Monday, November 30, 2009

বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি: মনের দেয়াল ভাঙ্গাটাই আসল

আজকের খবরের চ্যানেলগুলোতে শুধু বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানমালা - অনেকেই লাইভ দেখাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের এই পতন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপব্যাপী সমাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবেরই শক ওয়েভের ফসল হিসেবে ধরা হয়। তবে এটি আরও তাৎপর্য পূর্ণ। এটি হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সমন্বিত পরাশক্তিরা ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জার্মানী দখল করে রাখে। ১৯৪৯ সালে আমেরিকা গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলে থাকা ১২টি স্টেটের সমন্বয়ে পশ্চিম জার্মানী গঠিত হয় এবং রাশিয়ার দখলে থাকা ৫টি স্টেট নিয়ে পূর্ব জার্মানী গঠিত হয়। প্রাক্তন রাজধানী বার্লিন শহরটি দুইভাগ হয়ে যায় এবং পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী বন নির্ধারিত হয়। ১৯৫৫ সালে রাশিয়া পূর্ব জার্মানীকে পুরোপুরি স্বাধীন ঘোষণা করে, তবে রাশিয়ার সৈন্যরা পটস্ডাম চুক্তি অনুযায়ী সেখানে থেকে যায়, যেমন পশ্চিম জার্মানীতে আমেরিকা, ইউকে আর ফ্রান্স এর সৈন্যরা ছিল।

আলাদা হবার পরপরই ১৯৫০ এর দশকে পশ্চিম জার্মানী একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির অনেকটাই তারা কাটিয়ে উঠে। ঐদিকে পূর্ব জার্মানরা তেমন সৌভাগ্যবান ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই তাদের উপর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা পোল্যান্ড আর চেকোস্লোভাকিয়া ছাড়া কোথাও যেতে পারত না (তাও বিশেষ অনুমতিক্রমে)। কিন্তু তবুও সীমিত আকারে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হত তখনও। তবে পশ্চিম জার্মানীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকায় ১৯৫০ এর দশকে প্রায় ৩৫ লাখ পূর্ব জার্মানবাসী পশ্চিম জার্মানীতে চলে আসে। এই ঢল ঠেকাতে হঠাৎ করে ১৯৬১ সালে বার্লিনের মাঝামাঝি দেয়াল তুলে দেয়া হয় ও ডেথ জোন তৈরি করা হয় নো ম্যানস ল্যান্ডে। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকে এই ডেথ জোন পার হয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায় পূর্ব জার্মান সৈন্যদের কাছে।

দুই জার্মানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পূর্ব জার্মানীর সরকার খুব তৎপর ছিল। পশ্চিম জার্মান সরকারও মানবাধিকার ইস্যুগুলো খুঁচিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি বজায় রাখত। কিন্তু একই ভাষা, একই জাতি এবং একই পরিবারের মধ্যে টান কিন্তু ঘুঁচাতে পারে নি। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রায় ১৩০০০ পুর্ব জার্মানবাসী অষ্ট্রিয়া -হাঙ্গেরিয়ান সীমান্তে পালিয়ে আসে। চেকোস্লোভাকিয়ায় পশ্চিম জার্মান দুতাবাসে কয়েকশ পূর্ব জার্মান আশ্রয় নেয় এবং পরে তাদের বিশেষ ট্রেনে করে পশ্চিম জার্মানী নিয়ে আসা হয়। সে মাসেই এরিক হোনেকার পূর্ব জার্মানীর প্রিমিয়ার পদ থেকে সরে দারান।
ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপে ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পূর্ব জার্মানদের উপর ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। সেটা ছিল এক নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তা নিয়ে কোন প্রস্তুতি ছিল না, এমনকি বর্ডার গার্ডরাও কিছু জানতেন না। তবে সেই ঘোষণা দেয়ার সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন এই সিদ্ধান্ত কি কখন থেকে কার্যকর হবে? তখন মূখপাত্রটি আমতা আমতা করে বলেন আমিতো কোন সময় উল্লেখ দেখছি না - এখন থেকেই ধরতে পারেন। এটি সরাসরি টিভিতে দেখানো হচ্ছিল। তা শুনে দলে দলে লোক বার্লিনের বিভিন্ন চেকপোষ্টে চলে আসে। লোকের প্রচন্ড চাপে সীমান্তরক্ষীরা হাল ছেড়ে দেয় এবং সরে দাঁড়ায়। প্রায় বিশ হাজার লোক সেদিন দেয়াল ভেঙ্গে ও টপকে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসে। বার্লিন ওয়ালের পতন হয়।

