবে এখন পর্যন্ত একটি ডেডলাইনের কথা শোনা যাচ্ছে - ২০১৫ সালের ২৪শে নভেম্বর (তথ্য যাচাই করতে সূত্র দরকার) - এর পরে ন্যূনতম মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট থাকতে হবে একজন ভ্রমণকারীর।

এবং যে বিষয়টি অধিকাংশ পত্রিকার রিপোর্টই এড়িয়ে গেছে যে কাকে ভ্রমণ করতে দেয়া হবে এবং কাকে দেয়া হবে না, এই এক্তিয়ার কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর। যেমন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা ওয়েইভার দেশগুলোর নাগরিকদের জন্যে (যে সব দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে ভিসা লাগে না) বাধ্যতা মূলক মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ডেডলাইন প্রথমে ঘোষণা করেছিল ২০০৩ সালে যা পরবর্তীতে কয়েকবার পেছানো হয়। অবশেষে ২০শে জানুয়ারী ২০১০ থেকে এই সিদ্ধান্তটি বলবৎ হয়। তবে যাদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নেই তাদের ভিসা নিয়ে প্রবেশ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে এইসব ডেডলাইন পরিবর্তন হতে পারে এবং দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। আর বাংলাদেশীরা ভ্রমণ করতে পারবে না এইসব জুজুর ভয় কারা দেখাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের খোঁজ নেয়া দরকার।

মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সহসাই আমাদের হাতে আসছে না। এই নতুন পাসপোর্ট প্রণয়নে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত সংস্কার দরকার। বাংলাদেশের ৬৬টি মিশন ও কনসুলেটে বসানো দরকার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ- যেসব সংক্রান্ত কোন উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি যদিও সরকারের এ নিয়ে পরিকল্পনা আছে।

তবে সবচেয়ে দু:খের বিষয় হচ্ছে এর পরবর্তী প্রযুক্তি আরএফডি চিপসহ বায়েমেট্রিক ই-পাসপোর্ট চলে এসেছে এবং ২০১৪ সালের পর আমরা আবার এরকম একটি ডেডলাইনের মুখোমুখি হব। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত - পাকিস্তান অচিরেই ই-পাসপোর্ট দেয়া শুরু করবে। আমরা আবার ট্রেন মিস করব এবং অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হব।

(ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে)

Sunday, March 14, 2010

বার্ধক্য



বার্ধক্য

আমার ইদানিং হয়েছে শনির দশা। পেটের ব্যামো ছিল অনেকদিন ধরেই। সময় মত খাওয়া দাওয়া করে তাকে বাগে এনেছিলাম একরকম। জানুয়ারি মাসে পরিবারের একজনকে ব্যাংকক নিয়ে যেতে হল চিকিৎসার জন্যে। তারই অনুরোধে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ঢেকি গেলার কাজটি ঠিক হয় নি এখন বুঝি। ডাক্তার একগাদা স্বাস্থ্য পরীক্ষা লিখে দিল, আল্ট্রা-সোনো, এন্ডোসকপি আর কত কি! একে একে সব যজ্ঞ সমাধা করে এন্ডোসকপির জন্যে এগুলাম। আমার ধারণা ছিল না যে এটির জন্যে রীতিমত বন্ড সই করে অনুভূতি বিলোপ ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে অজ্ঞান করে মুখের ভিতর নল ঢুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় ও পাকস্থলীর অংশ কেটে পরীক্ষার জন্যে নেয়া হয়। টেবিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চৈতন্য নাশ হল। জ্ঞান ফিরেই শুনি ডাক্তার বলছেন আমার পাকস্থলীর বৃত্তান্ত। অনেক কথাই ধরতে পারিনি - তবে বুঝলাম মারাত্মক কিছু নয় - কিঞ্চিত আলসার আছে এবং এইচ পাইলোরি নামক একটি মন্দ ব্যাক্টেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে টিস্যু স্যাম্পলে। শেষে তিনি বললেন আমার লিভারের উপর সাদা সাদা কিছু দেখা গেছে এবং তার মতামত হচ্ছে এর জন্যে লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখান দরকার। আমি চাইলে এক্ষুণি সেখানে নিয়ে যেতে পারে সে। আমার মাথা তখনও ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমি বললাম রোসো, পরে দেখাব - আমি এখন পরিবারের কাছে যেতে চাই।

আমাকে দেয়া হল দুটি অ্যান্টিবায়োটিকসহ চারটি ঔষধের কম্বিনেশনে ১০ দিনের ডোজ যা শুরু করলাম সেদিনই। জাকার্তায় ফিরতি ফ্লাইট ছিল একদিন পরে। প্লেনেই শুরু হলো ডায়রিয়া এবং ঘরে ফিরেও তা চলতে লাগল - মনে হয় ঔষধের প্রতিক্রিয়া। সে এক কলিকাল - তার দুদিন পরে আমি পুরো বিছানায়। ডায়রিয়া কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না - সাথে অরুচি, বমি, কাশি - অনেকদিন আমার এমন অসুখ হয়নি। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শে ওরস্যালাইন ইত্যাদি পথ্যে হাসপাতালে যাওয়া রোধ করা গেল আপাতত। ব্যাংককের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের উপায় পাওয়া গেল না। মনে হল অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ না করলে মারা যাব। তবে ঔষধ বন্ধ করার পরেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটল না। তারপর অবধারিতভাবে স্থানীয় হাসপাতাল, ডাক্তার - অবশেষে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটল। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হইনি এখনও - অরুচি, ওজন হ্রাস ইত্যাদি বিদ্যমান।