এই ঘটনা পরবর্তী বছরে দুই জার্মান একীভূত করাকে তরান্বিত করে। 'আমরা এক জাতি - এই স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাও এক সময় আলাদা হয়েছিল। জার্মানদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল দেশ ভাগ এবং ভাবধারার ভিন্নতা। আমাদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ধর্মীয় ভাগ। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই জাতীয়তা। অথচ ধর্মের ভিন্নতা আমাদের দুরে ঠেলে দিল।

দুই জার্মানীকে আলাদা রাখার জন্যে সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। পূর্ব জার্মানীতে টিভিতে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করা হত পশ্চিম জার্মানীর বিরুদ্ধে খুনসুটি করার জন্যে। বাইরে দেয়াল থাকলেও কিন্তু লোকজনের মনে দেয়াল ছিল না। তাই দুই জার্মানীর আবার এক হওয়া সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু আমাদের দুই বঙ্গের কি অবস্থা? ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প এখনও ছড়ায়। পশ্চিম বঙ্গে বাংলা ভাষার কদর কমে যাচ্ছে। নেই সেখানে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের প্রবেশাধিকার। সাংস্কৃতিক বিনিময় আগের চাইতে অনেক কম। পশ্চিম বঙ্গে বাংলাদেশের ক'জন লেখকের বই বিক্রি হয়? পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষ এখন রাজনৈতিক এজেন্ডা- এটি কিছু মানুষের রুটি রুজির ব্যাপার। বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে তারা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলতে ব্যস্ত। আমরা না চাইলেও দুরত্বটা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সব মিলে দুই বঙ্গের কারও কি ইচ্ছে হয় আবার কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে এক সাথে মেলার? জানি বর্তমান বাস্তবতায় হয়ত একত্রীকরণ বেশীই চাওয়া হবে। তবে নিদেনপক্ষে ভিসা বিহীন যাতায়াত, ইইউর মত ইকনমিক জোন?
কিন্তু সেটা সম্ভব করার আগে আমাদের মনের দেয়াল ভাঙ্গতে হবে।

প্রথম  প্রকাশ: সচলায়তন

Sunday, November 01, 2009

বাংলাদেশের বাক স্বাধীনতায় চীনের হস্তক্ষেপ



দৃক বাংলাদেশ এবং স্টুডেন্টস ফর এ ফ্রি তিবেত সংস্থার বাংলাদেশ শাখা সম্প্রতি তিব্বতের উপর এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীটি গতকাল শুরু হয়ে নভেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত হবার কথা ছিল।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকার চীন দুতাবাসের সাংস্কৃতিক এটাশে এবং কাউন্সেলর দৃক গ্যালারীতে এসে এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ড: শহীদুল আলমের সাথে দেখা করেন এবং প্রদর্শনীটি বন্ধ করতে বলেন। তারা কিছু উপঢৌকনও নিয়ে এসেছিলেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে তিব্বৎ চীনের অন্তর্গত এবং এই প্রদর্শনী বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। ড: আলম বলেন যে দৃক একটি স্বাধীন গ্যালারী এবং চীনা দুতাবাস চাইলে তাদের বক্তব্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনে পেশ করতে পারেন। এমনকি চীন চাইলে তাদের প্রদর্শনীও এখানে করতে পারবে। তারা গ্যালারী দেখে প্রস্থান করে।

কিন্তু এরপর নানা হুমকি আসতে থাকে দৃক এর উপর। ওদিকে স্টুডেন্টস ফর এ ফ্রি তিবেত এর সদস্যদের বাড়ীর আসে পাশে গোয়েন্দা হানা দেয়া শুরু করে। ফোন আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে: "চায়না আমাদের বন্ধু। দালাই লামার ছবি দেখিও না।" "না না, আমরা সেন্সরশীপের কথা বলছি না। তবে জানেনই তো..." এর পর এক নামকরা তারকার কাছ থেকে ফোন আসে। জাসদের এমপি হাসানুল হক ইনু ফোন করেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন বাংলাদেশের এক চীন নীতির কথা এবং এই প্রদর্শনী বাংলাদেশের জনগণের জন্যে কি প্রভাব বয়ে আনবে তা। চারিদিক থেকেই চাপ আসতে থাকে এবং শেষে তা পুলিশী ধমকিতে পরিণত হয়।