আমি এখন ভাবি - সামান্য এক পেটের অসুখের জন্যে আমি এতটা ভেঙ্গে পরেছিলাম। আর এই বোধটি আরও জাগ্রত হয় বাবাকে দেখার পর। বাবা এসেছিলেন জাকার্তাতে, ছেলে-বউয়ের সংসার দেখতে; নাতনীর সাথে সময় কাটাতে - যে নাতনী তার কাছে জীবনের প্রথম এক বছর ছিল। উনি তাকে কতটুকু মিস করেন তা তাদের ফোনালাপে বোঝা যায়। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর এই কয়েক বছরে বাবা-মা যেন অনেক বুড়িয়ে গেছেন। ৭২ বছর বয়সী বাবার গালে এখন সাদা দাড়ি। আমার মেয়ে গতবছর দেশে গিয়ে বলে (ছবির স্মৃতিতে) আমার না আরেকটা দাদা আছে যার দাড়ি নেই!

এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ - প্লেন আসতে দেরী করছে। অবশেষে তিনি এলেন - পড়নে স্যুট। কিন্তু একি? বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ - হাতে ভারি এক ঝোলা। সাথে ফুফাতো ভাই ছিল। বলল - শরীরটা ভাল নেই - মালয়েশিয়ায় লম্বা ট্রানজিটে কষ্ট হয়েছে অনেক। তারপরও মনের জোরে এসেছেন - হাতে ছেলের বউয়ের আবদারের বইয়ের ঝোলাটি বোনপোকে দেননি পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে ঘোষণা দিলেন দুদিন বিশ্রাম নেবেন।

এরপর তাকে ঘুরিয়ে দেখানোর আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল। নাতনী সাফারি দেখাবে বলে এতদিন প্রলোভন দেখিয়েছে। সেই সাফারিতে যেতে তার কষ্ট হল। বুড়ো বয়সে অনেক কষ্ট - টয়লেটের চাপ ধরে রাখা - বেশিক্ষণ হাঁটতে না পারা। মনে হল নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই। অথচ তার এই অক্ষমতার কথা স্বীকারও করছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন - না ঠিক আছি। ফলস্বরূপ কষ্টও পেয়েছেন।

এরপর সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া হল যোগজাকার্তা। বিমানে ওঠার আগে হুইল চেয়ারে উঠতে বলাতে তার ভয়ানক আপত্তি। তবে আমাদের পাল্লায় পড়ে তাকে সেটাতে উঠতেই হল। সেখানে হোটেলে উঠে তার জন্যে বরাদ্দ রইল বিশ্রাম। পরদিন বরবুদুর বৌদ্ধমঠ দেখতে পারলেও পারামবালান মন্দিরে ঢুকে তার শরীর খারাপ হয়ে গেল। আমরা দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে এর পরদিন তাকে আবার জাকার্তা নিয়ে এলাম।

এখন চিন্তা হল তিনি কিভাবে দেশে ফেরত যাবেন। যাবার পথে মালয়েশিয়ায় কয়েকদিন স্টপওভার আছে - তার বিশাল পরিকল্পনা ছিল পেনাঙ্গ যাবেন ইত্যাদি। আমরা বললাম সেই পরিকল্পনা বাদ দিন আর টিকেট করে দিচ্ছি - দ্রুত ঢাকা চলে যান। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, সেই শরীর নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া গেলেন এবং সীমিত পর্যটনের পর এখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন। তবে এই কয়েকদিন আমাদের বেশ উদ্বিগ্ন করে রেখেছিলেন।
আমি এখনও বাবার ক্ষীণকায় শরীর, সেই বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ, সিঁড়িতে কষ্ট করে ওঠা ইত্যাদি ভুলতে পারিনা। অথচ এই বাবাই এই কয়েক বছর আগেও নিজেই অনেক পরিশ্রমের কাজ করতেন।

আর যখনই ভাবি এই বার্ধক্যকে জয় করার তার প্রচণ্ড মনোবলের কথা তখন নিজের ছোটখাট অসুখের জন্যে চিন্তাকে খেলো মনে হয়। আর মনে হয় আমাদের ও একসময় সেই দিন আসবে। তার জন্যে কি আমরা তৈরি?

ফ্লিকার থেকে নেয়া উপরের ছবিটি জন্যে শহরবন্দীর কাছে রইল কৃতজ্ঞতা।