এসবির লোক আসে শহিদুল আলমের সাথে দেখা করতে। তারা উদ্যোক্তাদের সবার পরিচয় জানতে চান। শহিদুল অফিসিয়াল অর্ডারের কথা জানতে চান। উত্তর আসে "আপনি খামাখা জটিল করে ফেলছেন।" এবং তাকে শুনিয়েই উপরওয়ালার সাথে কথাবার্তা চলতে থাকে। " উনি সহযোগিতা করছেন না.. আমরা বুঝিয়েছি ওনাকে ব্যাপারটা.. না না এখনও কিছু করি নি। এর পরে তারা আবার আসে এবং ধমক দেয় সরকারকে সহযোগিতা না করলে ভবিষ্যতে দৃকের কপালে খারাবি আছে।

গতকাল (পহেলা নভেম্বর) বিকেলে পুলিশের ফোন আসে, "প্রদর্শনী বন্ধ করুণ না হলে ফোর্স পাঠাবো।" ফোর্স পাঠাতে হল তাদের এবং তালা মেরে দেয়া হলো প্রদর্শনী হল। কাউকে ঢুকতে দেয়া হলো না দৃকে। প্রধান অতিথি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল) দু ঘন্টা পর প্রতীকী উদ্বোধন করলেন। তখনও প্রদর্শনী বন্ধ ছিল - পুলিশ নাকি চাবি হারিয়ে ফেলেছে।

চীন সরকারের অন্যান্য দেশের উপর খবরদারীর এই লক্ষণ খুবই খারাপ। আর তাদের এই আন্তর্জাতিক সেন্সরশীপ অবশ্য বাংলাদেশ, নেপালের মত দুর্বল দেশের উপর শুধু ভালভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

দৃক নিউজ সাইটটি এখন একটি রিপোর্টেড অ্যাটাক সাইট । এই কাজটি চীনের নেট সৈনিকদেরই কাজ হতে পারে। তাদের সেন্সরশীপের পরিধি তারা যত দুর সম্ভব বাড়াতে চেষ্টা করে এভাবে - যেমন তারা গত জুলাইতে মেলবোর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভালে উইঘুর দের নিয়ে রাবেয়া কাদিরের চলচ্চিত্রটি দেখানো রোধ করতে ফেস্টিভ্যালের সাইট হ্যাক করে চাইনিজ পতাকা ঝুলিয়ে দেয়।

এর কারণ আমাদের রাজনীতিবিদগন এবং রাষ্ট্রযন্ত্র যারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে চীনের পা চাটে। আমরা কোন দেশে বাস করছি? চীন না বাংলাদেশ? একটি প্রদর্শনী করার জন্যে কেন চীনের অনুমতি নেয়া লাগবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীনের অবস্থান সবাই জানে। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে। নব্বুই এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশীরা তাইওয়ান যেতে পারত না। কারণ পাসপোর্টে লেখা থাকতে ইজরায়েল ও তাইওয়ান ব্যাতিত সকল দেশে ভ্রমণ করা যাবে। এর পেছনেও ছিল চীন তোষণ নীতি। অথচ তাইওয়ানের সাথে ব্যবসা কি থেমে থেকেছে? বর্তমানে কি চীনের চাপে আবার বাংলাদেশ এরূপ ব্যান আরোপ করার ক্ষমতা রাখে (যখন কম্পিউটারের অনেক যন্ত্রাংশ আসে তাইওয়ান থেকে)?

চীন আমাদের তাদের ঠুনকো সস্তা জিনিষ বিক্রি করা ছাড়া কি দেয়? তারা সেতু নির্মাণ ইত্যাদিতে যেসব সহায়তা দেয় তা উসুল করে নেয় নিজস্ব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও নিজস্ব লোকবল লাগিয়ে। কেন কারণ ছাড়া চীনকে তোষণ করতে হবে?

চীন একটি একনায়কতন্ত্র আর বাংলাদেশ একটি গণতন্ত্র। এদেশে চীনের নীতি ফলানো গণতন্ত্রের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। কি হতো প্রদর্শনীটি হতে দিলে? কয়েকশ লোক হয়ত তা দেখত, ব্যাস। এখন এটি বন্ধ করে বাংলাদেশ যে পরিমাণ প্রচার পেল তাতে বরঞ্চ দেশের ইমেজের ক্ষতি হল। আমাদের তোষণ ও মোসাহেবী স্বভাব যে কবে পাল্টাবে এবং আমরা ভিক্ষার থালা ফেলে দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে কোনদিন বাঁচতে পারব সে বলা মুস্কিল।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের সাংবিধানিক অধিকার - বাক স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা - চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে জিইয়ে রাখার জন্যে তাদের মদদ করা নয়। এই ব্যাপারটি তারা যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।

এ নিয়ে আরও পড়ুন:

* শহিদুল আলমের ব্লগটুইটার

* গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইন

* মাশুকুর রহমান

* সাদা কালো

* রব গডেন

* মিডিয়া হেল্পিং মিডিয়া